• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯
বই হোক নিত্যসঙ্গী

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

বই হোক নিত্যসঙ্গী

  • সোহাগ মনি
  • প্রকাশিত ০৬ অক্টোবর ২০২০

আমাদের মননের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলতে পারা জিনিসটির নাম হচ্ছে বই। আপনি হয়তো নিজেও চিন্তা করতে পারবেন না নীরবে আপনাকে জীবনের কত বড় কিছু শিখিয়ে দিয়ে যাচ্ছে বই। হাসি, দুঃখ, বেদনা, পাওয়া আর না পাওয়া, সবকিছুর এক সংমিশ্রণই বই। কোনো একটি বইয়ের কোনো একটি শব্দ কিংবা লাইন আপনার জীবনকে পরিবর্তন করে দিতে পারে, অজান্তে অবচেতন মনে আপনার ভাবনার পরিবর্তন ঘটিয়ে আপনাকে এক ভিন্ন মানুষে রূপান্তরিত করার ক্ষমতা রয়েছে বইয়ের। জীবনকে ভিন্ন দৃষ্টি ভঙ্গিতে দেখা, জীবনের রূপরস গ্রহণের ক্ষমতা, জীবনের পরাজয়কে মেনে নিয়ে ও  জীবনকে উপভোগ করার এক অদ্ভুত মন্ত্র আপনি পেতে পারেন বই পাঠে। আসলে বই পাঠের প্রয়োজনীয়তা নতুন করে বলার কিছু নেই, হয়তো ভাষায় প্রকাশ করাও সম্ভব নয়, এক কথায় জীবনকে দেখতে আর জানতে হলে বইয়ের বিকল্প নেই।

একুশ শতকের সূচনালগ্নে অনেক কিছুর আবির্ভাবই আমাদের জীবনের ধারাকে পাল্টে দিয়েছে। সেইসঙ্গে হতাশা বাড়ছে, বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা! নিজেদের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না তরুণ প্রজন্ম।  উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও খুব বড় একটা কিছু ফাঁকা থেকে যাচ্ছে। এই ফাঁকা জায়গাটা পূরণের মাধ্যম ছিল বই। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য সৃজনশীল বই মনন বিকাশে সহায়ক হয়ে ওঠে। আমরা দিনকে দিন বইবিমুখ জাতি হিসেবে পরিণত হচ্ছি। মূলত এর কারণেই শিক্ষার ভিত্তি হচ্ছে দুর্বল, আমাদের চিন্তাচেতনা আর ভাবনাগুলো ঠিক সেই দুর্বল ছাঁচের আঙ্গিকেই গড়া, খুব নড়বড়ে আমাদের তরুণ প্রজন্মের ভাবনার জগৎ।

চিন্তার বৈচিত্র্য আনতে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। কেউ যখন বই পড়ে তখন তার ইন্দ্রিয়গুলো খুব সক্রিয় এবং সচেতনভাবে কাজ করে। একটা নিজস্ব বলয় তৈরি হয় নিজের; কল্পনার জগতের সঙ্গে বাস্তবের মেলবন্ধন ঘটে, নতুন চিন্তার উন্মেষ হয়, নতুন পরিকল্পনা আর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ছাড়িয়ে যাওয়া যায় অনেককে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই আমাদের করে তোলে প্রকৃতিপ্রেমী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই ইতিহাসের আলোকে দিয়ে যায় শিক্ষা, সমরেশ মজুমদারের বই বাস্তবতা সম্পর্কে পথ চলতে শেখায়; তেমনি আরো অনেক লেখকের বই আমাদের জীবনকে করে তুলতে পারে পরিপূর্ণ, সেখানে নাম করা যেতে পারে শওকত ওসমান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আবুল ফজল, সৈয়দ মুজতবা আলী, শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক, আবুবকর সিদ্দিক প্রমুখের নাম। জ্ঞান আর আনন্দ এই দুই জিনিসের অভাব কখনোই বুঝতে দেয় না বই। জ্ঞান আর আনন্দের অভাবে আমাদের সমাজের যত অপকর্ম। এই দুয়ের অভাবে জাতি হারিয়ে ফেলছে পথ, সমাজ যাচ্ছে এক অনিশ্চয়তার দিকে। আমাদের নৈতিকতা থেকে শুরু করে সার্বিক জীবনব্যবস্থায় বই হতে পারে আলোময় জীবনের সন্ধানকারী।

এখন আসি কেনই বা আমাদের এত বইবিমুখতা। তথাকথিত আধুনিক প্রযুক্তি এর বড় কারণ। আমাদের তরুণ প্রজন্ম বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছেন প্রযুক্তিকে। কিন্তু আসলেই প্রাযুক্তিক এই বিনোদন কি কোনোভাবে আমাদের সমৃদ্ধ করছে? নাকি বিকৃত করছে তরুণ সমাজের মস্তিষ্ক? প্রযুক্তির অপব্যবহার বইবিমুখ করছে দিনকে দিন। আর এতে মেধার দিক থেকে পিছিয়ে পড়ছি আমরা। বাবা-মায়েদের উদাসীনতাও বড় কারণ। বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের উৎসাহিত করছেন না বই পাঠে। শিশুর সামাজিকীকরণে বই আড়ালে থেকে যাচ্ছে। জীবনের পরম বন্ধু হিসেবে আমরা পরিচিত করতে পারছি না বইকে। মূলত আমাদের অসচেতনার জন্যই একটি প্রজন্ম বেড়ে উঠছে বইহীনতায়, ঠিক সেই প্রজন্ম থেকেই আরেকটা প্রজন্ম বেড়ে উঠবে, এভাবে আমাদের জাতিগত ভিত্তিটাই হবে নড়বড়ে। এই বইবিমুখতা থেকে দায় এড়াতে পারেন না আজকের শিক্ষকগণও। কেননা তারাই পথপ্রদর্শক, শিক্ষকরা যেভাবে শিখাবেন শিক্ষার্থীরা সে পথেই যাবে। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠ্যবই ছাড়া কোনো ধরনের বই পাঠের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয় না। বইয়ের ভুবনে পরিচিত হতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। প্রাথমিক শিক্ষাতে আমাদের শিশুদের কখনো বলা হয় না অন্যান্য সৃজনশীল বই পড়তে। বরং এসব বইকে আরো নিষিদ্ধ করা হয়। শিশুদের মনন বিকাশে প্রথমেই যদি বইকে পরিচিত করে দেওয়া যায়, তাহলে অনেকটা নিশ্চিত করেই বলা যায় তার জীবন হবে সাফল্যমণ্ডিত, সে জীবনকে যাপন করতে শিখবে, জীবনকে অনুধাবন করতে শিখবে।

শুধু আধুনিকতা নিয়ে পড়ে থাকলেই আমাদের হবে না। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বলে গেছেন, ‘কোনো সম্প্রদায়কে চিনতে হলে আগে তার লাইব্রেরিতে কী ধররের বই আছে তা আগে দেখো।’ এই কথাটি দ্বারা তিনি বইয়ের প্রভাবকেই বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ কোনো জাতি কি পড়ে তার ওপর ভিত্তি করেই সেই জাতিকে চেনা যায়, সেই জাতির স্বরূপ উন্মোচন করা যায়। সুতরাং বই পড়াকে সর্বজনীন করতে হবে। সবার আগে শিক্ষকদের গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষাতেই শিক্ষকদের দায়িত্ব নিতে হবে। একজন শিক্ষক তার কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মননে এটা প্রবেশ করিয়ে দেবেন যে, বই কীভাবে আনন্দ দিতে পারে, কীভাবে জীবনের অংশ হয়ে উঠতে পারে। বই পাঠের অভ্যাসটা শিশুদের মাঝে গড়ে তুলতে হবে। মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের বই পাঠ ও রিভিউয়ের প্রতিযোগিতার আয়োজন করাটও খুব কাজে দেবে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইগুলোকে শুধু বিদ্যালয়ের আলমিরাতে তুলে রাখলেই হবে না, কীভাবে একে ছড়িয়ে দেওয়া যায় সবার মাঝে, সেই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। সরকারের উচিত হবে এমন সব বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া, যাতে বিদ্যালয়গুলো তাদের কার্যক্রম পালনে বাধ্য হয়। সামাজিকভাবে বই পাঠের গুরুত্ব তুলে ধরা খুবই প্রয়োজনীয়। আর সবচাইতে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে নিজের পরিবারকেই। বাবা মায়েদের উচিত হবে সন্তানদের আগ্রহী করে তোলা, নিজেদের পরিবারের সঙ্গে বই নিয়ে কথা বলা। বুক শেলফ করে বই কিনে দিয়ে তাতে আগ্রহী করে তোলা খুবই বড় ভূমিকা রাখবে। জীবনে সব কিছুই থাকবে, তবে বই যাতে মননে থাকে, সেই ব্যবস্থা করা জরুরি। আর যে মননে বই থাকে, সেখানে অপরাধ থাকতে পারে না।

বইবিমুখতা আমাদের জাতির জন্য হুমকিস্বররূপ। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক— সবক্ষেত্রেই প্রয়োজন বই। যে যত জানবে, সে ততই আলোকিত হবে আর সেই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে পড়বে সমাজে। অপরদিকে বইবিমুখতা সমাজে বাড়াবে  অস্থিরতা, হতাশা আর অপরাধ। কিশোর অপরাধ তারই প্রমাণ। সুতরাং আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাছে বই হোক নিত্যসঙ্গী। বাংলাদেশ সরকারকে এই দিকটাতে একটু নজর দেওয়া প্রয়োজন, না হয় আমরা আধুনিক হব ঠিকই কিন্তু ভেতরটা থেকে যাবে বড্ড ফাঁপা।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads