• বুধবার, ৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪২৯
কাউন্সিলর নাঈম এক আতঙ্কের নাম

ফাইল ছবি

অপরাধ

কাউন্সিলর নাঈম এক আতঙ্কের নাম

  • এমদাদুল হক খান
  • প্রকাশিত ২৩ নভেম্বর ২০১৯

রাজধানীর বিমানবন্দরের কাওলা-আশকোনা এলাকার সাধারণ মানুষের কাছে এক আতঙ্কের নাম কাউন্সিলর নাঈম। জমি দখল, চোরাকারবারি, চাঁদাবাজি, অত্যাচার-নির্যাতনের নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হওয়ার পর আনিছুর রহমান নাঈম (৩৮) যেন আলাদিনের চেরাগ পেয়ে যান। একসময় হাটে সবজি ও মাছ বিক্রেতা এখন কোটি কোটি টাকা এবং গাড়ি-বাড়ির মালিক। রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করেই তিনি সম্পদশালী হয়েছেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। বিমানবন্দর, কাওলা, শিয়ালডাঙ্গা ও গাওয়াইরসহ আশপাশের এলাকায় দখল ও চাঁদাবাজির জন্য রয়েছে নাঈমের নিজস্ব বাহিনী। তারা এলাকায় ‘নাঈম খলিফা’ হিসেবে পরিচিত। পাবলিক টয়লেট, বিমানবন্দর মোড়ের মসজিদ কমপ্লেক্স, ফুটপাত, রাস্তা, সাইনবোর্ড, খাসজমি ও সাধারণ মানুষের জমি দখল কোনো কিছুই যেন বাদ যাচ্ছে না তার থাবা থেকে। তবে কাউন্সিলর নাঈম সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন। তার মানসম্মান নষ্ট করতেই একটি মহল এসব অপ্রচার চালাচ্ছে।

কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অবসরপ্রাপ্ত গবেষক ড. হারুনার রশিদ অভিযোগ করেন, তার জমিতে বাউন্ডারি দিতে গেলে সশস্ত্র লোকজন নিয়ে বাধা দেন কাউন্সিলর নাঈম। বলেন, এই জমিতে তাদের অংশ আছে। পরে রাতের আঁধারে পুরো জমি দখলে নেন। এরপর নামমাত্র মূল্যে জমিটি লিখে দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন নাঈম। এক পর্যায়ে মাত্র ৯০ লাখ টাকায় জমিটি দিতে রাজি হন কৃষি গবেষক হারুনার রশিদ। ২৫ লাখ টাকা দিয়ে জমিটি বায়না দলিল করে নেন নাঈম। এরপর থেকে আর কোনো টাকা দেননি। এমনকি জমিটি রেজিস্ট্রিও করেননি।

মিনারা বেগম নামে এক নারী অভিযোগ করেন, তার স্বামী কাওলা এলাকায় ৬২ শতাংশ জমি ক্রয় করেন। সেই জমিটি দখলে নিয়েছেন নাঈম। স্বামীর শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে মিনারা বেগম এখন পাগলপ্রায়।

রোকেয়া বেগম নামে এক বৃদ্ধা অভিযোগ করেন, তার জমি দখল করে ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণ করেছেন কাউন্সিলর নাঈম। বাড়িটি হোয়াইট হাউজ নামে পরিচিত।

কাউন্সিলর আনিছুর রহমান নাঈম বাংলাদেশের খবরকে বলেন, এসব জমি নিয়ে আমার দাদার আমল থেকে মামলা চলে আসছে। তাই বিচারাধীন বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। বিচারে যা রায় হবে তা-ই মাথা পেতে নেব।

এলাকাবাসী জানান, সাদেক হোসেন খোকা ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র থাকার সময় বিমানবন্দর পাবলিক টয়লেট ফয়েজ নামে এক ব্যক্তিকে ইজারা দেন। তার মৃত্যুর পর ওই টয়লেট ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পান আবদুল হান্নান ওরফে ‘জাপানি হান্নান’। তার হয়ে এটি দেখাশোনা করতেন রোকন। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে ডিএনসিসি সেটা দখলমুক্ত করে। মোটর বসিয়ে অবৈধভাবে পানি বিক্রির অভিযোগে রোকনকে তিন মাসের সাজা দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। পাশাপাশি ডিএনসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ সাজিদ আনোয়ার টয়লেটের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেন নজরুল ইসলাম মোহনকে। তিনি উত্তরা পূর্ব থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

মোহন জানান, কাগজপত্রে টয়লেটটি তার ব্যবস্থাপনায় থাকলেও তাজুল নামে এক ব্যক্তি সেটা দখল করে নিয়েছেন। তাজুলের দাবি, ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নাঈমের নির্দেশে তিনি এটি দখল করেন। টয়লেটে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন তাজুল। নাঈমকে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট একটা অর্থ দেন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ‘এয়ারপোর্ট পাবলিক টয়লেট’ চত্বর ঘিরে অবৈধভাবে গড়ে উঠছে বেশ কয়েকটি হোটেল ও দোকানপাট। এসব দোকানে টয়লেট থেকেই বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন ওই টয়লেট থেকে বিক্রি হয় হাজার হাজার গ্যালন পানি। অসংখ্য মোটরসাইকেল ও গাড়ি ধোঁয়ার কাজও চলে এ টয়লেট থেকে। ব্যবস্থাপনায় জড়িতরা জানান, এখান থেকে প্রতিদিন প্রায় ৮০ হাজার টাকা আয় হয়। কিছু অংশ সিটি করপোরেশনে দেন এবং বাকিটা নিজেরা ভাগবাঁটোয়ারা করে নেন।

পাবলিক টয়লেটের পাশের এক দোকানি জানান, তিনি মাসে দোকান ভাড়া বাবদ ৭ হাজার টাকা আর অগ্রিম দিয়েছেন ২৫ হাজার টাকা। কোনো কোনো দোকানে ১০ হাজার টাকাও ভাড়া আছে। কাউন্সিলরের হয়ে তাজুল ইসলাম তা আদায় করেন।

স্থানীয়রা জানান, এ এলাকাটি নাঈমের ওয়ার্ডে পড়েনি। ইতোমধ্যে সীমানা জটিলতার কথা বলে ‘টাকার খনি’ এ পাবলিক টয়লেট আয়ত্তে নিতে কাউন্সিলর নাঈম ডিএনসিসিতে আবেদন করেছেন। অন্যদিকে জটিলতা এড়াতে সেটি ভেঙে ফেলার আবেদন জানিয়েছেন ১নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আফসারউদ্দিন খান। তিনি বলেন, ‘এয়ারপোর্ট পাবলিক টয়লেট ঘিরে কিছু লোকের অবৈধভাবে অর্থ আয় করার কথা শুনেছি। আমার কিছু করার ক্ষমতা নেই। বিভিন্ন জটিলতার কারণে ওই টয়লেটটি ভেঙে ফেলতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে এরই মধ্যে জানিয়েছি।’

এলাকাবাসীর অভিযোগ, নাঈম ও তার পরিবারের সদস্যরা বিমানবন্দর গোলচত্বরের পূর্ব পাশের বাবুস সালাম মসজিদ মাদ্রাসা কমপ্লেক্স মার্কেট দখল করে নিয়েছেন। এ নিয়ে বিরোধে গত মাসের শুরুর দিকে সেখানে নাঈম বাহিনীর হামলায় তিন নারীসহ চারজন আহত হন। এ নিয়ে বিমানবন্দর থানায় নাঈমসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন হামলায় গুরুতর আহত ব্যবসায়ী নাজমুল হোসেন ভূঁইয়া ওরফে প্রিন্স। এ ছাড়া মসজিদ কমপ্লেক্স দখল করায় আদালতে মামলা করেছেন বাবুস সালাম ওয়াক্ফ এস্টেটের মোতাওয়াল্লি সৈয়দ মোস্তফা হোসেন। এতে কাউন্সিলর নাঈম ছাড়াও মোতালেব মুন্সী, আনিছুর রহমান ও মামুন সরকারকে আসামি করা হয়েছে।

মসজিদ দখল নিয়ে স্থানীয়রা বলছেন, মসজিদে দান ও মার্কেট থেকে মাসে প্রায় ৫০ লাখ টাকার মতো আয় হয়। নাঈম জোর করে দোকানগুলোর ভাড়া নিয়ে যান। কমপ্লেক্সের টাকা ইচ্ছেমতো ব্যয় করেন। তিনি কারো কাছে জবাবদিহি করেন না।

স্থানীয়দের অভিযোগ, নাঈম ও তার লোকজন কিছুদিন আগে স্থানীয় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা স্কুল ও কলেজের পাশের মাঠে তাঁতমেলার নামে মেলা বসিয়ে জুয়ার আসর চালাতেন। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর মেলা বন্ধ করে সেখানে মাছ, সবজি ও ফলের বাজার বসানো হয়েছে। প্রতিটি দোকান থেকে ৮-১০ হাজার টাকা অগ্রিম নিয়ে দৈনিক হিসেবে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। তারা আরো জানায়, নাঈম ও তার লোকেরা সম্প্রতি আশকোনায় নির্মাণাধীন র্যাব কার্যালয়ের পাশে একটি লেক দখল করতে যান। প্রথমে মাছ চাষের কথা বলে সেখানে ঘর তৈরির চেষ্টা করেন তারা। পরে র্যাবের লোকজন নাঈমকে ডেকে নিয়ে মুচলেকা রেখে ছেড়ে দেন।

এলাকাবাসীর দাবি, কাওলা এলাকায় আশিয়ান সিটির প্রবেশমুখের কাছে প্রায় পাঁচ বিঘা জমি দখল করেছেন নাঈম ও তার লোকজন। সেখানে অবৈধ বাস টার্মিনাল ও রিকশা গ্যারেজ করে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। কাউন্সিলরের কার্যালয়ও করা হয়েছে সেখানে। এ ছাড়া কাওলাবাজার এলাকাতেও নাঈমের একটি কার্যালয় রয়েছে। কাওলা সিভিল এভিয়েশন স্টাফ কোয়ার্টারে সংস্কার-নির্মাণকাজসহ যেকোনো ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করে ‘নাঈম বাহিনী’। তারা ঢাকা কাস্টম হাউজেরও কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। যার থেকে তাদের বিশাল অর্থ আসে।

আনিছুর রহমান নাঈম বাংলাদেশের খবরকে বলেন, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নতুন কমিটিতে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। চাঁদাবাজি ও দখলের অভিযোগ মিথ্যা। মসজিদ মার্কেট দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কেন মসজিদের জায়গা দখল করব।

পাবলিক টয়লেট দখলের বিষয়ে তিনি বলেন, ডিএনসিসির ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের সকল জনগণই আমার। তবে কেউ আমার কথা বলে অপকর্ম করলে তার দায় তো আমি নিতে পারি না।

তিনি বলেন, বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থীরা আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে। তারা সাংবাদিকদেরও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছে। যার সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads