• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪২৯
নৈতিক জীবনের মূল্য কতটুকু

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

নৈতিক জীবনের মূল্য কতটুকু

  • প্রকাশিত ০১ নভেম্বর ২০১৮

আমরা নৈতিকতা নিয়ে যখন কথা বলি, তখন মানুষকে এটাই বোঝাতে চাই যে, ভালো-মন্দের বিচার করে শুভ ও অশুভের পার্থক্যটা বুঝিয়ে থাকি। এখানে আমরা বলতে তাদেরকেই বোঝানো হচ্ছে, যারা রাষ্ট্র ও সমাজের উচ্চ স্তরে অবস্থান করে মনে করেন তাদের দয়ায় আমরা সাধারণরা কোনোমতে বেঁচে আছি। তাদের মধ্যে একশ্রেণির লোক আছেন, যারা ঘুষ দুর্নীতিকে কোনো ধরনের অপরাধই মনে করেন না। ভাবটা এমন, এই শ্রেণির ভদ্রলোকরাই আমাদের বেঁচে থাকার পথ যেন মসৃণ করেছেন। কিন্তু বাস্তব অবস্থা বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাব, আমরা সাধারণ মানুষ ক্রমাগত ভয়াল এক অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছি। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে আমরা সুদূরপ্রসারী আলোকরেখায় স্নাত হয়ে আলোকিত মানুষ হতে পারছি না। লোভই বলি আর স্বার্থের কথাই বলি অর্থাৎ যা-ই বলি না কেন, সততার ওজন কিছুরই সঠিক হিসাব-নিকাশ করতে পারছি না। কর্মক্ষেত্রে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে প্রতিদিনের যেসব কাজকর্ম সম্পাদন করছি, সেই কাজকর্মের মূল্যায়ন সঠিকভাবে করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। যে কাজ সমাজের অশিক্ষিত মানুষও করতে দ্বিধাবোধ করবে, সে কাজ আমাদের ভদ্রলোকেরা করতে পিছপা হন না। প্রশ্ন আসতে পারে আমাদের সবকিছু বদলে যাচ্ছে কেন? কেন আজ সমাজ-সংসারে এতটা পচন ধরেছে? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে সহজভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। তবে এ দেশের সাধারণ মানুষের দল এটা ভালো করে বোঝে যে, আমরা আজ এমন এক সময় অতিক্রম করছি, যে সময়টাকে কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায় বলা যায়, আমরা দেশবাসী অদ্ভুত এক আঁধারের করতলে করতলগত হয়ে বসবাস করছি। রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বক্ষেত্রে অন্ধকার তার থাবা প্রসারিত করে যাচ্ছে। আজ যেন যার সুন্দর করে কথা বলার ক্ষমতা নেই, সে-ই সর্বত্র কথা বলছে। তার কথাই যেন আমরা বেশি করে শুনতে বাধ্য হচ্ছি। যার কোনো কিছু দেখে বিচার করার ক্ষমতা নেই, সে-ই হচ্ছে জটিল প্রশ্নের বিচার-বিশ্লেষক। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এই যে, অযোগ্য লোকের দেখানো কুৎসিত কোনো কিছুকে সুন্দর বলতে আমরা ব্যাকুল হয়ে থাকি। আরো ব্যাখ্যা করে বলা যায়, যাদের কোনো কিছু বোঝানোর ক্ষমতা নেই, সেরকম অজ্ঞানদের বোঝানো ব্যাখ্যাগুলোকে আমরা ধরে নিচ্ছি সঠিক আলোচিত বিচার-বিশ্লেষণ বলে। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, আমরা কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায় যাকে বলা হয়ে থাকে অদ্ভুত আঁধার, সেই অদ্ভুত আঁধারে আমরা কি ডুবে আছি? এই অদ্ভুত আঁধার থেকে বের হওয়ার কোনো আলোকিত পথ আমাদের সামনে কি খোলা নেই? আবার এমন প্রশ্নও আসতে পারে আমাদের চোখ-কান খোলা থাকতে আমরা কেন ‘অদ্ভুত আঁধারে’ ডুবে আছি। তারও যথার্থ উত্তর আছে। আর উত্তরটা হলো আমরা আত্মঘাতী। আমরা অলস এবং ভীতু। আমরা মেঘের বিদ্যুৎরেখার মতো জ্বলে উঠে আবার নিভে যাই। তারপর বিশ্রী এক অন্ধকারের কাছে আত্মসর্মপণ করে বসে থাকি। আমার কথায় অনেকেই দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। বলতে পারেন আমরা জ্বলে উঠে মেঘের বিদুৎরেখার মতো নিভে যাব কেন? কেউ বলতে পারেন আমরাই তো ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে নিজের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছি। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছি। ভীতুরা কি আন্দোলন সংগ্রামের স্বপ্ন দেখতে পারে? অলসরা কি মৃত্যুর পথের অভিযাত্রী হতে পারে? যারা এমন কথা বলবেন, তাদের কথাও মিথ্যা নয়। ভীতু কিংবা অলসরা যেমন নতুন স্বপ্ন নির্মাণ করতে পারে না, তেমনি অলসরা হাসিমুখে আত্মদানও করতে পারে না। একাত্তরের সেই স্বপ্ন কিংবা চেতনা থেকে আমরা যা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলাম, আমরা তো আমাদের চোখের সামনেই দেখতে পেয়েছি কিংবা এখনো দেখতে পাচ্ছি একশ্রেণির লোভী মানুষের দল অর্থাৎ জোটবদ্ধ আত্মস্বার্থবাদীরা আমাদের সব অর্জনকে গ্রাস করে নিচ্ছে। তার মধ্যে আমরা আবার আত্মঘাতী। আত্মঘাতী এই জন্য বলছি যে, আমরা সাময়িক লাভের তাড়নায় কিংবা অন্ধ লোভের হাতছানিতে কখন যে নিজের বিরুদ্ধে চলে যাই, তা বোঝার ক্ষমতা আমাদের নেই। যারা দেশের সচেতন জনগোষ্ঠী, তারা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন লোভের তাড়নায় নষ্ট মানুষের ছলচাতুরির ফাঁদে তারা পা দেননি। এখানে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, কেন নষ্ট মানুষের ছলচাতুরির ফাঁদে পা দিয়ে থাকি। এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হচ্ছে, আমাদের দেশের কিছু মানুষ হচ্ছে চরম সুযোগসন্ধানী। কেবলই চিন্তা করে মানুষকে সুযোগ পেলে কীভাবে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করা যায়। সে কম পয়সা আয় করুক কিংবা বেশি পয়সা আয় করুক না কেন, এটা কোনো ব্যাপার নয়। এখানে একটা উদাহরণ দেওয়া যায়, মনে করেন কোথাও শ্রমিকরা বাস ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে, কিছুতেই বড় গাড়িগুলো চলতে পারছে না। তখন দেখা যাবে ছোট ছোট যানবাহনে ড্রাইভাররা সুযোগ পেয়ে চল্লিশ টাকার ভাড়া আশি টাকা করে নিচ্ছে। অর্থাৎ সবাই সুযোগ সন্ধানে থাকে বলেই ভালো-মন্দের বিচার না করে সুযোগটুকু কাজে লাগিয়ে থাকে। অচেতন মানুষ জানেই না কখন সে নিজের অজান্তে নিজের বিরুদ্ধে চলে যায়। কথায় বলে, বিয়ের প্রথম রাতে বিড়াল তাড়াতে হয়।

পাঠকরা একটু সচেতন হলেই দেখতে পাবেন, যখন কোনো অন্যায় প্রথমই থামিয়ে দেওয়া হয়, তখন সেই অন্যায় আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। এমন কথা নতুন কোনো বিষয় নয়। অভিজ্ঞজনরা অনেকবার মাঠে-ঘাটে পত্রিকার পাতায় এসব কথা বলেছেন। কিন্তু আমরা এমন এক অবস্থানে বসবাস করছি, যেখানে ভালো কথা বার বার বললেও আমাদের ঘুম ভাঙে না। লেখার প্রথমে নৈতিকতার কথা বলেছিলাম। নৈতিকতা কিংবা সামাজিক মূল্যবোধের কথা আমরা যা-ই বলি না কেন, আমাদের আগে ভাবতে হবে আমরা যে পথ ধরে হাঁটছি সেই পথের কথার সঙ্গে আমাদের নৈতিক জীবনের মিল কতটুকু আছে।

 

শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল

লেখক : আইনজীবী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads