• সোমবার, ৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪২৯

এশিয়া

জান্তা সরকারকে অর্থনৈতিক চাপ

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত ২১ মার্চ ২০২১

জান্তা সরকারবিরোধী বিক্ষোভ দমাতে প্রতিনিয়ত গুলি চালিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। গত ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে তারা ২০০ জনেরও বেশি বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ ভুক্তভোগীকে হত্যা করা হয়েছে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ করার সময় দূর থেকে মাথায় গুলি করে। বাকিদের প্রাণ গেছে অভ্যুত্থানবিরোধী সন্দেহে সেনাদের বেপরোয়া গুলিতে। এরপরও হাল ছাড়েননি মিয়ানমারের বিক্ষোভকারীরা। তারা জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন। এর সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে অর্থনৈতিক চাপ। খবর দ্য ইকোনমিস্টের।

মোবাইল ইন্টারনেট সেবা পুরোপুরি বন্ধ এবং বিভিন্ন অঞ্চলে সামরিক আইন জারির পরও বিক্ষোভ হয়েছে ইয়াঙ্গুন ও মান্দালয় শহরে। তবে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলছে কার্যত গোটা মিয়ানমারেই। আগে যেসব ফ্রিজ মিয়ানমারে বিয়ারের ক্যান দিয়ে ভরা থাকত, এখন সেগুলো খালি। এর একমাত্র কারণ, পানীয়টির প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের আংশিক মালিকানা দেশটির সেনাবাহিনীর হাতে। জনপ্রিয় একটি সিগারেট ব্র্যান্ড, একটি বৃহৎ মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে উঠেছে বয়কটের সুর। এ ছাড়া সেনাশাসনের প্রতিবাদে ধর্মঘটে গেছেন বহু সরকারি কর্মকর্তা। এগুলোর মাধ্যমে জান্তা সরকারকে অর্থনৈতিকভাবে চাপে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে।

বেশ কিছু ঘটনায় বোঝা যাচ্ছে, মিয়ানমারের সেনাশাসকরা অর্থসংকটে ভুগছেন। অভ্যুত্থানের কয়েকদিন পরেই দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে এক বিলিয়ন ডলার ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। তবে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন মিয়ানমার সেনাদের সেই প্রচেষ্টা আটকে দেয়। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি জান্তা সরকার ২০০ বিলিয়ন কিয়াট (মিয়ানমারের মুদ্রা) পাঁচ বছর মেয়াদি বন্ড বিক্রি করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা পায় মাত্র ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন কিয়াট, তাও স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক চড়া সুদে।

আন্তর্জাতিক মুদ্র তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে, মিয়ানমারের বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৬ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার, এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে আটকে যাওয়া এক বিলিয়ন ডলারও রয়েছে। এই অর্থ দিয়ে খুব বেশি হলে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। গুরুত্বপূর্ণ পণ্যগুলোর মধ্যে মিয়ানমার জ্বালানি ও রান্নায় ব্যবহূত সব তেলই বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকে। এসব পণ্যের দাম ইতোমধ্যে বেড়ে গেছে, অন্যদিকে কিয়াটের মান কমছে। বিদেশি বিনিয়োগেও পড়েছে বিক্ষোভ-সহিংসতার প্রভাব। সম্প্রতি মিয়ানমারে একাধিক চীনা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় কিছু বিনিয়োগকারী পিছু হটবে বলে মনে করা হচ্ছে।

মিয়ানমারের জান্তা সরকারের জন্য বৈদেশিক অর্থই একমাত্র দুর্বলতা নয়। সেনা অভ্যুত্থানের আগেই বিশ্বব্যাংক জানিয়েছিল, এ বছর দেশটিতে জিডিপির ৮ দশমিক ১ শতাংশ বাজেট ঘাটতি দেখা যেতে পারে। এরপর গণবিক্ষোভে তাদের অর্থনীতি এক প্রকার গতিশূন্যই হয়ে পড়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী বা তাতমাদাও নিয়ন্ত্রিত প্রধান সংস্থা মায়ানমা ইকোনমিক হোল্ডিংস লিমিটেড (এমইএইচএল) দেশটির বৃহত্তম করদাতা, তাদেরই অঙ্গপ্রতিষ্ঠান মিয়াওয়াদি ব্যাংক এ ক্ষেত্রে পঞ্চম। বর্তমানে তারা উভয়ই জনতার বয়কট আন্দোলনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তু। ফলে দেশটির ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ঘাটতি পূরণ ধীরে ধীরে আরো কঠিন হয়ে উঠছে।

এসব পরিসংখ্যান যথেষ্ট উদ্বেগজনক। সাধারণ সরকার হলে এর জন্য অবশ্যই কর্মপন্থা পরিবর্তন করত। তবে জান্তা সরকার তেমন কোনো সাধারণ সরকার নয়। মিয়ানমার এমনিতেই কর সংগ্রহের চেয়ে তেল-গ্যাস বিক্রি করেই বেশি অর্থ আয় করে। তাতমাদাও দীর্ঘদিন থেকেই অবৈধ চাঁদাবাজি এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে রত্ন ও কাঠ পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। বলা হয়, তারা মেথামফেটামাইনের মতো মাদক ব্যবসায় সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তা দিয়ে থাকে, বিশেষ করে নিরপেক্ষ সীমান্ত এলাকাগুলোতে। এমনকি দেশটির সেনাবাহিনী নিজেদের সদস্যদের কাছ থেকেই জোরপূর্বক অর্থ আদায় করে।

২০১৮ সালে ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের জেরাল্ড ম্যাকার্থিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মিয়ানমার সেনারা জানিয়েছিলেন, বেতনের ১০ থেকে ২৫ শতাংশ এমইএইচএলের শেয়ারে ব্যয় করার নির্দেশ রয়েছে তাদের ওপর। বর্তমান সংকটময় মুহূর্তে জান্তা সরকার এসব পদ্ধতিতে অর্থসংগ্রহ দ্বিগুণ করার চেষ্টা করতে পারে। তা ছাড়া দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজানো নিয়েও খুব একটা মাথাব্যথা নেই তাতমাদাওয়ের। যারা নিজেদের জনগণের ওপর গুলি চালাতে পারে, তারা জনসেবা কার্যক্রম সীমিত হয়ে যাওয়া নিয়ে চিন্তায় পড়বে, এমনটা ভাবা বাহুল্য। মুদ্রাস্ফীতির কী অবস্থা হবে তা হিসাব না করে জান্তা সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অর্থ ছাপানোরও নির্দেশ দিতে পারে।

জনতার বিক্ষোভের কারণে একদিক থেকে লাভও হচ্ছে মিয়ানমার সেনাদের। এক কাস্টমস কর্মকর্তা ফ্রন্টিয়ার নামে একটি স্থানীয় সাময়িকীকে জানিয়েছেন, বিক্ষোভের মধ্যে দেশটিতে মাত্র একটি প্রতিষ্ঠানের কন্টেইনার ট্রাক চলাচল করছে, আর সেটির মালিক সেনানিয়ন্ত্রিত এমইএইচএল। এসব ট্রাক প্রতি ট্রিপের জন্য ৮০ হাজার কিয়াট নিচ্ছে, যা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে আটগুণ বেশি।

অবশ্য কিছু লক্ষণ রয়েছে যেগুলোতে মনে হয়, জান্তা সরকারের দুশ্চিন্তাও কম নয়। তারা আমদানি করা তেলের ওপর নির্ভরতা কমানোর উপায় খুঁজতে সম্প্রতি একটি কমিটি গঠন করেছে। কর্মী ধর্মঘটের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া ব্যাংকের সংখ্যা বাড়তে থাকাও সেনাশাসকদের কপালে ভাঁজ ফেলেছে। এধ রনের কর্মীদের কাজে ফেরাতে জান্তা সরকার কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে, অবশ্য তাতে এখন পর্যন্ত খুব একটা লাভ হয়নি। সম্প্রতি দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০০ কর্মকর্তাকে অনুপস্থিতির কারণে বরখাস্ত করা হয়েছে।

এতকিছুর পরেও মিয়ানমার সেনারা পথ বদলাবেন কি না তা অনিশ্চিত। তবে এতে যে দেশটির অর্থনীতির বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ ক্ষেত্রে ক্ষতি যা হওয়ার হবে সাধারণ নাগরিকদেরই, জান্তা ও এর মিত্রদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা কম। এটি আরো একটা বিষয় মনে করিয়ে দেবে তা হচ্ছে, এর আগেও একাধিকবার মিয়ানমারের অর্থনীতি ধুলায় মিশিয়ে দিয়ে গেছেন দেশটির সেনাশাসকরা।

ইইউর নিষেধাজ্ঞায় ১১ কর্মকর্তা : মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভে সহিংস ভূমিকা রাখায় দেশটির ১১ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এ বিষয়ে আগামীকাল (সোমবার) বৈঠকে বসবেন ইইউভুক্ত ২৭টি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। ইইউর কয়েকজন কূটনীতিক বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বলে গতকাল আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির সেনাবাহিনী ও এর অর্থনৈতিক স্বার্থের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে গত মাসে একমত হয় ইইউ। এরই অংশ হিসেবে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে তৎপর হয়েছে ২৭টি দেশ নিয়ে গঠিত জোট। ইইউর এক কূটনীতিক বলেন, মিয়ানমারের ১১ সামরিক ও পুলিশ কর্মকর্তার সম্পদ জব্দ ও ভিসা বন্ধের বিষয়ে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে বৈঠকে বসবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। মিয়ানমারের সেনা কর্মকর্তাদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ওপর শুরুতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে না। তবে পরে কয়েকটি ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে।

এদিকে মিয়ানমারের গণ-আন্দোলন দমাতে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর চলমান সহিংস কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের বিশেষ রেপোর্টিয়ার টম অ্যান্ড্রুজ। এ ছাড়া মিয়ানমারের অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া সামরিক নেতাদের অর্থ ও অস্ত্র জোগানের পথ বন্ধেরও আহ্বান জানান তিনি। এর আগে সেনাশাসনের অবসান ও নির্বাচিত নেতা অং সান সু চির মুক্তির দাবিতে মিয়ানমারের জনগণের আন্দোলন ঠেকাতে দেশটির সেনাবাহিনীর ভয়াবহ সহিংস পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads