• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯
চীনা ও ইউরো প্রকল্প থেকে সুবিধা চায় বাংলাদেশ

‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ (ওবিওআর)

ছবি : ইন্টারনেট

যোগাযোগ

চীনা ও ইউরো প্রকল্প থেকে সুবিধা চায় বাংলাদেশ

  • আহমদ আতিক
  • প্রকাশিত ০৭ অক্টোবর ২০১৮

বিশ্বজুড়ে প্রভাব বাড়ানোর উচ্চাভিলাষী চীনা প্রকল্প ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ (ওবিওআর)। ২০১৩ সালে শুরু হওয়া চীনা এ প্রকল্পের নজরে সারা বিশ্ব। এশিয়ার অনেক দেশ এখন এ প্রকল্পের ঋণের আবর্তে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশও চীনা ভূ-কৌশলগত এ বলয়ে।

চীনা এ প্রকল্পের বিপরীতে ‘নতুন এশিয়া কৌশল’ আনার পরিকল্পনা নিয়েছে ইউরোপ। ওবিওআর প্রকল্পের কার্যক্রম শুরুর ৫ বছর পর আগামী ১৮-১৯ অক্টোবর ব্রাসেলস বৈঠকে নতুন এশিয়া কৌশল চূড়ান্ত করবে ইউরোপ জোট। ইউরো প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য হবে কর্মসংস্থান তৈরি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের অগ্রগতি নিশ্চিত করা।

চীন ও ইউরোপের দুই প্রকল্প থেকে সুবিধা পেতে আগ্রহী বাংলাদেশ। এ লক্ষ্যে পররাষ্ট্রনীতিতে অগ্রাধিকারের নীতি নেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ইউরোপের সঙ্গে যোগাযোগ আরো বাড়ানোয় দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য খাতে যোগাযোগ বাড়ছে। বিপরীতে ইইউ, রাশিয়া এবং ব্রিটেনের পক্ষ থেকেও বাংলাদেশকে দেওয়া হচ্ছে বিশেষ গুরুত্ব। রোহিঙ্গা সঙ্কট এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামনে নিয়ে এসেছে বড় সুযোগ।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী এ নিয়ে বাংলাদেশের নীতিগত অবস্থান খোলামেলা করে বলেছেন। সম্প্রতি পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক একটি সেমিনারে তিনি  বলেন, পরিবর্তিত ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা আট দফা অগ্রাধিকারভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছি। বাংলাদেশের প্রথম অগ্রাধিকার নীতি হচ্ছে, ইউরোপের সঙ্গে যোগাযোগ আরো বৃদ্ধি করা। অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বিষয়ে তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগও বাড়ছে।

সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয় নীতি থাকলেও নেওয়া হয়েছে নতুন অগ্রাধিকারমূলক পররাষ্ট্রনীতি। যার মূলে রয়েছে ইউরোপের সঙ্গে যোগাযোগ আরো বৃদ্ধি করা। এ কারণেই রাশিয়া, ব্রিটেন ও ইইউর সঙ্গে অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য খাতে যোগাযোগ বাড়ছে। বিপরীতে ইইউ, রাশিয়া এবং ব্রিটেনের পক্ষ থেকেও বাংলাদেশকে দেওয়া হচ্ছে বিশেষ গুরুত্ব। রোহিঙ্গা সঙ্কট এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামনে নিয়ে এসেছে বড় সুযোগ।

ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী দেশ রাশিয়ার সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়ন করছে বাংলাদেশ। দেশটির উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল নিয়মিত বাংলাদেশ সফর করছে। এজন্য কখনো কখনো বাংলাদেশ পুরনো মিত্র মার্কিন শিবিরের বাইরেও অবস্থান নিচ্ছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রাশিয়ার সঙ্গে ক্রিমিয়ার একীভূত হওয়ার বিরোধিতা করে আনা প্রস্তাবে বাংলাদেশ ভোটদানে বিরত থাকে। এ নিয়ে ঢাকাস্থ সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা প্রকাশ্যেই বাংলাদেশের ভূমিকার সমালোচনা করেন। বিপরীতে ধন্যবাদ জানায় রাশিয়া। একইভাবে পূর্ব ইউরোপের দেশ কসভোকে গত বছর স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশ। এ ক্ষেত্রেও ধীরে চলার নীতি অনুসরণ করে ঢাকা। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও অস্ত্র সহযোগিতা চুক্তির মাধ্যমেও রাশিয়ার সঙ্গে শুরু হয়েছে বন্ধুত্বের নতুন যুগ। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের ৫ বছর মেয়াদি অস্ত্র চুক্তির পরিমাণ এক বিলিয়ন বা ১০০০ মিলিয়ন ডলারের। আরেকটি আলোচিত চুক্তি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। ২০২০ সালের আগেই রাশিয়ান দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ এ কেন্দ্রটি থেকে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়ার আশা করছে। গ্যাস উত্তোলনে এরই মধ্যে রাশিয়া সহযোগিতা শুরু করেছে। বঙ্গোপসাগরের বিশাল অঞ্চলে ব্লু ইকোনমিতেও রুশ সহায়তা নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

অন্যদিকে বাংলাদেশের ওপর কার্গো বিমানে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল ব্রিটেন। কিছুদিন পর ওই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারও করে তারা।

বাংলাদেশ এবং যুক্তরাজ্য এখন উভয়ই নিজেদের সম্পর্ক বৃদ্ধি চায়। সাবেক ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন সম্প্রতি ঢাকা এসে বেক্সিট-পরবর্তী সম্পর্ক এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশকে সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করে যান।

সাম্প্রতিক কূটনৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমও বিসের সেমিনারে বলেন, আমরা সহনশীল পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে এগোচ্ছি, এটা আমাদের জন্য ভালো দিক। বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে কেউ খুশি কিংবা নাখোশ হলো তা নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০২১ নয়, ২০৪১ সালের মাইলফলকে এগোচ্ছে। সেজন্য ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় পররাষ্ট্রনীতিতে কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। যার মধ্যে জিএসপি, এফটিএ ও ব্লুু ইকোনমি উল্লেখযোগ্য।

ইউরোপের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক এবং কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে ইউরোপের অর্থনৈতিক সহযোগিতা তো বরাবরই শক্তিশালী ছিল। এখন রোহিঙ্গা নিয়ে মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রে তারা আমাদের সহায়তা করছে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের পক্ষে বন্ধু ও মতামত তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।’

শুধু পশ্চিম ইউরোপই নয়, পূর্ব ইউরোপও রয়েছে বাংলাদেশের পরিকল্পনায়। গত ২ বছরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং সচিব অধিকাংশ ইউরোপের দেশ সফর করেছেন। নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের পর বাংলাদেশের ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-এর বাস্তবায়ন এবং ব্লু ইকোনমিকে গুরুত্ব দিয়ে এগোচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ২০২১-২২ সালের জন্য অস্থায়ী সদস্য পদে বাংলাদেশের সমর্থন পেতে মরিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশ এস্তোনিয়া। বিনিময়ে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দেশটির জোরালো সমর্থন চায়।

চীনের ওবিওআর প্রকল্পের সঙ্গেও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো আছে বাংলাদেশ। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চীনা বিনিয়োগ প্রস্তাব ব্যবহারের অপেক্ষায় রয়েছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে ইউরোপের ‘নতুন এশিয়া কৌশল’ আশার আলো হয়ে দেখা দিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য।

ইইউর কূটনৈতিক প্রধান ফেডেরিকা মোঘেরিনি এএফপির সঙ্গে এ বিষয়ে বলেন, কয়েক মাস ধরে এশিয়ার নেতাদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। ইউরোপের নতুন কৌশল বাস্তবায়নে তারা আগ্রহী। ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট জ্যঁ ক্লদ জাঙ্কারও চীনা প্রকল্পের বিরোধী।

কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলেন, ইউরোপের শুধু অর্থনৈতিক নয়, তাদের আরো কিছু প্রায়োরিটিজ আছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের পাশাপাশি শান্তি, গণতন্ত্র, মানবাধিকারের মতো বিষয়েও তাদের একটা প্রাধান্য আছে। তবে আমরা সম্পর্কটায় যদি সত্যি সত্যি নতুন গতি এবং মাত্রা দিতে চেষ্টা করি তবে উপরোক্ত বিষয়েও আমাদের আরো মনোযোগী ও তৎপর হতে হবে। এতে বাংলাদেশ এবং ইউরোপ উভয়েরই লাভ হবে।

বাংলাদেশের সম্ভাবনা নিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ তো বিভিন্ন সামাজিক ক্ষেত্রে একটি মডেল হিসেবে ইতোমধ্যেই আবির্ভূত হয়েছে। তারাও বাংলাদেশের এই বিষয়টি উন্নয়নশীল অনেক দেশের কাছে মডেল হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। আর সামগ্রিকভাবে বিশ্বের বড় অর্থনীতি ইউরোপেরই। কাজেই এখানে আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির একটা বড় জায়গা রয়েছে। কিন্তু এটাকে সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগাতে হলে আমাদেরও অভ্যন্তরীণ কিছু সংস্কার করতে হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads