২১ ফেব্রুয়ারি রোববার দুপুর। ছুটির দিন। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে ফাঁকা। আর বিশাল এ রাস্তা ফাঁকা পেয়েই বেপরোয়া গতিতে চলছিল মোটরসাইকেল। দুই মোটরসাইকেলে চার বন্ধু এমন ফাঁকা রাস্তা পেয়ে শুরু করে গতির প্রতিযোগিতা। কিন্তু তীব্র গতিতে ছুটে চলা একটি মোটরসাইকেলকে আর নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। পদ্মা সেতুর টোল প্লাজার কাছে বিআরটিসি বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ। মুহূর্তেই ঝরে যায় দুটি তরুণ প্রাণ।
নিহতরা হলেন শরীয়তপুর জেলার জাজিরা থানার জয়নগর গ্রামের সাত্তার বাঘার ছেলে সুজন বাঘা (২৭) এবং একই গ্রামের কাদির হাওলাদারের ছেলে ফরমান আলী (২০)। হাসাড়া হাইওয়ে থানার ইনচার্জ আবজাল হোসেন জানান, ঢাকা থেকে দুটি মোটরসাইকেলে চারজন শরীয়তপুর যাচ্ছিল। গতকাল বেলা একটার দিকে এক্সপ্রেসওয়ের পদ্মা সেতুর টোল প্লাজার কাছে পৌঁছলে একটি মোটরসাইকেলের সঙ্গে বিপরীত দিকে থেকে আসা বিআরটিসি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।
ঢাকা-মাওয়া রোডের শুধু এ ঘটনাই নয়। রাজধানীসহ সারা দেশেই বেপরোয়া মোটরসাইকেলে ঝরে যাচ্ছে তরুণ প্রাণ। সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলার সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। প্রতিদিন বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এতে অকালে ঝরে যাচ্ছে তাজা প্রাণ।
গত শনিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় এক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন তিনজন, আহত হয়েছেন একজন। এর আগের দিন এক দুর্ঘটনায় তিন কিশোরের প্রাণ যায়। মাত্র দুদিনে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, গাইবান্ধা ও ময়মনসিংহে মারা গেছেন নয়জন। এদের বেশির ভাগই তরুণ।
এদিকে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ অতিরিক্ত গতি, বেপরোয়া চালনা। এছাড়া মোটরসাইকেল চালনায় সঠিক প্রশিক্ষণ না থাকা, সড়ক আইন না মানা কিংবা না জানা, লাইসেন্স না থাকা, চ্যালেঞ্জ নিয়ে সড়কে কসরত দেখানো এবং রাজনৈতিক পরিচয়সহ বিভিন্নভাবে আইন ভাঙার কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন জেলায় চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ১৫৬টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছে ১৬৮ জন। সড়কে আশঙ্কাজনক হারে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার বিষয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বর্তমানে ভয়াবহ অবস্থা ধারণ করেছে। দেশে যে হারে যার-তার হাতে মোটরসাইকেল ব্যবহূত হচ্ছে, তাতে এই প্রবণতা আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করেন তিনি।
ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ, অপ্রাপ্ত বয়স্কদের হাতে মোটরসাইকেল আর প্রশিক্ষণ না থাকার কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে বেশি। এ ছাড়া দেশে মোটরসাইকেলের রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে এবং তারা বেপরোয়াভাবে রাস্তায় চলাফেরা করে। এতে নিজেরা দুর্ঘটনায় পড়ে এবং অন্যকেও ফেলে। সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সাইদুর রহমান আরো বলেন, সম্প্রতি মোটরসাইকেল বিক্রির ক্ষেত্রে সিসি বা গতিসীমা উঠিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। বলা যায়, একেবারে বেপরোয়া হয়ে যাবে।
মোটরসাইকেল নিয়ে বেপরোয়া কিশোর-তরুণরা একদমই ট্রাফিক আইন জানে না কিংবা মানে না। মোটরসাইকেল বিক্রির ক্ষেত্রে যেসব নিয়ম আছে সেগুলোও মানা হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঠিক মনিটরিং না থাকা, ট্রাফিক আইন ভাঙলে মোটরসাইকেল চালককে আইনের আওতায় আনার ক্ষেত্রে অবহেলাই অনেক দুর্ঘটনার কারণ।
সাইদুর রহমান বলেন, প্রায়ই দেখা যায় অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় অনেক তরুণ মোটরসাইকেল নিয়ে ব্যস্ত রাস্তায় বাস-ট্রাক কিংবা প্রাইভেট কারের ফাঁক-ফোকর গলে ছুটতে থাকে। মহাসড়কগুলোতে গতিসীমা বাড়িয়ে কসরত করতে থাকে। ওভারটেক করতে মজা পায়। এসব ক্ষেত্রে একটু বেখাল কিংবা মুহূর্তের জন্য সাইকেলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার বেশি হওয়ার কারণ হেলমেট না পরা। কিংবা নিম্নমানের হেলমেট ব্যবহার।
করোনার সময়ে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখ করে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক বলেন, গণপরিবহনের উন্নয়ন না হওয়ায় মোটরসাইকেলের ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে। মানুষ নিজের গন্তব্যে যানজট এড়িয়ে সহজে গন্তব্যে পৌঁছাতে এখন মোটরসাইকেল বেছে নিচ্ছে। এর কারণেই মোটরসাইকেলের সংখ্যা বেড়ে গেছে। মানুষ খুব দ্রুত তার গন্তব্যে পৌঁছাতে চায় কিন্তু সে ক্ষেত্রে যানজট ও গণপরিবহন নেই। ফলে সেই সুযোগটি সবাই নিচ্ছে।
দুর্ঘটনা রোধ ও যানজটমুক্ত করতে করণীয় সম্পর্কে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, যানজট এবং দুর্ঘটনা রোধ করতে গেলে অনেক বিষয় চলে আসে। ব্যক্তিগত গাড়ির লাগাম টানতে হলে সবার আগে গণপরিবহনের উন্নয়ন করতে হবে। গণপরিবহনের উন্নয়ন করলে যারা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে তারা গণপরিবহনে যাতায়াত করবে। কিন্তু গণপরিবহনের উন্নয়ন না হলে তারা তো সেই কাজটি করবে না।
ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. কুদরত-ই-খুদা বলেন, রাস্তায় আইনের সঠিক প্রয়োগ হওয়া দরকার। শুধু আইন প্রয়োগ না হওয়ার কারণে দূর্ঘটনা কমছে না। তিনি বলেন, এই তরুণরা এত বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালায় আবার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে এর মূল কারণ হলো আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়া।
তিনি আরো বলেন, যদি ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ থাকতো পাশাপাশি রাস্তায় দায়িত্বরত পুলিশ বেপরোয়া গাড়ি চালানো দেখামাত্রই তার জরিমানা তাহলে রাস্তায় বেপরোয়া কোনো যানবাহন থাকত না।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, তরুণদের মধ্যে গতিতে বাইক চালানোর যে প্রবণতা এটি কমিয়ে নিয়ে আসতে হবে। আমরা ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে অনেক সচেতনতামূলক লিফলেট, ব্যানার তৈরি করে জনগণের মাঝে বিতরণ করি। এছাড়া দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে জনগণকে জানিয়ে সচেতন করার চেষ্টা করি।
তিনি আরো বলেন, ঢাকা শহরের ট্রাফিক বিভাগের প্রতিটি চেক পয়েন্টে মোটরসাইকেলের অতিরিক্ত গতি দেখলেই আমরা তাকে নিবারণের চেষ্টা করি। এছাড়া লাইসেন্সসহ অন্যান্য কাগজপত্রও চেক করা হয়। লাইসেন্স না থাকলে জরিমানা করা হয়। শুধু বাইক নয়, অন্যান্য যানবাহনের চালকদের অতিরিক্ত গতিতে না চালাতে আমরা উৎসাহিত করি।