• বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জৈষ্ঠ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

করোনার দ্বিতীয় দফা

শঙ্কা নয়, সচেতনতা জরুরি

  • গোপাল অধিকারী
  • প্রকাশিত ০৩ ডিসেম্বর ২০২০

করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দিতে ব্যাপকহারে টেস্ট বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। আর সেক্ষেত্রে অ্যান্টিজেনভিত্তিক র‍্যাপিড টেস্ট কিটের ব্যবহার শুরু করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন তারা। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেই কিছুদিন ধরে শীতে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে বিগত তিন মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে গত নভেম্বরে এবং ওই মাসের ১৭ তারিখে বিগত প্রায় দুই মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক রোগীর মৃত্যু হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে।

শীতকালে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে। দীর্ঘদিনের করোনা জনজীবনে একটি অভিশাপে পরিণত হয়েছে। এই ভাইরাসটি  সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাসহ সবকিছুর ওপরই প্রভাব বিস্তার করেছে। তাপমাত্রা উঠানামার সাথে ভাইরাসের সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও নানা কারণে বাড়তে পারে সংক্রমণ, বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তাপমাত্রা কমলে বারবার স্নান করা বা ঘনঘন কাপড় ধোয়ার প্রবণতা কমবে। ফলে সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়তে পারে। এছাড়া শীতে রোদ কম থাকলে শরীরে ভিটামিন ‘ডি’-এর জোগান কমে যায়। ফলে কমে যায় রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা। করোনার ভ্যাকসিন এখনো বাজারে আসেনি। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে বিশ্বজুড়ে। ফলে সাবধানতা অবলম্বন করা ছাড়া সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় নেই। এ পরিস্থিতিতে শীতকাল অনেকটাই উদ্বেগের, সন্দেহে নেই।

সমীকরণে দেখা যায়, গত কয়েকদিনের ব্যবধানে করোনা সংক্রমণের ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান বাড়ছে। গত ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে করোনায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৪ লাখ ৫১ হাজার ৯৯০ জন, মৃত্যু ৬ হাজার ৪৪৮ জন, মোট সুস্থ ৩ লাখ ৬৬ হাজার ৮৭৭ জন এবং মোট পরীক্ষা হয়েছে ২৬ লাখ ৮০ হাজার ১৪৯ জনের। গত ২৩ নভেম্বর করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৪১৯ জন আর মৃত্যু হয়েছে ২৮ জনের। ২২ নভেম্বর করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৬০ জন আর মৃত্যু হয়েছে ৩৮ জন। ২১ নভেম্বর মঙ্গলবার করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৮৪৭ জন আর মৃত্যু হয়েছে ২৮ জনের। ২০ নভেম্বর সোমবার করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ২৭৫ জন আর মৃত্যু হয়েছে ১৮ জন এবং ১৯ নভেম্বর করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৩৬৪ জন আর মৃত্যুবরণ করেছেন ৩০ জন। এ থেকে বোঝা যায়, বাড়ছে সংক্রমণের ঝুঁকি। কিন্তু সরকারি তৎপরতা ও শুদ্ধি অভিযান নেই প্রথমকার মতো। এখন জনসাধারণের অবাধ চলাফেরায় মনে হয় করোনা নেই দেশে।

করোনাভাইরাসের আরেকটি ধাক্কা আসছে বলে শঙ্কা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, প্রথমবারের অভিজ্ঞতা দিয়ে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতি রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সবাইকে সতর্ক থাকতেও বলেন তিনি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে দ্বিতীয় ধাক্কা সামলানো সম্ভব বলে আশা প্রকাশ করেছেন সরকারপ্রধান। সম্প্রতি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মাগুরা, যশোর ও নারায়ণগঞ্জে তিনটি সেতু উদ্বোধনকালে বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী আরো জানান, মহামারীর এই প্রকোপের মধ্যে মানুষকে সুরক্ষা দেওয়াই সরকারের লক্ষ্য।

ইতোমধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকি মোকাবিলার প্রস্তুতি শুরু করেছে সরকার। মাস্ক ব্যবহারের পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করার কাজে যুক্ত হওয়ার জন্য সরকার ইতোমধ্যে মাঠ প্রশাসনকে নির্দেশও দিয়েছে। ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’, অর্থাৎ মাস্ক না পরলে সেবা নেই—এই প্রতিপাদ্য নিয়ে সরকার করোনাবিরোধী প্রচারণা চালাতে যাচ্ছে। বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের জন্য কোয়ারেন্টাইনের আয়োজন করতে সারা দেশের সিভিল সার্জনদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জনসচেতনতা বাড়াতে প্রচারণা জোরদার করার কাজও শুরু করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কারণ, বিশ্বের বেশকিছু দেশে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসার পর দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতি বিশেষভাবে সৃষ্টি হয়েছে ইউরোপে। সেখানে কোনো কোনো শহর বা অঞ্চলকে নতুন করে লকডাউন বা অবরুদ্ধ করা হচ্ছে।

কথায় বলে, ‘ন্যাড়া বেল তলায় একবারই যায়’। তাই আমাদের পূর্বের ভুল আবার করা উচিত হবে না; বরং পূর্বের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে। করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলেই সব ফ্লাইট বন্ধ করে দিতে হবে। পুরো ঢাকাকে আগে নিরাপদ করা প্রয়োজন বলে মনে করি। সঙ্গে যেসব জেলাতে সংক্রমণ বাড়বে সেসব জেলাকে লকডাউনের আওতায় আনা জরুরি বলে মনে করছি। 

যে কোনো বিষয়ে করণীয় কিছু থাকে। করণীয় কাজ বা সতর্কতা কখনো ক্ষতি করে না। সঙ্কটের  সময়ে আতঙ্কিত না হয়ে বরং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে নিজেকে ও আশপাশের মানুষকে সুরক্ষিত রাখার পরামর্শ দিয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকতে সাবান ও পানি দিয়ে ঘনঘন হাত ধুতে বলা হয়েছে ডব্লিউএইচওর নির্দেশনায়। এছাড়া মাংস ও ডিম অবশ্যই যথাযথ তাপে ও ভালো মতো রান্না করে খেতে বলা হয়েছে। হাঁচি ও কাশির সময় অবশ্যই হাত বা টিস্যু দিয়ে মুখ ও নাক ঢেকে রাখতে বলা হয়েছে। এরপর টিস্যু ফেলে দিতে হবে এবং অবশ্যই হাত ধুয়ে নিতে হবে। যে কোনো অসুস্থ ব্যক্তির সেবা করার পর হাত ধুতে হবে। কোনো প্রাণীর যত্ন নিলে বা স্পর্শ করলে ও প্রাণীবর্জ্য ধরার পরও হাত ধুতে হবে। শরীরে যে কোনো সংক্রমণ এড়াতে রান্না এবং খাওয়ার আগে ও পরে হাত ধুয়ে নিতে হবে। নিজের পাশাপাশি অন্যকে সুরক্ষিত রাখতে করণীয় সম্পর্কে কিছু পরামর্শ দিয়েছে ডব্লিউএইচও। ব্যবহার করা টিস্যু খোলা ঝুড়ি বা ডাস্টবিনে না ফেলে ঢাকনা রয়েছে এমন ঝুড়িতে ফেলতে হবে। হাতে গ্লাভস না পরে বা নিজে সুরক্ষিত না থেকে কোনো অসুস্থ ব্যক্তির মুখ ও দেহ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। একইভাবে গবাদিপশু ও বন্যপশুকে ধরার আগেও নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। রান্নাঘরের কাজেও বিশেষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা বলছে। কাঁচা মাংস, সবজি, রান্না করা খাবার কাটার জন্য ভিন্ন চপিং বোর্ড ও ছুরি ব্যবহার করতে হবে এবং এগুলো হাতে ধরার আগে অবশ্যই প্রত্যেকবার হাত ধুয়ে নিতে হবে। রোগে ভুগে মারা যাওয়া বা অসুস্থ প্রাণীর মাংস একেবারেই খাওয়া চলবে না। তবে রোগের প্রাদুর্ভাব রয়েছে এমন এলাকাতেও উপযুক্ত তাপে ও ভালোভাবে সিদ্ধ করা মাংস খেলে ঝুঁকি নেই। কাঁচা বাজারে গিয়ে কোনো প্রাণী ও প্রাণীর মাংস হাতে ধরলে দ্রুত হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। বাজারে অবস্থানের সময় অযথা চোখমুখ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

কাজের জায়গাটি দিনে অন্তত একবার হলেও পরিষ্কার বা জীবাণু মুক্ত করতে হবে। পরিধেয়টি অবশ্যই প্রতিদিন বদল করতে হবে এবং ধুতে হবে। সংক্রমণ এড়াতে হাতে গ্লাভস ব্যবহার করা ভালো। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আতঙ্কের মধ্যে ভ্রমণ বিষয়েও সচেতন থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যদি জ্বর-সর্দি অনুভূত হয়, তাহলে যে কোনো ভ্রমণ বাতিল করাই ভালো। পাশাপাশি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে স্বাস্থ্যপরীক্ষা ও ওষুধ খেতে হবে। জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন এমন কারো সঙ্গে ঘনিষ্ট হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। যদি মাস্ক ব্যবহার করা হয়, তবে নাক ও মুখ ভালোভাবে ঢেকে রাখতে হবে। মাস্ক পরলে তা বার বার স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। একবার মাস্ক ব্যবহারের পর ফেলে দিতে হবে। মাস্ক ধরার পর হাত ধুয়ে নিতে হবে। যদি ভ্রমণের সময় অসুস্থবোধ হয়, তবে সঙ্গে সঙ্গে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে। এর আগে রোগের ইতিহাস থাকলে সেটাও চিকিৎসককে জানাতে হবে। যেখানে সেখানে বা জনসমাগমের স্থানে থু থু ফেলা যাবে না। অসুস্থ প্রাণী ধরা থেকে সতর্ক থাকতে হবে। এই যে সতর্কতাগুলো আছে সেগুলোকে আবারো মেনে চলতে হবে। এই করণীয় সতর্কগুলো মানতে জনগণকে বাধ্য করতে হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। এক কথায় অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে কঠোরভাবে।

এটাকে সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। সামুদ্রিক ঢেউ যেমন উঠানামা করে তেমনি করোনাভাইরাসের সংক্রমণও বাড়ে এবং তারপর আবার কমে আসে। এই উঠানামা বা বাড়াকমার প্রত্যেকটা ধাপকে বলা হয় ঢেউ বা ওয়েভ। এর কোনো আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞা নেই। যুক্তরাজ্যে ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মাইক টিলডেসরির মতে, ‘এটা ঠিক বৈজ্ঞানিক কিছু নয়, ওয়েভ বলতে আপনি যা বোঝাবেন সেটা অনেকটাই আবেগ-নির্ভর’।

নিউজিল্যান্ডে ২৪ দিন পর এবং বেইজিং ৫০ দিন ভাইরাসমুক্ত থাকার পর সেখানে নতুন করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে দেখা যায়। কিন্তু সেখানে দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হেনেছে সেটা বলা যাবে না। কিন্তু কোনো কোনো বিজ্ঞানী মনে করেন ইরানে যেভাবে পুনরায় সংক্রমণ ঘটছে, তাকে সেকেন্ড ওয়েভের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। তবে সংক্রমণ দ্বিতীয় দফায় ফিরে আসা নিয়ে অনেকের মধ্যে উদ্বেগ থাকলেও কোনো দেশে সেরকম কিছু ঘটবে কিনা সেটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।

সুতরাং যাই ঘটুক না কেন, আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধি, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক ব্যবহারসহ বিভিন্ন বিষয়ে সতর্ক থাকার বিকল্প কিছু নাই। নিজ নিজ করণীয় কাজগুলো করলে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ জয় করা সম্ভব বলে মনে করছি।

 

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী

gopalodikari1213@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads