• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯
নারীবান্ধব সমাজ প্রয়োজন

সংগৃহীত ছবি

সম্পাদকীয়

নারীবান্ধব সমাজ প্রয়োজন

  • প্রকাশিত ০৪ অক্টোবর ২০২০

হাসনা হেনা

 

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর,/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’ নারীকে বাদ দিয়ে জগৎসংসার অকল্পনীয়। নারী-পুরুষ দুজনের মিলিত প্রচেষ্টায় একটি আদর্শ সমাজব্যবস্থা সম্ভব। একটি দেশ তখনই প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন নারী-পুরুষ মিলে একসাথে উন্নয়নের পথ ধরে হাঁটবে আর একে অন্যের প্রতি সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে দেবে। আমাদের সংবিধান নারী-পুরুষের সমান অধিকারকে নিশ্চিত করেছে। কিন্তু সমাজে নারী-পুরুষের চরম বৈষম্য দেখা যায়। সমাজে নারীরা পিছিয়ে থাকলে, গোটা সমাজব্যবস্থার ওপরই তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। নারীর উন্নয়ন বলতে নারীর ক্ষমতায়ন, কাজের যথায়থ মূল্যায়ন ও সকল ক্ষেত্রে প্রাপ্য অধিকার প্রতিষ্ঠাকে বোঝায়। ইসলাম নারীকে সম্মানিত করেছে। মহান সৃষ্টিকর্তা মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত রেখেছেন। রাসুল (সা.)-এর একটি হাদিসে এসেছে, নারীকে সম্মান করার পরিমাপের ওপর ব্যক্তির সম্মান ও মর্যাদার বিষয়টি নির্ভর করে। তার মানে হলো একজন পুরুষ নারীকে কতটা সম্মান দিল, তার ওপর নিজের সম্মান নির্ভরশীল।

বর্তমান পরিস্থিতিতে মেয়ে সন্তান মানেই যেন এক আতঙ্কের নাম। সমাজের ঘৃণ্যরূপ দেখলে মনে হয়, আমরা এখনো বর্বর যুগ থেকে বেরুতে পারিনি। কোথায় নিরাপদ নারী? ঘর থেকে বের হলেই নারীর জন্য ওত পেতে থাকে বিপদ। ক্ষেত্র বিশেষে নারীর জন্য ঘরও নিরাপদ নয়। রাস্তায় চলতে ফিরতে নারীরা প্রতিনিয়তই বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। অনেক সময় বখাটেদের ইভটিজিংয়ের কারণে বন্ধ হয়ে যায় মেয়েদের পড়াশোনা। ইভটিজিং এখন প্রতিকারবিহীন সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এটি তরুণ প্রজন্মের ব্যাপক অধঃপতনেরই নির্দেশ দিচ্ছে। এখনো আমাদের সমাজ নারীবান্ধব হয়ে উঠতে পারেনি। এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, আধুনিক সভ্য যুগেও ঘরে-বাইরে সর্বত্রই নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এখনো যৌতুকের দায়ে জীবন দিতে হচ্ছে অনেক নারীকেই। এছাড়াও বাল্য বিয়ে, যৌন হয়রানি, এসিড নিক্ষেপসহ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন প্রতিনিয়তই ঘটছে। শিশু থেকে শুরু করে ৮০ বছরের বৃদ্ধাও পুরুষের লালসা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। শত বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে নিপীড়ন ও নির্যাতন উপেক্ষা করে নারীরা ঘরে ও বাইরে কাজ করছে নিরলসভাবে এবং অবদান রাখছে জাতীয় অর্থনীতিতে। কিন্তু উন্নয়নের অতি আধুনিক পুঁজিবাদী এই বিশ্ব নারীকে বিজ্ঞাপনের পণ্যে পরিণত করেছে। যদিও শিক্ষা-দীক্ষায় কাজ-কর্মে নারীরা কোনো অংশেই পিছিয়ে নেই। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও গবেষণাসহ বিভিন্ন সেক্টর এখন নারীর পদচারণায় মুখর। তারপরও শিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত, নিম্নবিত্ত, উচ্চবিত্ত— সব নারীই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার। পারিবারিক কাজে নেই তাদের স্বীকৃতি কিংবা ন্যূনতম মর্যাদা। এমনকি আপনজনের কাছ থেকেও নির্যাতিত হচ্ছে নারী। কর্মস্থল, পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থা এখনো নারীবান্ধব হয়ে ওঠেনি। পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজে নারীর প্রতি জঘন্য নিষ্ঠুরতা কমছে না, বরং বেড়েই চলছে।

বিগত দুই বছরের ধর্ষণ পরিসংখ্যান যথেষ্ট উদ্বেগের। বাংলাদেশ পুলিশ বলছে, গত বছর ৫ হাজার ৪০০ নারী এবং ৮১৫টি শিশু ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়। ২০১৮ সালে শিশু ধর্ষণের মামলা ছিল ৭২৭টি এবং নারী ধর্ষণের মামলা ছিল ৩ হাজার ৯০০টি। পুলিশের হিসাব বলছে, গত বছর ধর্ষণের কারণে ১২ শিশু এবং ২৬ জন নারী মারা যান। ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ২১ নারী ও ১৪ শিশু। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা আগের চেয়ে দ্বিগুণ বেড়েছে। গত বছর সারা দেশে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার ১ হাজার ৪১৩ নারী ও শিশু। ২০১৮ সালে সংখ্যাটি ছিল ৭৩২। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের মতে, গত বছর ৯০২ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩৫৬। আর বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুয়ায়ী প্রতি মাসে গড়ে ৮৪টি শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এছাড়া এক বছরে যৌন নির্যাতন বেড়েছে ৭০ শতাংশ। গত বছর যৌন নির্যাতনের শিকার হয় ১ হাজার ৩৮৩ শিশু। ২০১৮ সালের চেয়ে গত বছর শিশু ধর্ষণ ৭৬ দশমিক ০.১ শতাংশ বেড়েছে।

শুধু পুলিশ পরিসংখ্যান অনুয়ায়ী, বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫৪০০টি। এ তথ্য অনুয়ায়ী বাংলাদেশে ধর্ষণের হার ৩.৮০ অর্থাৎ প্রতি ১ লাখ নারী মধ্যে প্রায় ৪ জন নারী-শিশুকেই ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে, যা স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। এসব পরিসংখ্যান সমাজ ও দেশের জন্য লজ্জার। নারীর প্রতি অসম্মান, নারীকে লাঞ্ছনা শুধু নারীকেই পিছিয়ে রাখবে না, বরং সমাজ তথা রাষ্ট্রকেও টেনেহিঁচড়ে নিচে নামাবে।

চলতি বছর ২০২০-এর কেবল সেপ্টেম্বর মাসের ১ তারিখ থেকে ২৭ তারিখ পর্যন্ত ৩৫ জন নারী ধর্ষিত হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছে এসব নারী ও শিশুকে। বিচার না হওয়াকে এই পরিস্থিতির জন্য দুষছেন মানবাধিকারকর্মীরা। সমাজে সত্যিকারের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া খুবই জরুরি। কোনো অপরাধীই যেন অপরাধ করে পার না পায়। সে যত ক্ষমতাধরই হোক না কেন, অপরাধীর পরিচয় সে অপরাধী।

আমার বাড়ি শিল্প এলাকায়, সে সুবাদে আমাদের বেশ কিছু ঘর ভাড়া দেওয়া আছে। আর সে ভাড়াটিয়ার ৭০% গার্মেন্ট কিংবা স্পিনিং মিলে কর্মরত। মাসের বেতন ওঠানো শুরু হলেই এ-ঘর, ও-ঘর থেকে ঝগড়ার খবর আসতে থাকে। প্রায়ই এসব ঝগড়ার কারণ খতিয়ে দেখতে গিয়ে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই। সারা মাস একজন মহিলা নিজের সংসার সামলে গার্মেন্ট কিংবা কোম্পানিতে শ্রম দিয়ে টাকা উপার্জন করে। আর মাস শেষে উপার্জনের পুরো টাকাটাই স্বামী কিংবা পিতার হাতে তুলে দেয়। নিজের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের টাকা থেকে দু-চারশ টাকা নিজের কোনো প্রয়োজনে রেখে দিলেই স্বামী বেচারা রেগে আগুন। এই ইস্যুকে কেন্দ্র করেই কখনো কখনো স্বামীর হাতে স্ত্রীকে রক্তাক্তও হতে হয়। একদিন আমাদের এক বাসার পেছন দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম, তখন শাশুড়ি-বউয়ের তুমুল ঝগড়া চলছিল। ঝগড়ার কারণ হচ্ছে বউ বাবার বাড়ি থেকে যৌতুক আনেনি। কিন্তু মাঝেমধ্যে বেতনের টাকা থেকে বৃদ্ধ মা-বাবাকে কিছু টাকা দেয়। এটা নিয়ে স্বামী, শাশুড়ি— দুজন মিলে বউটির সঙ্গে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করছিল। আমাদের প্রতিবেশী একজন মহিলা পর পর তিনটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, তাই তার স্বামী বংশরক্ষা করতে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে হবে, এতে যদিও মায়ের কোনো ভূমিকা নেই, তারপরও এ সমাজব্যবস্থা নারীকেই এর জন্য দায়ী করছে। এ তো গেল দুজন নারীর কথা। এরকম নির্যাতিত নারী বাংলার ঘরে ঘরে খোঁজ করলে পাওয়া যাবে।

এসব চিত্র আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমাদের সমাজে নারীদের অবস্থান ঠিক কোথায়। বাংলাদেশের প্রধান শিল্প পোশাক শিল্প। এখানে প্রায় ৮০ ভাগ নারীশ্রমিক কাজ করে। পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ, কর্মঘণ্টা ও ন্যায্য মজুরির বিষয় নিয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্টরা অনেক কথা বললেও এখনো পোশাক শিল্পে ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত ও নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরি হয়নি। মূল কথা হলো নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করতে জেন্ডার ইস্যুগুলোই প্রকৃত সমাধান করতে পারবে না এবং এটাও সত্যিকার কৌশলও নয়। নারী মুক্তির জন্য সর্বাগ্রে বুঝতে হবে নারী নিপীড়নের গভীরতর সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণসমূহ যা জেন্ডারভিত্তিক শোষণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত।

‘একটা শিশুকে দুনিয়ার মুখ দেখাতে মা যে কষ্ট সহ্য করে তা বাবা সারা জীবন ভালোবেসেও শোধ করতে পারে না। তাই প্রত্যেকটা স্বামীর উচিত তার সন্তানের মাকে কোনোরকম কষ্ট না দেওয়া।’ রূপসী কবি জীবনানন্দ দাশের এই উক্তির সঙ্গে আমাদের সমাজের বাস্তব চিত্রের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রয়োজন আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন। উন্নত সভ্যতার চরম উন্নয়নেও আমরা মানসিক দিক দিয়ে উন্নত নই। আর তাই পুরুষ শাসিত সমাজ এখনো নারীকে মানুষ ভাবতে শেখেনি। নারীরা স্বনির্ভর হলেও স্বয়ংসম্পূর্ণ নারী খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রতিকূল সমাজব্যবস্থায় নিজেকে মানুষ ভাবতে পারছেন না অনেক নারী। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় মোড়ানো সমাজব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের মেয়ে সন্তানদের এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে আমাদেরই। আর এজন্য সমাজ ও রাষ্ট্রকেও হতে হবে নারীবান্ধব।

সমকালীন বিশ্বে নারী নেতৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত। অন্য দেশে তাকানোর প্রয়োজন নেই, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট দেখলেই এটা উপলব্ধি করা যায়। এ দেশের দুটি বড় রাজনৈতিক দলের প্রধানই নারী। প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকার নারী। সরকার, প্রশাসনসহ বিভিন্ন পেশায় নারীদের অবস্থান সুদৃঢ়। নারীরা পুরুষের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও নারীরা পুরুষের চেয়েও এগিয়ে আছে। তারপরও এ দেশের নারী এখনো বৈষম্যের শিকার। নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পেলেও দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা নারীসমাজ এখনো অনেকটাই পিছিয়ে। ২০৪১-এর মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রের পথে অগ্রযাত্রায় এর উন্নয়ন অত্যাবশ্যক।

 

লেখক : শিক্ষক

sqisqirbqor01@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads