• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯
মিসওয়াকের গুরুত্ব ও ফজিলত

সংগৃহীত ছবি

সারা দেশ

মিসওয়াকের গুরুত্ব ও ফজিলত

  • প্রকাশিত ১০ ডিসেম্বর ২০২০

মিসওয়াক প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয় একটি সুন্নত। অনেক ফজিলত ও গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত এটি। আল্লাহতায়ালার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন : মিসওয়াক মুখের পবিত্রতা, রবের সন্তুষ্টির মাধ্যম। (ইবনে মাজাহ : ২৭৯)। মিসওয়াক ইসলামের উন্নত রুচি ও পরিচ্ছন্নতার পরিচায়ক। মুমিনের ভেতরটা যেমন স্বচ্ছ ও কলুষতামুক্ত থাকবে তেমনি তার বাহিরও হবে সুন্দর, পরিপাটি, পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন। পাক-পবিত্রতা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মুমিনের স্বভাবজাত রুচি-বৈশিষ্ট্যের অপরিহার্য বিষয়। হাদিস শরিফে এসেছে : দশটি বিষয় স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভুক্ত। মোচ খাটো করা, দাড়ি লম্বা রাখা, মিসওয়াক করা...। (মুসলিম : ২৬১)। হাদিসে মিসওয়াককে স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য ও গুণের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। স্বভাবজাত বিষয় তো এমন, যা জীবনের সাথে মিশে থাকে। যা ছুটে যাওয়ার মতো নয়। সাধারণ দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, মিসওয়াক একটি ছোট আমল। কিন্তু ফজিলত অনেক বেশি এবং প্রতিদান অনেক বড়” আল্লাহর সন্তুষ্টি। এর চেয়ে বড় পুরস্কার আর কী হতে পারে মুমিনের জীবনে? আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টিই তো মুমিনের সবচেয়ে বড় চাওয়া ও পরম পাওয়া। আল্লাহতায়ালা বলেন, আর আল্লাহর সন্তুষ্টি সবচেয়ে বড় বিষয়। (সুরা তাওবা : ৭২)।

মিসওয়াকের গুরুত্ব অনেক বেশি। একাধিক হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিসওয়াক করা গুরুত্বারোপ করেছেন। ওয়াসিলা ইবনুল আসকা (রা.) হতে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন : আমাকে মিসওয়াকের আদেশ দেওয়া হয়েছে। আমার আশঙ্কা হতে লাগল, না জানি তা আমার ওপর ফরজ করে দেওয়া হয়। (মুসনাদে আহমাদ : ১৬০০৭)। অন্যত্র রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : আমাকে মিসওয়াকের আদেশ করা হয়েছে। আমার ধারণা হতে লাগল, এ সম্পর্কে আমার ওপর কোরআন নাজিল হবে বা (বলেছেন,) ওহি নাজিল হবে। (মুসনাদে আহমাদ : ৩১২২)। আম্মাজান আয়েশা (রা.) বলেন : দিনে বা রাতে যখনই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘুম হতে জাগ্রত হতেন ওজুর পূর্বে মিসওয়াক করে নিতেন। (মুসনাদে আহমাদ : ২৪৯০০)। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘুমানোর সময় মিসওয়াক পাশে রাখতেন। ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে প্রথমেই তিনি মিসওয়াক করতেন। (মুসনাদে আহমাদ : ৫৯৬৯)।

মৃত্যুর আগমুহূর্তেও মিসওয়াক কর : আম্মাজান আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত- তিনি বলেন : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার ঘরে আমার ‘পালা’র দিনে এবং আমার বুকে মাথা রাখা অবস্থায় ইন্তিকাল করেন। তিনি অসুস্থ হলে আমাদের মধ্যকার কেউ দোয়া পড়ে তাঁকে ঝাড়ফুঁক করতেন। (ইন্তেকালের পূর্ব মুহূর্তে) আমি তাঁকে ঝাড়ফুঁক করছিলাম। এ সময় আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর আগমন করল। তার হাতে মিসওয়াকের একটি তাজা ডাল ছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন সেদিকে তাকালেন। আমি বুঝতে পারলাম যে, তিনি মিসওয়াকের প্রয়োজন বোধ করছেন। তখন আমি সেটি নিয়ে চিবিয়ে প্রস্তুত করে তাঁকে দিলাম। তিনি এর দ্বারা সুন্দরভাবে মিসওয়াক করলেন, যেমনটি তিনি (সুস্থতার সময়) করে থাকেন। অতঃপর তিনি তা আমাকে দিলেন। পরক্ষণই তাঁর হাত ঢলে পড়ল। আল্লাহতায়ালা আমার থুথুকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের থুথুর সঙ্গে মিলিয়ে দিলেন তাঁর এ দুনিয়ার শেষ দিনে এবং আখিরাতের প্রথম দিনে। (সহিহ বুখারি :  ৪৪৫১)। এ হাদিস থেকে বোঝা গেল প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে মিসওয়াক কী পরিমাণ প্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও এ সুন্নাহর প্রতি কেমন আকর্ষণ ও ভালোবাসা ছিল। একজন নবী প্রেমিকের এ সুন্নাহর অনুসরণ এবং নিজের জীবনে বাস্তবায়নের জন্য এর চেয়ে বড় শিক্ষা আর কী হতে পারে? আমরা তো মিসওয়াককে শুধু ওজু-নামাজের আমল মনে করে থাকি। এতেও কত উদাসীনতা লক্ষ করা যায়। অথচ প্রিয় নবীর জীবন থেকে বোঝা যায় মিসওয়াকের আমল শুধু ওজু-নামাজের সাথে সীমাবদ্ধ নয়। তবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাজের পূর্বে ওজুর শুরুতে মিসওয়াক করার বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছেন। হাদিস শরিফে এসেছে, বান্দা যখন নামাজে দাঁড়ায় সে তখন রবের সাথে কথোপকথন করে। ফেরিশতাগণ জামাতের নামাজে তার সাথে কাতারবন্দি হয়ে দাঁড়ায়। তার তেলাওয়াত খুব নিকট থেকে শোনে। এজন্য নামাজে দাঁড়ানোর পূর্বে বান্দার কর্তব্য হলো, পাকসাফ হয়ে সব ধরনের পবিত্রতা অর্জন করে নামাজে দাঁড়ানো। নোংরা ময়লা পোশাক নিয়ে দুর্গন্ধময় মুখ ও শরীর নিয়ে প্রভুর সম্মুখে দাঁড়ানো কিছুতেই কাম্য নয়।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে গুরুত্বের সাথে মিসওয়াক করেছেন, সাহাবিদের মিসওয়াকের ফজিলত ও গুরুত্বের কথা বলেছেন এবং মিসওয়াক করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আনাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আমি তোমাদের অধিকমাত্রায় মিসওয়াকের নির্দেশ দিয়েছি। অর্থাৎ তোমরা বেশি বেশি মিসওয়াক করো। (সহীহ বুখারি : ৮৮৮)। হজরত আলী (রা.) বলেন, ‘আমাদেরকে মিসওয়াকের আদেশ দেওয়া হয়েছে।’ (বাইহাকী, হাদিস : ১৬২)। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আমাদেরকে মিসওয়াকের প্রতি গুরুত্বের সাথে নির্দেশ দেওয়া হতো। আমাদের ধারণা হতে লাগল যে, এ সম্পর্কে হয়তো শীঘ্রই কোনো আয়াত নাজিল হবে।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ১৮০৪)। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেওয়া মিসওয়াকের আদেশ সাহাবায়ে কেরাম খুব গুরুত্বের সাথে পালন করেছেন। সালেহ ইবনে কায়সান (রাহ.) বলেন, ‘উবাদা ইবনে সামেত (রা.) এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্য সাহাবিগণ চলাফেরা করতেন। তারা কানের ওপর মিসওয়াক গুঁজে রাখতেন।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ১৮০৫)। সাহাবায়ে কেরামগণ কানের সাথে মিসওয়াক গুঁজে রাখতেন, ওজু নামাজের ক্ষেত্রে কোনো অবস্থায়ই যেন মিসওয়াকের আমল ছুটে না যায়।

জুমার দিনের অন্যান্য সুন্নতের মধ্যে মিসওয়াক করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। হাদিসে জুমার দিন ভালোভাবে গোসল করার সাথে মিসওয়াকের কথাও এসেছে। আবু সায়িদ খুদরি (রা.) হতে বর্ণিত- তিনি বলেন : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, জুমার দিন প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির গোসল ও মিসওয়াক করা কর্তব্য এবং সামর্থ্য অনুযায়ী সে সুগন্ধিও ব্যবহার করবে।’ (সহিহ মুসলিম : ১৮৪৫)।

হজরত উসমান (রা.) হতে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন : যে ব্যক্তি উত্তমরূপে ওজু করল তার শরীর থেকে গুনাহসমূহ বের হয়ে গেল। এমনকি তা আঙুলের অগ্রভাগ দিয়ে তা বের হয়ে যায়।’ (সহিহ মুসলিম : ২৪৫)। উত্তমরূপে ওজু তো তখনই হবে, যখন ওজুর প্রতিটি কাজ সুন্নত অনুযায়ী যথাযথভাবে আদায় করা হবে। আর মিসওয়াক ওজুর গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নত।  উত্তমরূপে ওজু আদায় হওয়ার জন্য মিসওয়াক জরুরি অনুষঙ্গ। ওজুতে কুলি করা, নাকে পানি দেওয়া সুন্নত। তেমনি ওজুর সময় মিসওয়াক করাও একটি সুন্নত। কুলি ছুটে গেলে বা নাকে পানি দিতে ভুলে গেলে প্রশ্ন করা হয় ওজু হবে কি না? অথচ মিসওয়াক নিয়মিত ছুটে যাচ্ছে, এ প্রশ্ন মনে জাগে না! এ অবস্থার সংশোধন হওয়া জরুরি।

মিসওয়াকের কথা আসলে কোনো কোনো ভাই ব্রাশের প্রসঙ্গ টেনে আনেন এবং বলেন, ব্রাশ দ্বারা কী মিসওয়াকের সুন্নত আদায় হবে না? সংক্ষেপে এর উত্তর হলো, মিসওয়াকের সুন্নত তো সুনিশ্চিতভাবে মিসওয়াক দ্বারাই আদায় হবে। এজন্য যে যে ক্ষেত্রে মিসওয়াক সুন্নত সেখানে মিসওয়াকই করা উচিত। এক্ষেত্রে অন্য কিছুকে মিসওয়াকের নিশ্চিত বিকল্প বলা যায় না। হাঁ ব্রাশ দ্বারা যেহেতু দাঁত পরিষ্কার হয় তাই কেউ যদি ব্রাশ করতে চায় তাহলে ঘুমানোর আগে বা ভারি খাবারের পর করতে পারে। দ্বিতীয়ত ব্রাশ তো করা হয়ে থাকে সাধারণত এক-দুবার। সকালে ও রাতে। ওজুর সাথে পাঁচ ওয়াক্ত ব্রাশ করার জন্য পকেটে ব্রাশ ও পেস্ট রাখে কে? তাই মিসওয়াকের সাথে ব্রাশের প্রসঙ্গ টেনে আনা কোনোভাবেই ঠিক নয়। সুন্নতের ওপর আমল সুন্নাহসম্মত পদ্ধতিতে হওয়া চাই। তবেই পাওয়া যাবে সুন্নাহ পালনের নূর ও বরকত, ইনশাআল্লাহ। আসুন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সকল সুন্নতকে প্রিয় করে নিই। আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : মুফতি নাঈম কাসেমি

পরিচালক, জামিয়া শায়খ আরশাদ, বাংলাদেশ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads