• মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪২৯
বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তায় হুমকি নয় করোনা

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তায় হুমকি নয় করোনা

  • প্রকাশিত ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০

নাজমুন্নাহার নিপা

 

বর্তমান সময়ের বহুল আলোচিত বিষয় হচ্ছে করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯। আমরা ইতোমধ্যে এই ভাইরাস সম্পর্কে সবাই কমবেশি অবগত। তবে এরই মধ্যে বৈশ্বিক গবেষণা বলছে, বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার প্রভাবে দেশীয় খাদ্য নিরাপত্তা, সামগ্রিক জীবনযাত্রা, জীবন-জীবিকা, দ্রব্যমূল্য মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হতে পারে। দেশগুলো খাদ্য সংকটে পড়তে পারে এবং সামগ্রিক জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আসতে পারে। 

বর্তমান সময়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ থাকায় খাদ্য চাহিদা মারাত্মক ঘাটতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে, যা পুষ্টির একটি বড় অংশ লাঘব করে দিতে পারে। অপরদিকে, অপুষ্টি রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে। যার ফলে এই সংকটময় মুহূর্তে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ নিশ্চিত করাও একটি বড় দায়িত্ব। খাদ্য প্রাপ্যতা সম্পর্কে অনিশ্চয়তা রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার প্রবাহকে ছড়িয়ে দিতে পারে এবং বিশ্ববাজারে ঘাটতি সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করছেন জাতিসংঘসহ ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশন এবং ওয়ার্ল্ড ট্রেড অরগানাইজেশনের পরিচালকরা। তারা আরো বলেন, কোভিড-১৯ লকডাউনের মাঝে বাণিজ্য যাতে যথাসম্ভব অবাধে প্রবাহিত হয় তা নিশ্চিত করার জন্য অবশ্যই বিশেষভাবে চেষ্টা চালাতে হবে, বিশেষত খাদ্যের অভাব দূর করতে। দীর্ঘমেয়াদি সীমাবদ্ধতার আদেশ এবং ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাগুলোর ফলে কৃষিশ্রম না পাওয়া এবং বাজারে খাদ্য গ্রহণের অক্ষমতার কারণে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। বলা হচ্ছে, এখন পর্যন্ত অধিকাংশ দেশে খাদ্য সরবরাহ পর্যাপ্ত পরিমাণে রয়েছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক এবং বাজারগুলো এখন পর্যন্ত স্থিতিশীল। গ্লোবাল সিরিয়াল স্টকগুলো আরামদায়ক পর্যায়ে রয়েছে এবং ২০২০ সালের জন্য গম এবং অন্যান্য প্রধান প্রধান ফসলের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক। কিন্তু এই মহামারী যদি দীর্ঘদিন চলতে থাকে, তাহলে বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তায় এটি হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। 

করোনাভাইরাসের কারণে পুরো বিশ্ব এখন স্থবির। যার ফলে ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন শহর লকডাউন করে দেয়া হয়েছে। চলাচলের ওপর বিধিনিষেধের ফলে শ্রম ঘাটতির সৃষ্টি হয় এবং দুর্ভোগ আরো বেড়ে যায়। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার যে আশঙ্কা করা হচ্ছে তা উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে বড় আঘাত করতে পারে। এই অর্থনৈতিক মন্দা খাদ্য নিরাপত্তাহীনতাকেও আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে।

আমাদের দেশীয় কৃষির অত্যাবশ্যকীয় অনেক উপকরণ যেমন সার, বীজ, বালাইনাশক অনেক হারে আমদানিনির্ভর, যা আমরা অন্য দেশ থেকে আমদানি করি এবং দেশীয় কৃষিতে ব্যবহার করি। বিশ্বব্যাপী চলমান এই সংকটের জন্য কৃষকদের কাঙ্ক্ষিত কাঁচামালের ঘাটতি হতে পারে। যার ফলে খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিভিন্ন দেশের আমদানি-রপ্তানি বন্ধ থাকায় সার, বীজ, কীটনাশক এক দেশ থেকে অন্য দেশে আমদানি ও রপ্তানি করা যাচ্ছে না। তাছাড়া বাংলাদেশ থেকেও অনেক দ্রব্য অন্যান্য দেশে রপ্তানি করা হয়, যা এখন করা যাচ্ছে না। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রা আয় থেকেও বঞ্চিত হতে হচ্ছে অনেক দেশকে। এমনকি বর্তমানেও অনেক দেশে প্রবেশাধিকার না থাকায় খাদ্য আমদানি-রপ্তানি ক্রমশ কমতে শুরু করেছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, বর্তমান বিশ্বের ৮২০ মিলিয়ন মানুষ দীর্ঘস্থায়ী ক্ষুধায় ভুগছেন। সাধারণ জীবনযাপনের জন্য যে পরিমাণ ক্যালরি দরকার তা খাচ্ছেন না। এর মধ্যে ১১৩ মিলিয়ন মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি হচ্ছে। ক্ষুধা এতটাই মারাত্মক যে, এটি তাদের জীবন ও জীবিকার জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং বেঁচে থাকার জন্য তাদের বহিরাগত দেশের সহায়তার ওপর নির্ভরশীল করে তোলে, যেখানে কোভিড-১৯ একটি বড় বাধা।

নিম্নআয়ের দেশগুলোতে বিশেষভাবে এটি বেশি প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন গবেষকরা। গবেষকরা বলছেন মাঠপর্যায়ে কর্মীদের সংকটের ফলে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে বিপুলহারে। অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, উচ্চবিত্তরা একসাথে অনেক খাবার কিনে মজুত করে রেখে দিচ্ছে। মূলত করোনাভাইরাসের জন্য আতঙ্ক সৃষ্টি হওয়ার ফলে মানুষ এটি করছে। এর ফলে যারা দিন এনে দিন খায় তাদের জন্য পরবর্তীকালে খাবার পাওয়া হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এতে করে তারা খাদ্য ঘাটতিতে পড়ছে।

কোভিড-১৯-এ কৃষক, মৎস্য ব্যবসায়ীদের অনেক ক্ষতি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জমিতে কাজ করা, পশুপাখির যত্ন নেয়া বা মাছ ধরায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে এটি। বাজারে তাদের পণ্যগুলো বিক্রি করতে বা প্রয়োজনীয় পণ্যগুলো কিনতে বা উচ্চতর খাদ্যমূল্যের কারণে এবং সীমিত ক্রয়ক্ষমতার কারণে তাদেরকে সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। দিনমজুররা ফসল কাটা ও প্রক্রিয়াজাতকরণের চাকরি ও আয়ের দিক দিয়ে খুব ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

কৃষির পাশাপাশি অন্য খাতগুলোতেও এর প্রভাব পড়া অমূলক নয়। পরিবহন বিশেষত তাজা খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খলার জন্য বাধাজনক এবং এর ফলে খাদ্য ক্ষতির পরিমাণ এবং বর্জ্য বাড়ার কারণও হতে পারে। টাটকা মাছ এবং জলজ পণ্য, যা নষ্ট হয় এবং তা বিক্রি, প্রক্রিয়াজাতকরণ বা সংরক্ষণ করা বিশেষ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। শ্রমের অভাব খাদ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণ ব্যাহত করতে পারে, বিশেষত শ্রমনির্ভর শিল্পের জন্য। উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশেষত ঝুঁকিতে রয়েছে কারণ কোভিড-১৯ শ্রমশক্তি হ্রাস করতে পারে। তাছাড়া আয় এবং জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি শ্রমনির্ভর ফার্মে উৎপাদনকে (কৃষি, মৎস্য) প্রভাবিত করতে পারে। দরিদ্র দেশগুলোতে খাদ্য চাহিদা আয়ের সঙ্গে সব থেকে বেশি জড়িত এবং সেখানে আয়-উপার্জনের সুযোগগুলোকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করবে কোভিড-১৯।

এই মুহূর্তে দেশগুলোকে তাদের দুর্বল জনগোষ্ঠীর তাৎক্ষণিক খাদ্য চাহিদা পূরণে এগিয়ে আসা উচিত। এক্ষেত্রে জরুরি খাদ্য চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা দিতে হবে, পুষ্টিহীনতা প্রতিরোধ ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি প্রসারিত করতে হবে, সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারগুলোতে খাদ্য বিতরণ করতে হবে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শ্রমিকদের জন্য প্রাথমিক খাবারের ওপর কর ছাড় দিতে হবে ইত্যাদি। একই সঙ্গে নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোকে তাদের প্রাথমিক চাহিদা মেটাতে সহায়তা করার জন্য একাধিক অর্থ প্রদান নিশ্চিত করা উচিত।

বর্তমান পরিস্থিতিতে খাদ্যঘাটতি মোকাবিলায় প্রতিটি দেশকে একত্রে কাজ করতে হবে। দেশীয় সংকট দূর করতে সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে। আমাদের অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে কোভিড-১৯ যেন আমাদের অজান্তেই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অনিয়ন্ত্রিত সংকট সৃষ্টি  না করে এবং ক্ষুধা ও অপুষ্টি বাড়িয়ে না তোলে।

লেখক : শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

ত্রিশাল, ময়মনসিংহ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads