• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

দুর্বিপাকের ঘূর্ণাবর্তে বিএনপি

  • মহিউদ্দিন খান মোহন
  • প্রকাশিত ০৯ মার্চ ২০১৯

বিএনপিতে এখন চলছে বহিষ্কারের কর্মসূচি। প্রতিদিনই সংবাদপত্রে দেশের কোনো না কোনো জেলা-উপজেলার নেতাকর্মীদের বহিষ্কারের খবর প্রকাশিত হচ্ছে। পত্রিকার খবর অনুযায়ী এ পর্যন্ত শতাধিক নেতাকে বহিষ্কার করেছে দলটি। দলীয় নির্দেশ অমান্য করে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় ঘোষিত সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। উল্লেখ্য, অনুষ্ঠেয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বয়কট করেছে বিএনপি এবং ঘোষণা করেছে, দলের কেউ যদি নির্দেশ অমান্য করে নির্বাচনে অংশ নেয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিএনপির এই বহিষ্কার কর্মসূচি দলটির জন্য শেষ পর্যন্ত নতুন বিপর্যয় সৃষ্টি করে কি-না, এ প্রশ্ন উঠেছে। কেননা যাদের বহিষ্কার করা হচ্ছে, তারা স্থানীয় পর্যায়ের প্রভাবশালী নেতা। এদের বেশিরভাগই উপজেলা নির্বাচনে অতীতে এক বা একাধিকবার নির্বাচিত হয়েছেন। দলকে তৃণমূল পর্যায়ে শক্তিশালী করতে মূলত এরাই ভূমিকা রেখে থাকেন। এখন যদি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অপরাধে তারা দল থেকে বহিষ্কার হন, তাহলে পরবর্তী সময়ে সংশ্লিষ্ট জেলা-উপজেলাগুলোতে নেতা সঙ্কট দেখা দিতে পারে। রাজনৈতিক সচেতন মহল বলছে, এভাবে বহিষ্কার না করে বিএনপির এক্ষেত্রে কৌশলের আশ্রয় নেওয়া উচিত ছিল। দলীয়ভাবে নির্বাচন বয়কট করলেও স্থানীয় নেতাকর্মীদের জন্য নির্বাচনে যাওয়ার পথ উন্মুক্ত রাখা যেত। কেউ যদি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে চায়, তাদের জন্য সে পথ খোলা রাখতে পারত। কারণ আমাদের দেশে স্থানীয় পরিষদগুলোর নির্বাচন জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে অতটা সম্পৃক্ত না হলেও স্থানীয়ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এদিকে দলের চেয়ারপারসনের কারাবন্দি থাকা নিয়ে দলের মধ্যে দেখা দিয়েছে নানা সঙ্কট। এক বছরের বেশি সময় ধরে নেত্রী কারাবন্দি থাকলেও তার মুক্তির ব্যাপারে দল কোনো কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। স্মরণযোগ্য, খালেদা জিয়ার মামলার একেবারে শেষ পর্যায়ে বিএনপির কর্মীদের স্লোগান ছিল— ‘আমার নেত্রী আমার মা, জেলে যেতে দিব না’। কিন্তু দেখা গেল বিএনপি নেতাদের হাঁকডাককে মিথ্যা প্রমাণ করে বেগম জিয়াকে কারাগারে যেতে হলো। এরপর বিএনপি নেতাকর্মীদের স্লোগানে ঈষৎ পরিবর্তন এলো। ‘আমার নেত্রী আমার মা, জেলে থাকতে দিব না’- এই স্লোগানে তারা আকাশ-বাতাস কাঁপাতে চাইল। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেছে কর্মীরা নেত্রীকে কারাগার থেকে মুক্ত করতে পারেনি। স্মরণ থাকার কথা, বিএনপি চেয়ারপারসনকে যেদিন কারাগারে নেওয়া হয়, সেদিন নেতারা বলেছিলেন, তার মুক্তির জন্য শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করা হবে। তবে সে আন্দোলনের ডিজাইন সম্পর্কে তারা কিছু বলেননি। এ পর্যন্ত বেগম জিয়ার মুক্তির আন্দোলন হিসেবে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে একজন নেতার নিয়মিত প্রেস ব্রিফিং আর দুয়েকটি মানববন্ধন ছাড়া কিছুই হয়নি। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বিএনপি নেতাদের দলের চেয়ারপারসনের কথা মনে আছে কি-না, জনমনে সে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। গত ২ মার্চ বাংলাদেশ প্রতিদিন ‘খালেদাকে ভুলে গেছে বিএনপি’ শিরোনামে যে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে বলা হয়েছে- কারাগারে নানা রোগ-শোকে আক্রান্ত ৭২ বছর বয়সী সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে এখন আর ভাবনা নেই বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের। এর আগে দু-চারটি মানববন্ধন ও ঘরোয়া কর্মসূচি নেওয়া হলেও এখন আর তা-ও নেই। গত এক বছরে দলটির নেতৃত্ব তাদের চেয়ারপারসনের মুক্তির দাবিতে শক্ত কোনো কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামেনি। এ বিষয়ে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ পত্রিকাটিকে বলেছেন, ‘আইনি প্রক্রিয়ায় বেগম জিয়াকে মুক্ত করার সম্ভাবনা কম। তাই আমাদের রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমেই দেশনেত্রীকে মুক্ত করতে হবে। তবে কী ধরনের কর্মসূচি আসবে তা এখনই বলা সম্ভব নয়। দল পুনর্গঠন করে আন্দোলনে যেতে হবে।’ পত্রিকাটি লিখেছে- নেত্রীর মুক্তির বিষয়ে দলটির হাই কমান্ড কার্যত নীরব। শুধু বক্তৃতা-বিবৃতিতেই তারা নেত্রীর মুক্তির দাবি করছেন। বাস্তবে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত অধিকাংশ কেন্দ্রীয় নেতা। পত্রিকাটির রিপোর্টের কারণেই কি-না জানি না, হঠাৎ গত ৬ মার্চ বেগম জিয়ার মুক্তির দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছে দলটি। 

এদিকে দলের বর্তমান স্থবিরতা কাটাতে সব পর্যায়ে কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনের দাবি উঠেছে দলটির তৃণমূল পর্যায় থেকে। এ প্রসঙ্গে একই পত্রিকার ১৩ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তৃণমূল নেতাকর্মীরা মনে করেন, দল এখন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। চেয়ারপারসন জেলে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশের বাইরে। সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেভাবেই হোক ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটেছে। এ মুহূর্তে বিএনপিকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে দল গোছানোর বিকল্প নেই। তারা এ অভিমতও ব্যক্ত করেছেন যে, এ মুহূর্তে দলের নির্বাহী কমিটির সদস্যদের নিয়ে একটি বর্ধিত সভা ডাকা উচিত। সেখানে আসা মতামতের ভিত্তিতেই দল গোছানো জরুরি। পত্রিকাটি লিখেছে, খালেদা জিয়ার মুক্তির আগে দল পুনর্গঠনের বিষয়ে দুই ভাগে বিভক্ত বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির এক অংশ বলছে বেগম জিয়ার অনুমতি নিয়ে এখনই বিএনপিকে গোছাতে হবে। পুনর্গঠন করেই তার মুক্তি আন্দোলন ত্বরান্বিত করতে হবে। অন্য অংশ বলছে, বেগম জিয়ার মুক্তির পর বিএনপিকে গোছাতে হবে। নইলে যে কোনো ধরনের বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। এ দোটানা পরিস্থিতির মধ্যে কয়েকদিন আগে কৃষক দল ও মৎস্যজীবী দলের কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। কিন্তু কাউন্সিল না করে আহ্বায়ক কমিটি করায় নেতাকর্মীরা অসন্তোষ প্রকাশ করছেন। এই পুনর্গঠনে তৃণমূলের মতামতের প্রতিফলন ঘটেনি বলেও তারা নানা মাধ্যমে অভিমত প্রকাশ করেছেন। অপরদিকে সম্প্রতি বেশকিছু নেতার দলত্যাগের ঘটনাও ঘটেছে। অনেকে দল না ছাড়লেও নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন। এর মধ্যে তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত খুলনার সাবেক সংসদ সদস্য আলী আসগর লবীর পদত্যাগ নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। নেতাকর্মীদের এ দলবিমুখতা আগামীতে বিএনপিকে আরো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি করতে পারে বলে রাজনীতি বোদ্ধামহল মনে করছেন।

এদিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল ও সরকারি প্রশাসনের কারচুপির তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপনের জন্য ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে গণশুনানি আয়োজন করা হয়েছিল গত ২২ ফেব্রুয়ারি। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ওই গণশুনানিতে ৪১ জন প্রার্থী নির্বাচনে অনিয়ম-কারচুপির তথ্য তুলে ধরেন। প্রার্থীরা ভোট কারচুপির তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি দল ও ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে জবাবদিহি দাবি করেন। তারা জানতে চান, ভোটের মাঠে প্রার্থীরা দাঁড়াতে না পারলেও কারচুপির বিরুদ্ধে ভোটের পরে কেন প্রতিবাদ কর্মসূচি দেওয়া হয়নি? কেন আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়নি? সর্বশেষ যে বিব্রতকর ঘটনাটি ঘটেছে তা হলো, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত গণফোরাম নেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ।

এদিকে জোট নিয়েও স্বস্তিতে নেই বিএনপি। গত ৬ মার্চ দৈনিক যুগান্তর ‘জোট নিয়ে অস্বস্তিতে বিএনপি’ শীর্ষক এক বিশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে- ২০ দলীয় জোট এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে অনেকটা বেকায়দায় আছে দলটি। বিশেষত জোটসঙ্গী জামায়াতকে নিয়ে তারা বেশ অস্বস্তিতেই আছে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন শক্তি জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের জন্য দীর্ঘদিন ধরেই বিএনপির ওপর চাপ সৃষ্টি করে আসছে। অন্যদিকে ২০ দলীয় জোটের শরিকদের চেয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ায় জোটের মধ্যে দূরত্ব বেড়েই চলেছে। যদিও দলটির নীতিনির্ধারকরা তা মানতে নারাজ। তাদের মতে, জোট ও ঐক্যফ্রন্টে কোনো সঙ্কট নেই। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পত্রিকাটিকে বলেছেন, ‘২০ দলীয় জোট, ঐক্যফ্রন্ট বা বিএনপির মধ্যে কোনো টানাপড়েন তৈরি হয়নি। এখানে নানা ইস্যুতে অনেকের মান-অভিমান থাকতে পারে। যদি থাকে, আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হবে।’ তবে বিএনপি নেতাদের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে দলটির থিঙ্কট্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি এমাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন, ‘গণফোরামের দুই প্রার্থীর শপথ নেওয়ার ঘোষণায় বিএনপি খানিকটা বেকায়দায় পড়েছে। কারণ যে প্রতিশ্রুতি নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল, শুরুতেই তাতে বিঘ্ন ঘটেছে। দুজন নেতাকে তারা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন।’ তিনি জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক রাখা উচিত নয় বলেও অভিমত দিয়েছেন।  

এদিকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে বলে সম্প্রতি একাধিক সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। গত ৪ মার্চ ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আমার সংবাদ পত্রিকার এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তারেক রহমানকে নিয়ে খোদ দলের ভেতরে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তারেক রহমানের সিদ্ধান্ত নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের নেতারা প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেছেন। এ বিষয়ে বিএনপির অন্যতম পরামর্শদাতা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অবস্থান আগাগোড়াই স্পষ্ট।  খালেদা জিয়ার জন্য তার পরামর্শ হলো- দলের চেয়ারপারসনের পদ ছেড়ে উপদেষ্টা হয়ে যাওয়ার। ডা. জাফরুল্লাহর এসব পরামর্শ অবশ্য বিএনপি নেতাকর্মীরা আমলে নিচ্ছেন না। কেননা বাস্তবতা হলো- দলের অবস্থা যা-ই হোক না কেন, কর্মীদের মধ্যে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জনপ্রিয়তা এখনো আকাশচুম্বী।

বিএনপি বর্তমানে যে অবস্থায় রয়েছে, তাকে স্বাভাবিক বলা যায় না। চেয়ারপারসনের কারাদণ্ড ও কারাবন্দি হওয়া, তার মুক্তি আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থতা, নির্বাচনে বিপর্যয় এবং উপজেলা নির্বাচনকে ঘিরে সৃষ্ট বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দলটিকে দুর্বিপাকের ঘূর্ণাবর্তেই নিক্ষেপ করেছে বলে মনে করছেন রাজনীতি-সচেতন ব্যক্তিরা। এ কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে বিএনপি আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি-না, তা নিয়ে অনেকেরই সংশয় রয়েছে।

 

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads