• মঙ্গলবার, ৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪২৯
ইমরানের কৌশলে বিব্রত মোদি

ভারত ও পাকিস্তানের পতাকা

ছবি : সংগৃহীত

এশিয়া

ইমরানের কৌশলে বিব্রত মোদি

  • মোমেনা আক্তার পপি
  • প্রকাশিত ০৫ মার্চ ২০১৯

কাশ্মির ইস্যুতে প্রতিবেশী ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত যুগের পর যুগ ধরে চলে এসেছে। এ নিয়ে উভয় দেশের রাজনীতিবিদরা ফায়দা তোলার চেষ্টা বরাবরই করে গেছেন। তবে পুলওয়ামা হামলাকে কেন্দ্র করে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক খেলায় নিজ দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের কৌশলের কাছে বিব্রত হচ্ছেন।

পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানে বিমান হামলা-পাল্টা হামলা ও পাইলট অভিনন্দনকে ইস্যু করে মোদি আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে চেয়েছিলেন। এমনকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তানকে একঘরে করার চেষ্টায়ও লিপ্ত হন। কাশ্মিরের উভয় সীমান্তে যুদ্ধের উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে বিশ্ব। উভয়পক্ষকে শান্ত থাকার কথা বলে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানান বিশ্বনেতারা। কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হতে থাকে। এরমধ্যে গত বুধবার পাকিস্তানে আটক হয় ভারতীয় পাইলট অভিনন্দন বর্তমান। এ নিয়ে পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হবে- এমনটাই আশঙ্কা করা হচ্ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের একটি কথা মোদির সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিল।

মুক্তি- এই শব্দের জোর যে কত বেশি তা আবারো প্রমাণ হলো। অভিনন্দনকে মুক্তি দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে প্রায়ই যুদ্ধ বেধে যাওয়া পরিস্থিতিকে পাল্টে দিলেন ইমরান। ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিতে আসা ইমরান শুরু থেকেই ইস্যুটিকে খুবই ঠান্ডা মাথায় সামাল দেন। ভারতীয় পাইলটকে মুক্তি দেওয়ার পাশাপাশি আলোচনার আহ্বান জানিয়ে বিশ্বের দরবারে প্রশংসিত হন তিনি। এই সিদ্ধান্তের জন্য ইমরান খানকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার প্রবল দাবি ওঠে। পাকিস্তান পার্লামেন্টে এ নিয়ে একটি প্রস্তাবও উপস্থাপন করেন দেশটির তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী। তবে এ প্রসঙ্গে ইমরান খান বলেন, তিনি এই পুরস্কারের যোগ্য নন।

গতকাল সোমবার সকালে নিজের ৯০ লাখ ফলোয়ারের উদ্দেশে ইমরান টুইটে লেখেন, কাশ্মিরিদের  ইচ্ছা মেনে যিনি সমস্যার সমাধান করতে পারবেন এবং উপমহাদেশে উন্নয়ন ঘটাতে পারবেন, সেই ব্যক্তিই এই পুরস্কার পাওয়ার জন্য যোগ্য। পাকিস্তানের পার্লামেন্টে ইমরানকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার প্রস্তাবে বলা হয়, ইসলামাবাদ ও দিল্লির মধ্যে উত্তেজনা নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে তীক্ষ বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।  তাকে নোবেল দেওয়ার দাবিতে এক অনলাইন প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেছে ৩ লক্ষাধিক মানুষ। তাদের দাবি দুটি দেশের মধ্যে চলমান উত্তেজনা প্রশমনে সাবেক এই ক্রিকেটার দুর্দান্ত এক ভূমিকা পালন করেছেন।

এদিকে পাকিস্তানের জঙ্গি ঘাঁটিতে বিমান হামলা অব্যাহত থাকবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন ভারতের বিমানবাহিনী প্রধান বীরেন্দ্র সিংহ ধানোয়া। গতকাল সোমবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এই ইঙ্গিত দেন। পাকিস্তানের পাল্টা আঘাতে ভেঙে পড়া ভারতের মিগ-২১ জঙ্গি বিমান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি চলতে থাকা অপারেশনের ব্যাপারে কিছু বলব না। তার এই কথার পর থেকেই সর্বত্র আলোচনা শুরু হয়েছে বালাকোটের মতো পাকিস্তানের মাটিতে থাকা জঙ্গি শিবিরে ফের বিমান হামালার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিমানবাহিনী।

এরআগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও একই রকম ইঙ্গিত দেন। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান পার্লামেন্টে আটক ভারতীয় অভিনন্দন বর্তমানকে মুক্তি দেওয়ার ঘোষণা দেন তখন মোদি বালাকোট বিমান হামলাকে ‘পাইলট প্রোজেক্ট’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আগেরটা ছিল অনুশীলন। এবার হবে আসল হামলা। আসল হামলা বলতে তিনি কি বুঝিয়েছেন তা এখনো বিশেষজ্ঞদের কাছে স্পস্ট নয়। কারণ বালাকোটে হামলায় ৩০০ জঙ্গি নিহতের যে দাবি করেছে ভারত তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। বিরোধী দলগুলো বার বার এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। এ নিয়ে তথ্য-প্রমাণ দাবি করেছে তারা। চাপের মুখে বিমান হামলায় নিহত জঙ্গির সংখ্যা থেকে অবশেষে সরে এসেছে নয়াদিল্লি। বিজেপির সংসদ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এসএস অহলুওয়ালিয়া এ ধরনের দাবির জন্য দেশটির গণমাধ্যমকেই দায়ী করেছেন।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী মোদি কিংবা সরকারি মুখপাত্রের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু জানানো হয়নি। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে এগুলো ছড়ানো হয়েছে। পাকিস্তানকে বার্তা দিতেই নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে বিমানবাহিনী সেখানে বোমা ফেলে বলেও দাবি করেন তিনি। তার মতে, পাহারা টপকে শত্রুর বাড়ির পাশে বোমা ফেলেছি ঠিকই, তবে এতে সাধারণ মানুষের প্রাণহানি হোক তা চাইনি। তাদের একটা কড়া বার্তা দেওয়াই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য। তারা যেন  বুঝতে পারে শত্রুপক্ষকে ধ্বংস করে দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের আছে। তবে যতই সাফাই গাইতে থাকুক এটা সবাই বুঝে গেছে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই মোদি সরকারের।

পাকিস্তানের সঙ্গে এখনই আলোচনায় বসতে রাজি নয় বলে আগেই জানিয়েছে ভারত। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পাকিস্তান কী পদক্ষেপ গ্রহণ করে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই আলোচনায় বসার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানায় নয়াদিল্লি। সীমান্তে উত্তেজনা কমে এলেও কাশ্মির নিয়ে সঙ্কটে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মধ্যে কৌশলের লড়াইয়ে আসলে কে জিতলেন তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করছে সাধারণ মানুষ। এ বিষয়ে ভারতের সাবেক কূটনীতিক এবং কৌশলগত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কে সি সিং বলেন, মোদির বিজেপি দলের কট্টরপন্থি এবং ভারতীয় প্রশাসনের জন্য ‘ইমরান খানের কূটনৈতিক রিভার্স সুইংয়ের  জবাব দেওয়া কঠিন হবে। ইমরান খান ক্রিকেট জীবনে বিশ্বের প্রথম সারির একজন খেলোয়াড় ছিলেন। তাই এ কাজে তিনি যথেষ্ট পারদর্শী।

২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে মোদি এমন একটি ভাবমূর্তি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন যে, তিনি তার বক্তব্য থেকে নড়েন না। আর স্থানীয় গণমাধ্যমে তার জাতীয়তাবাদী ভাবমূর্তিকে আনুগত্যের সঙ্গে উজ্জীবিত রেখেছে তার সমর্থকদের বড় একটা অংশ। ভারত একটা ক্রান্তিকালে এসে দাঁড়িয়েছে এবং পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আশু যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে কি না এ নিয়ে জল্পনা তৈরি হয়েছে। এমন পটভূমিতে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে- মোদি নিজে কেন জাতির উদ্দেশে বক্তব্য না রেখে তার আমলা ও সেনাবাহিনীকে দিয়ে কথা বলাচ্ছেন। ভারতের বড় বিরোধী দলগুলোর মধ্যে অন্তত ২১টি মোদির কড়া সমালোচনা করে বলছে তার শাসনামলে ভারতে সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা সঙ্কট চলছে। এমন সময় মোদি তার নির্বাচনী জনসভা, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এমনকি মোবাইল অ্যাপ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে হাজিরা দেওয়া থামাননি। অনেকেই বলছেন, পাকিস্তান দ্রুত পাল্টা হামলা চালিয়ে ভারতের জঙ্গি বিমান ভূপাতিত করে এবং বিমানের পাইলটকে আটক করে মোদিকে কোণঠাসা করে দিয়েছে।

পাইলটকে বন্দি করার দুদিনের মধ্যেই ইমরান বৈরিতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। শান্তির কথা বলেছেন এবং পাইলটকে মুক্তি দিয়েছেন। কে সি সিং বলেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিজের ‘একটি সম্মানজনক ইমেজ তৈরি করেছেন এবং তিনি আলোচনার মাধ্যমে বিবাদ মীমাংসার জন্য তৈরি- এমন একটি ভাবমূর্তি তুলে ধরেছেন। ভারতীয় পাইলটকে ফিরিয়ে দেওয়ার ইমানের সিদ্ধান্ত সবাইকে অবাক করেছে। ইমরান তার দেশের জনগণের উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি তার প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং গণমাধ্যমকে সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে নিয়মিত অবহিত করেছেন। বিশ্লেষকদের মতে, ইমরান নিজেকে একজন গ্রহণযোগ্য নেতা হিসেবে প্রমাণ করেছেন, যিনি ভারতকে কোণঠাসা করার চেষ্টা না করে বৈরিতা বন্ধের প্রস্তাব দিয়েছেন।

অপরদিকে, মোদির অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ঐতিহাসিক ও লেখক শ্রীনাথ রাঘাবান বলেন, যেভাবেই দেখার চেষ্টা করুন না কেন, পাকিস্তানের পাল্টা হামলায় ভারত হতচকিত হয়ে পড়েছে। পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলার পর ভারত রাতের অন্ধকারে প্রতিশোধমূলক হামলা চালায়। পাকিস্তান জবাব দেয় দ্রুত এবং সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে পরের দিনই প্রকাশ্য দিবালোকে। অভিনন্দন ধরা পড়ার ঘটনা যেহেতু ছিল অপ্রত্যাশিত, তাই মোদি ও তার সরকারকে দেখা যায় ভিন্ন সুরে কথা বলতে। তখন তাদের কাছে মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায় পাইলটকে ফিরিয়ে আনা। পাকিস্তানের পাল্টা হামলার পর সেনাবাহিনী তাদের ব্রিফিং দেয় ৩০ ঘণ্টা পর। মোদি ও তার সরকারের ব্যাখ্যা দেওয়ার জায়গাটা ছিল খুবই সীমিত।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads