• সোমবার, ৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪২৯
সম্পদের পাহাড় গড়েছেন পৌর মেয়র খোকন

ছবি : সংগৃহীত

সারা দেশ

সম্পদের পাহাড় গড়েছেন পৌর মেয়র খোকন

  • সোনাগাজী (ফেনী) প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ১৩ অক্টোবর ২০১৯

দায়িত্ব নেওয়ার তিন বছরের মধ্যে দুর্নীতির টাকায় সম্পদের পাহাড় গড়েছেন ফেনীর সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র রফিকুল ইসলাম খোকন। উন্নয়ন খাতের টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়ে নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। চার বছর আগে সাধারণ জীবনযাপন করলেও বর্তমানে দেড় কোটি টাকার বিলাসবহুল গাড়িতে চড়েন, জবরদখল করা জমিতে গড়ে তুলেছেন মৎস্য প্রকল্প, ঢাকায় কিনেছেন ৫ কাঠার প্লট, তিন বছরে নিজ পরিবারের নামে কিনেছেন ২৪ একর জমি। একসময় নুন আনতে পান্তা ফুরালেও বর্তমানে চালচলন আচার-আচরণে রাজকীয় ভাব দেখে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন মানুষ। পৌর মেয়র রফিকুল ইসলাম খোকনের অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেক স্ট্যাটাস দেখা গেছে যা ইতোমধ্যে ভাইরাল হয়েছে। জীবনে কখনো ছাত্রলীগ যুবলীগ না করেও রাতারাতি আওয়ামী লীগের নেতা বনে গিয়ে ২০১৩ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নেন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অভিযোগ তিনি ছাড়া তার পরিবারের অপর সদস্যরা বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতিতে জড়িত।

৮০ ভাগ বিএনপি-জামায়াত অধ্যুষিত সোনাগাজী পৌরসভায় ২০১৬ সালের মার্চ মাসের ২০ তারিখে আওয়ামী লীগের টিকিটে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর তার ভাগ্যের চাকা খুলে যায়। তার ক্যাডার বাহিনীর বিরুদ্ধে ভোটের দুদিন আগে বিএনপি প্রার্থী সাবেক মেয়র উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিন সেন্টুকে এলাকা ছাড়া করার অভিযোগ রয়েছে। দুই দফায় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ দিয়েও তার অনিয়ম ও দুর্নীতির পাগলা ঘোড়াকে থামানো যাচ্ছে না। ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর তার বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ তুলে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) প্রথম দফায় অভিযোগ দাখিল করেন পৌর কাউন্সিলর নুরনবী লিটন। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক। চলিত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে কাউন্সিলর লিটন দ্বিতীয় দফায় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন। অভিযোগের অনুলিপি স্থানীয় সরকার মন্ত্রী, ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারীসহ গুরত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তরে প্রেরণ করেন।

অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, মেয়র খোকন দায়িত্ব নেওয়ার পর পৌর কার্যালয়ে শুরু হয় লাগামহীন অনিয়ম-দুর্নীতি। নির্বাচনের সময় হলফনামায় মেয়র খোকন বসতভিটা, স্ত্রীর গহনা, ব্যাংক ব্যালেন্সসহ সর্বমোট ২০ লাখ টাকার সম্পদের হিসেব জমা দিলেও বর্তমানে তিনি নিজ নামে ১১টি দলিলে ১০ একর ও স্ত্রীর নামে ৫টি দলিলে ১৪ একর জমির মালিক। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৩৬ কোটি টাকা। দায়িত্ব গ্রহণের কয়েক মাস পর মেয়র একক সিদ্ধান্তে পৌরসভার তরকারি বাজারে নবনির্মিত ভবনের ৫২টি দোকান গোপনে ত্রুটিপূর্ণ দরপত্রের মাধ্যমে বরাদ্দ দেন। প্রতিটি দোকান বরাদ্দের সময় নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ টাকা আদায় করে দুই কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। পৌরকর আদায় করে নামে মাত্র জমা দিয়ে বিপুল টাকা আত্মসাৎ করেন। দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার আগেই কোটি টাকা ব্যয়ে পৌরসভা গেট, পৌর ভবনের সংস্কার কাজ নিজেই সম্পন্ন করে ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। স্থানীয় ব্যবসায়ী কর্তৃক নির্মিত সড়কের বিল পৌরসভা তহবিল থেকে প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি টাকায় ভাউচার করা, রাজস্ব ও এডিবি বরাদ্দ থেকে প্রাপ্ত টাকা কোনো প্রকার প্রকল্প কমিটি দরপত্র ও রেজুলেশন ছাড়া নিজেই প্রকল্পের ভাগবাঁটোয়ারা করে গত তিন বছরে ৫০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন।

এ ব্যাপারে কাউন্সিলর নুরনবী লিটন বলেন, পৌর এলাকায় ভবন নির্মাণের সময় প্রত্যেক ভবন মালিকের কাছ থেকে খোকন লাখ লাখ টাকা আদায় করে সামান্য পরিমাণ পৌর তহবিলে জমা দিয়েছেন। আমিরাবাদ ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামের সৌদি প্রবাসী রুহুল আমিনের কাছে পৌর নির্বাচনের সময় ৯ শতক জমি বিক্রি করেন খোকন। তিন বছর পার হলেও প্রবাসীকে সেই জমির দখল বুঝিয়ে না দিয়ে পেশিশক্তি প্রয়োগ করে নিজেই স্থাপনা তৈরি করে ভোগদখল করছেন। মুহুরি প্রজেক্ট এলাকায় আবদুল মান্নান নামের কৃষকের জমি দখল করে বিশাল মৎস্য খামার গড়ে তুলেছেন। দুর্নীতির টাকা দিয়ে ৩৬ কোটি টাকার জমি ক্রয় করা ছাড়াও ঢাকার উত্তরায় রাজউকের ৫ কাঠার প্লট রয়েছে তার।

পৌরসভাকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন রফিকুল ইসলাম খোকন। কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে আমাদের অন্ধকারে রেখে যাবতীয় অপকর্ম করছেন। পৌরসভায় গত তিন বছরে একটি মিটিং হয়নি। তার ইচ্ছেমতো রেজুলেশন তৈরি করে যাবতীয় অপকর্ম করছেন। পৌরসভার রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ তিনি গোপনে দরপত্র করে নিজের লাইসেন্স বা অনুগত ঠিকাদারদের দিয়ে নিম্নমানের কাজ করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। আমি অনেক দিন ধরে তার এসব অপকর্মের বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখছি, দুদকে অভিযোগ দিয়েছি, তারপরও তাকে থামানো যাচ্ছে না। সোনাগাজী পৌরসভায় সরকারের সব উন্নয়ন জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী রফিকুল ইসলাম খোকন। সরকারের চলমান দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে তার দুর্নীতি তদন্তের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও দলীয় নেতাদের  প্রতি আমি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।

এদিকে অনুসন্ধান করতে গিয়ে মেয়র রফিকুল ইসলাম খোকন দুর্নীতির আরো তথ্য বেরিয়ে এসেছে। পৌরসভার পানি প্লান্টানেশনের জন্য জমি ক্রয়ে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে অধিক মূল্য দেখিয়ে ৮ লাখ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে। গত ২০১৬ সালে ৫২৮৪ দলিলমূলে পৌরসভার জন্য সাতবাড়িয়া মৌজায় বাখরিয়া গ্রামের আবু সুফিয়ানের কাছ থেকে ২০ শত জমি ক্রয় করেন। সেসময় প্রতি শতক জমির মৌজা মূল্য ছিল ৪০ হাজার টাকা। মেয়র রফিকুল ইসলাম খোকন বিক্রেতা আবু সুফিয়ানের সঙ্গে জমির বায়না করার সময় উভয়ের সম্মতিতে প্রতি শতক জমি মূল্য ৪০ হাজার নির্ধারণ করে তাকে ৮ লাখ টাকা প্রদান করেন। রেজিস্ট্রি করার পূর্বে খোকন কৌশলে আবু সুফিয়ানের কাছ থেকে বায়নার কাগজপত্র নিজের হেফাজতে নিয়ে যায়। পরে জমি রেজিস্ট্রি করার সময় প্রতি শতক জমির মূল্য ৮০ হাজার টাকা উল্লেখ করে দলিলে আবু সুফিয়ানের কাছ থেকে স্বাক্ষর আদায় করেন। জমি বিক্রেতা আবু সুফিয়ান বলেন, আমাকে প্রতি শতক জমির মূল্য ৪০ হাজার টাকা বায়নামূলে ৮ লাখ টাকা প্রদান করেন। পরে দলিলের নকল তোলার পর দেখতে পাই প্রতি শতক জমির মূল্য ৮০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা আছে। আমাকে বায়না অনুযায়ী টাকা দিয়েছে, বাকি ৮ লাখ টাকা মেয়র কি করেছে সেটা জানি না।

সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান কমিটির সহসভাপতি পৌর এলাকার বাসিন্দা জসিম উদ্দিন বলেন, খোকন মেয়র হওয়ার পর থেকে পৌর এলাকায় চাঁদার কারণে মানুষ ঘর নির্মাণ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। কেউ টাকা দিতে অস্বীকার বা প্রতিবাদ করলে তার ওপর নেমে আসে মামলা হামলার খড়্গ। তিনি উড়ে এসে জুড়ে বসে, মাত্র তিন বছরে দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। দুঃসময়ে পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিটিই দলের সুসময়ে এখন বড় নেতা।

অভিযোগের বিষয়ে মেয়র রফিকুল ইসলাম খোকন ফোনে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে সরাসরি তার অফিসে সাক্ষাৎ করতে বলেন। গতকাল শনিবার দুপুরে তার বক্তব্য জানতে পৌরসভার জিরো পয়েন্টে উপজেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে গেলে তিনি অভিযোগের বিষয়ে কোনো প্রকার বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে তার বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুর্নীতির তথ্য ফাঁস হওয়ার পর তিনি একাধিকবার বিভিন্ন বক্তব্যে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে জানায়, স্বদলীয় প্রতিপক্ষরা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। তিনি কোনো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত না, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করছেন। যে জমি ক্রয়ের কথা বলা হচ্ছে তিনি ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের টাকায় সে জমি ক্রয় করেছেন। পৌরসভায় কোনো দুর্নীতি হচ্ছে না, নিয়ম মেনে সব করা হচ্ছে তাই দুর্নীতি করার সুযোগ নেই। তিনি দলে অনুপ্রবেশকারী না, দল করতে গিয়ে বহুবার মামলা হামলার শিকার হয়েছেন বলে জানান।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads