• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯
বছরের আলোচিত চরিত্র পেঁয়াজ

ফাইল ছবি

মতামত

বছরের আলোচিত চরিত্র পেঁয়াজ

  • মহিউদ্দিন খান মোহন
  • প্রকাশিত ২৩ নভেম্বর ২০১৯

‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’ ছিল একসময় এদেশের পাঠকনন্দিত পত্রিকা। স্বাধীনতার পর থেকে আশির দশক পর্যন্ত সাপ্তাহিক পত্রিকার জগতে বিচিত্রা ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। নানা বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ, বিষয়ভিত্তিক নিবন্ধ উপস্থাপনের মাধ্যমে পাঠকসমাজে মর্যাদার আসনে বসেছিল পত্রিকাটি। সাপ্তাহিক বিচিত্রার একটি বৈশিষ্ট্য ছিল, প্রতিবছর ডিসেম্বর শেষে ‘বছরের আলোচিত চরিত্র’ নামে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করত। সে চরিত্র হতে পারে কোনো বিশেষ ব্যক্তি কিংবা কোনো ঘটনাও। পত্রিকাটি এখন আর বেঁচে নেই। অপঘাতে ওটার মৃত্যু হয়েছে। তবে, বনেদি পাঠকদের মুখে এখনো বিচিত্রার নাম শোনা যায়। সে রকম একজন পাঠক বলছিলেন, আজ যদি সাপ্তাহিক বিচিত্রা জীবিত থাকত, তাহলে ২০১৯-এর বছরের আলোচিত চরিত্র হিসেবে পেঁয়াজকেই হয়তো নির্ধারণ করত। কথাটি একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। বছরের শেষ প্রান্তে এসে নিত্য ব্যবহার্য পণ্য পেঁয়াজ যে খেলা দেখাল, তা এদেশের মানুষের মনে অনেকদিন স্মৃতি হয়ে থাকবে।

এ নিবন্ধ যখন লিখছি, তখন পেঁয়াজের দাম মহাকাশ থেকে মর্ত্যমুখী হতে শুরু করেছে। প্রতি কেজি ৩০০ টাকা দরে যে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে, তা এখন ১৮০-১৯০ টাকা দরে কিনতে পারছে পাবলিক। যদিও পেঁয়াজের স্বাভাবিক মূল্য ফিরে আসেনি এখনো, তবে জনমনে কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসতে শুরু করেছে এই ভেবে যে, পেঁয়াজের দামের ঊর্ধ্বাকাশ যাত্রার আপাত বিরতি ঘটেছে।

পেঁয়াজ আমাদের দেশে নিত্যপণ্যের মধ্যে অন্যতম। তরকারিতে এর ব্যবহার হয় ঘরে ঘরে। শুধু ভোজন বিলাসীরাই নন, সবাই এ মসলা জাতীয় পণ্যটি রসনা তৃপ্তির কাজে ব্যবহার করেন। উপাদেয় সব ব্যঞ্জন তৈরিতে পেঁয়াজের সংমিশ্রণ অত্যাবশ্যকীয়। শুধু কি তাই? সালাদেও কাঁচা পেঁয়াজের ব্যবহার বহুল প্রচলিত। অবশ্য হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রাহ্মণগোত্রীয়রা পেঁয়াজ বা পোঁয়াজ সহযোগে রান্না করা খাদ্য খান না। আবার মুসলমানদের মধ্যে অনেকে কাঁচা পেঁয়াজ খান না। পেঁয়াজ হারাম নয়, মাকরূহ। তাই অনেক মুসলমান কাঁচা পেঁয়াজ খাওয়া এড়িয়ে চলেন।  

তো সে পেঁয়াজ এবার আমাদেরকে এমন এক খেলা দেখাল যে, বিস্ময়ে বাকশক্তি রহিত হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। সেপ্টেম্বর মাসের গোড়ার দিকে যে পেঁয়াজের দাম ছিল ৪০-৪৫ টাকা কেজি, দুই মাসের ব্যবধানে নভেম্বরের মাঝামাঝিতে তা উঠে গিয়েছিল আড়াই শ টাকায়। কোথাও কোথাও তা ৩০০ টাকায়ও বিক্রি হয়েছে বলে শোনা গেছে।  পেঁয়াজ মূল্যের কেন এই উল্লম্ফন? এ বিষয়ে নানাজনে নানা রকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কেউ বলেছেন ভারতে পেয়াজ উৎপাদন কম হওয়ায় তারা রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। সেজন্য হঠাৎ করে পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেছে। আবার ভিন্নমতও রয়েছে। কেউ কেউ এর পেছনে সিন্ডিকেটের কারসাজি রয়েছে বলে মনে করছেন। পরিসংখ্যান মতে, আমাদের দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বছরে প্রায় ২৬ লাখ টন। উৎপাদন হয় ২৩ লাখ টন। তাহলে ঘাটতি থাকে ৩ টন, যা আমদানি করে মেটানো হয়। এ ৩ টন পেঁয়াজের সিংহভাগ আমদানি করা হয় ভারত থেকে। কারণ দেশটির সাথে আমাদের সড়ক যোগাযোগ থাকায় এলসি খোলার এক সপ্তাহের মধ্যে পণ্য দেশে প্রবেশ করতে পারে। ভারতের কেরালা রাজ্য পেঁয়াজ উৎপাদনে সেরা। মূলত সেখানকার পেঁয়াজই আমাদের দেশে আমদানি হয়ে থাকে। এবার বন্যাজনিত কারণে ওই রাজ্যে পেঁয়াজ উৎপাদন মার খেয়েছে। অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে ভারত বিদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করে সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে। একটি দেশ তার নিজস্ব সমস্যার কারণে যেকোনো পণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমদানিকারক দেশকে পরিস্থিতি সামাল দিতে ত্বরিত পদক্ষেপ নিতে হয়। কিন্তু আমাদের সরকার উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায়  তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে যে ব্যর্থ হয়েছে তা অস্বীকার করা যাবে না। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার সাথে সাথে যদি সরকার অন্য দেশ থেকে তা আমদানির উদ্যোগ নিত, তাহলে হয়তো এমন সংকটে পড়তে হতো না। কয়েকদিন আগে একটি টেলিভিশন টকশোতে এক সাংবাদিক বলছিলেন, মাস তিনেক আগে একজন ব্যবসায়ী বাণিজ্য সচিবকে জানিয়েছিলেন, দেশে পেঁয়াজের যে মজুত রয়েছে, তাতে চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে না। তিনি তখনই পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু সচিব মহোদয় নাকি ব্যবসায়ীর কথাকে পাত্তাই দেননি। অথচ তখনই যদি পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হতো তাহলে এ সংকট হয়তো সৃষ্টি হতো না।

পণ্য সংকট সৃষ্টি হওয়া নতুন কোনো বিষয় নয়। যেকোনো সময়ে বিশেষ কারণে একটি দেশে পণ্য সংকট দেখা দিতে পারে। তবে, সে সংকট মোকাবেলায় সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়াই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু এবার পেঁয়াজ সংকটের সময় সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কথাবার্তা মানুষকে যারপরনাই হতাশ করেছে। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্যমন্ত্রী যে পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন, তা অস্বীকার করা যাবে না। যখন পেঁয়াজের দাম ক্রমান্বয়ে বাড়ছিল, তখনই দাবি উঠেছিল মজুতদার ও মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার। কিন্তু মন্ত্রী মহোদয় তখন বললেন যে, অ্যাকশনে গেলে ব্যবসায়ীরা ক্ষেপে যেতে পারে। তাতে নাকি হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা কী দেখলাম? পেঁয়াজের মজুতদার আর মুনাফখোর ব্যবসায়ীরা ফাঁকা মাঠে গোল দিল। যদিও পেঁয়াজ ডাবল সেঞ্চুরি করার পরে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার লোকজন মাঠে নেমেছে এবং তারা আড়াই হাজার ব্যবসায়ীকে জরিমানাও করেছে (সূত্র: বাংলাদেশের খবর, ১৯ নভেম্বর ২০১৯)। তবে তাদের বেশির ভাগই বিভিন্ন বাজারের খুচরা দোকানদার। পেঁয়াজের আমদানিকারক, আড়তদার কিংবা পাইকারি ব্যবসায়ীদের কারো টিকিটি স্পর্শ করার খবর পাওয়া যায়নি। 

এদিকে পেঁয়াজ নিয়ে যখন চারদিকে হাহাকার চলছে, তখন সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এমন সব কথা বললেন, যা শুনে আমজনতা থ মেরে গেল! উপদেশ বিতরণ করতে শোনা গেল পেঁয়াজ না খাওয়ার বা পেঁয়াজ না খেলে কী হয়? না, পেঁয়াজ না খেলে মানুষ একেবারে রসাতলে যাবে বা সর্বনাশ হয়ে যাবে এমনটি নয়। পেঁয়াজ ছাড়াও তরকারি খাওয়া যায়। তবে, আমাদের দেশ তথা এ উপমহাদেশে খাবারের সাথে পেঁয়াজের ব্যবহার ট্র্যাডিশনালই বলা চলে। দরিদ্র মানুষেরা এখনো কাঁচামরিচ-পেয়াজ সহযোগে পান্তাভাত খেয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি করে থাকে। তো সেই পেঁয়াজ কি অত সহজেই দৈনন্দিন খাদ্য তালিকা থেকে ঝেড়ে ফেলা সম্ভব? অন্যদের কথা বাদই দিলাম। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যখন তিনি নিজে পেঁয়াজ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন বলে জনসাধারণকে পেঁয়াজ বর্জনে উদ্বুদ্ধ করতে চাইলেন, তখন একটু অবাকই হতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যেদিন কথাটি বললেন, সেদিন রাতেই একটি টিভি চ্যানেলের টকশোতে ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত মন্তব্য করেছেন, ‘এটা কোনো সমাধান হতে পারে না।’ কেউ কেউ এ কথাকে ‘মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলা’ প্রবাদের সাথেও তুলনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কি না জানি না, পরবর্তীতে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বললেন যে, তিনি নিজে নাকি পেঁয়াজ ছাড়া বিশ-বাইশ পদের রান্না করতে জানেন। হা হতোষ্মি! যে মুহূর্তে মানুষ শুনতে চেয়েছে পেঁয়াজের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনতে সরকারের পদক্ষেপের কথা, তখন কিনা তারা বললেন পেঁয়াজ না খেলে কী হয়? কেউ দিলেন পেঁয়াজ ছাড়া রান্নার রেসিপি! না, পেঁয়াজ ছাড়া তরকারি খাওয়া যায় না এমন নয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে একটি গোত্রের পেঁয়াজ না খাওয়ার কথা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। কিন্তু দেশের সবাই যদি একযোগে পেঁয়াজ খাওয়া ছেড়ে দেয়, তাহলে পেঁয়াজচাষীদের অবস্থাটা কী দাঁড়াবে তা কি একবার মহোদয়রা ভেবে দেখেছেন? সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী পেঁয়াজ বিষয়ে এখন পর্যন্ত টুঁ শব্দটি করেননি। সংকটময় এ সময়ে তিনি রয়েছেন বিদেশ সফরে। ওই সফর কতটা জরুরি ছিল আমাদের জানার কথা নয়। তবে এমন সময়ে তার দেশে অনুপস্থিত থাকাটা ভালোভাবে নেয়নি দেশবাসী।

প্রশ্ন উঠেছে পেঁয়াজের দামের এ ঊর্ধ্বগতি থামবে কবে এবং কীভাবে। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, পেঁয়াজ পরিস্থিতি সামাল দিতে জলপথ, স্থলপথ ও আকাশপথে দেশে পেঁয়াজ প্রবেশ করানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যেদিন বললেন, ‘পেঁয়াজ প্লেনে উঠে গেছে, আর চিন্তা নাই’-দেশবাসী সেদিনই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে। কারণ প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তাদের রয়েছে অগাধ আস্থা। তারা জানে যাবতীয় সমস্যা-সংকট নিরসনে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকেই হস্তক্ষেপ করতে হয়। মন্ত্রীরাও সব সময় ‘বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেখছেন’ বা ‘প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন’ বলেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেন। প্রশ্ন হলো, সবকিছু যদি প্রধানমন্ত্রীকেই দেখতে হবে, ভাবতে হবে, করতে হবে, তাহলে মন্ত্রী পদবিধারী এসব সাক্ষীগোপাল রয়েছেন কেন? কী তাদের কাজ? বোধকরি এসব পর্যবেক্ষণ করেই উচ্চ আদালত মাস দুয়েক আগে মন্তব্য করেছিলেন, সবই যদি প্রধানমন্ত্রী করবেন, তাহলে সচিবরা রয়েছেন কেন? হাইকোর্ট সচিবদের আবশ্যকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, এখন তো মন্ত্রীদের সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। পত্রপত্রিকায় খবরে বলা হচ্ছে, হাজার হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির এলসি খোলার কথা। কিন্তু কবে নাগাদ সেসব পেঁয়াজ এসে বাংলাদেশে তাদের চেহারা মোবারক দেখাবে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। হাওয়াই জাহাজে যেসব পেঁয়াজ আসার কথা, সেগুলোর দুয়েকটি চালান হয়তো এ নিবন্ধ প্রকাশের আগেই বাংলাদেশের ভূমি স্পর্শ করবে। কিন্তু তাতে বিদ্যমান সংকটের কতটা সুরাহা হবে বলা মুশকিল। আর তাই সংগত কারণেই সংশয় জাগে, পেঁয়াজ সংকট থেকে দেশবাসীর নিষ্কৃতির সম্ভাব্যতা নিয়ে।

পৃথিবীতে সমাধান অযোগ্য কোনো সমস্যা সৃষ্টি হয় না, অতীতেও হয়নি। হঠাৎ সৃষ্ট সংকটও একসময় কেটে যায়। তবে, হঠাৎ উদ্ভূত সংকট মানুষকে বিপাকে ফেলে এটা যেমন ঠিক, পাশাপাশি তা শিক্ষাও দেয়। সাধারণত আশ্বিন-কার্তিক মাসে আমাদের দেশে পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি পায়। এটা সাংবাৎসরিক ঘটনা। এ সময়ে দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের স্টক ফুরিয়ে আসে। নতুন পেঁয়াজ ওঠার আগ পর্যন্ত বাজারে পেঁয়াজ সরবরাহ থাকে কম। ফলে দামও থাকে বেশি। এই সময়ের চাহিদা মেটানোর জন্যই প্রয়োজন আগাম প্রস্তুতি। অন্যদিকে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন বৃদ্ধিরও পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। সরকারের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টির প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দিলেই ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হতে পারে।

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads