• মঙ্গলবার, ৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

বাঙালি জাতিকে মেধাহীন করতেই বুদ্ধিজীবী হত্যা

  • প্রকাশিত ১৪ ডিসেম্বর ২০২০

মুহাম্মদ ফারুক খান এমপি

 

 

১৪ ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। এইদিনে সমগ্র বাঙালি জাতি গভীর কৃতজ্ঞতায় ও বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করে থাকে বাংলার সেই সব সূর্যসন্তানদের, যারা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের হাতে ঘৃণ্যতম ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন। একটি নতুন দেশকে এগিয়ে নেয়ার মূল চালিকাশক্তিকে ধ্বংস করার গভীর এই নীলনকশার অংশ নিয়েছিল আমাদেরই দেশের গুটিকয়েক নরপিশাচ, যারা কখনোই চায়নি বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে বিশ্বদরবারে পরিচিত হোক। বাঙালি জাতির জাগরণে এসব বুদ্ধিজীবীর অগ্রণী ভূমিকা সবসময়ই তাদের চক্ষুশূলের কারণ ছিল। আর তাই ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই সুপরিকল্পিতভাবে তাদের নিধনে ব্যস্ত ছিল পাকিস্তানি শাসকেরা। 

একটু পেছন থেকে যদি দেখি, তবে এই ক্ষোভের আসল কারণ আরো বিস্তারিত বোঝা যাবে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক একটি অগণতান্ত্রিক এবং অবৈজ্ঞানিক রাষ্ট্র গঠনের শুরু থেকেই লক্ষণীয় যে, বাঙালি বা পূর্ব পাকিস্তানিদের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণ। ’৪৮-এ তারা প্রথম আঘাত হানে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর। জোর করে চাপিয়ে দিতে চায় উর্দুকে আমাদের মুখে। বাঙালি প্রতিবাদ করে। ’৫২-তে রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষা পেলেও, বাঙালির মনে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়।  বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাঙালিরা ধীরে ধীরে এই শোষণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনের সম্মুখ নেতৃত্বে থাকতেন রাজনীতিবিদরা, পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের বুদ্ধিজীবীরাও একে বেগবান করে তোলেন তাদের বুদ্ধিদীপ্ত লেখভাষ্যের মাধ্যমে। তারাই  সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বাঙালিদের বাঙালি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন নানাভাবে। বুদ্ধিজীবীরা তাদের রচনাবলির মাধ্যমে, সাংবাদিকরা কলমের মাধ্যমে, গানের সুরে, শিক্ষালয়ে পাঠদানে, চিকিৎসা-প্রকৌশল-রাজনীতি ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের সান্নিধ্যে এসে তাদের আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করতে থাকেন। ’৬৬-তে যখন বঙ্গবন্ধু ৬-দফার ডাক দিলেন, ততদিনে এদেশের মানুষ এসব সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফলে ধীরে ধীরে নিজেদের দাবি ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে গিয়েছিল যা পরবর্তীকালে তাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের দিকে ধাবিত করে। এজন্যও পরবর্তী সময়ে  বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন।

২৫ মার্চের কালরাতে ‘অপারেশন সার্চলাইটে’র পরিকল্পনার সঙ্গেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। ওই রাতেই অতর্কিতভাবে বেপরোয়া পাকিস্তানি সেনারা অপারেশন চলাকালে খুঁজে খুঁজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে বসবাসরত বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে ওই রাতেই হত্যা করা হয়। পরে যুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের প্রশিক্ষিত আধা-সামরিক বাহিনী, আল-বদর, আল-শামস ও রাজাকাররা তালিকা তৈরি করে। আর সে অনুযায়ী যেখানেই এসব স্বাধীনতাকামী বুদ্ধিজীবীদের খুঁজে পেয়েছে, তাঁদেরকে হত্যা করেছে।

তবে দুঃখের বিষয়, এখানেই শেষ নয়। তাদের আসল পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ঘটে স্বাধীনতার মাত্র কয়েকদিন আগে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের শাসকেরা নিশ্চিত পরাজয় অনিবার্য জেনে ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে চালায় পৃথিবীর জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ। এদেশের কিছু মানুষরূপী পশু নিজেরা বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে, পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিয়েছিল বাংলার সূর্যসন্তানদের। 

মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব বুদ্ধিজীবী দেশ ও জাতির জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ড. মুনীর চৌধুরী, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ড. আনোয়ার পাশা, ড. আবুল খায়ের, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ড. সিরাজুল হক খান, ড. এ এন এম ফাইজুল মাহী, হুমায়ূন কবীর, রাশিদুল হাসান, সাজিদুল হাসান, ফজলুর রহমান খান, এন এম মনিরুজ্জামান, এ মুকতাদির, শরাফত আলী, এ আর কে খাদেম, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, এম এ সাদেক, এম সাদত আলী, সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য, গিয়াসউদ্দিন আহমদ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. হবিবুর রহমান, ড. সুখারঞ্জন সমাদ্দার ও মীর আবদুল কাইউম।

অন্যদিকে চিকিৎসকদের মধ্যে রয়েছেন ডা. ফজলে রাব্বী,  ডা. আলীম চৌধুরী, ডা. এম মর্তুজা, ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ, ডা. আজহারুল হক, ডা. সোলায়মান খান, ডা. আয়েশা বদেরা চৌধুরী, ডা. কসির উদ্দিন তালুকদার, ডা. মনসুর আলী, ডা. মফিজউদ্দীন খান, ডা. জাহাঙ্গীর, ডা. নুরুল ইমাম, ডা. এস কে লালা, ডা. হেমচন্দ্র বসাক, ডা. ওবায়দুল হক, ডা. আসাদুল হক, ডা. মোসাব্বের আহমেদ, ডা. আজহারুল হক এবং ডা. মোহাম্মদ শফী।

এছাড়াও সাংবাদিকদের মধ্যে শহীদুল্লাহ কায়সার, নিজামুদ্দীন আহমেদ, সেলিনা পারভীন, সিরাজুদ্দীন হোসেন, আ ন ম গোলাম মুস্তফার নাম করতে হয়। আরো রয়েছেন সুরস্রষ্টা আলতাফ মাহমুদ, রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, সমাজসেবক রণদাপ্রসাদ সাহা ও নূতন চন্দ্র সিংহ, শিক্ষাহিতৈষী যোগেশ চন্দ্র ঘোষ ও ড. আবুল কালাম আজাদ, আইনজীবী নজমুল হক সরকার এবং লেখক-চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান-সহ নাম জানা-অজানা অনেকেই। এসব নাম এখানে উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে গুটিকয়েকজন ব্যতীত এদের অনেকের নাম আজ আর উচ্চারিত হয় না। অথচ আমাদের উত্তর প্রজন্মের এদের সম্পর্কে জানা উচিত।

বাংলাপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা এমন— শিক্ষাবিদ ৯৯১ জন, সাংবাদিক ১৩, চিকিৎসক ৪৯,  আইনজীবী ৪২ এবং অন্যান্য ১৬ জন। স্বাধীনতাবিরোধী চক্র বুঝতে পেরেছিল, তাদের পরাজয় নিশ্চিত। তারা আরো মনে করেছিল, বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা বেঁচে থাকলে এ দেশ উন্নতির চরম শিখরে উঠবে। তাই পরিকল্পিতভাবে জাতিকে মেধাহীন ও পঙ্গুত্ব করতে দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের বাসা এবং কর্মস্থল থেকে রাতের অন্ধকারে পৈশাচিক কায়দায় চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যায়।

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরের হত্যাকাণ্ড ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম বর্বর ঘটনা, যা বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষকে স্তম্ভিত করেছিল। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের পর ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের লাশ ফেলে রেখে যায়। বর্বর পাকবাহিনী ও রাজাকাররা এদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পৈশাচিকভাবে নির্যাতন করেছিল। বুদ্ধিজীবীদের লাশজুড়ে ছিল আঘাতের চিহ্ন। চোখ, হাত-পা বাঁধা, কারো কারো শরীরে একাধিক গুলি, অনেককে হত্যা করা হয়েছিল ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে। লাশের ক্ষতচিহ্নের কারণে অনেকেই তাঁদের প্রিয়জনের মৃতদেহ সেদিন শনাক্ত করতে পারেননি।

স্বাধীনতা যুদ্ধের দীর্ঘ ৯ মাস ধরেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসররা নিরীহ লোকজনকে নির্বিচারে হত্যা করেছে। তার পরও যখন তাদের শেষরক্ষা হলো না, বাংলার দামাল ছেলেদের অব্যাহত পাল্টা আক্রমণে দিোহারা, মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় যখন আসন্ন, তখনই পাকিস্তানি বাহিনী মরণ কামড় হিসেবে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়ন করে।

আজকের এই দিনে দাঁড়িয়ে, আমরা আবারো অনুধাবন করি আমরা কী হারিয়েছি। এই আলোকিত মানুষগুলো বেঁচে থাকলে আজ বাংলাদেশকে আরো বহু দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো, তারা তাদের মেধা ও শ্রম দিয়ে এ জাতিকে নিয়ে যেতেন এক অনন্য উচ্চতায়। দুর্ভাগ্য আমাদের। কিন্তু আমরা ভুলিনি সেই সব সূর্যসন্তানকে। তাই বুদ্ধিজীবী দিবস পালন সবচেয়ে সার্থক হবে তখনই, যদি আমরা সেই চেতনাকে হূদয়ে ধারণ করি এবং সেই চেতনার যথাযথ বাস্তবায়নে কাজ করে যাই। আজো স্বাধীনতাবিরোধীরা নানা কৌশলে সেই চেতনার স্তম্ভকে  আঘাত করতে চাইছে। কিন্তু চেতনা রক্ষায় আমাদের তরুণ প্রজন্মকে সদা সজাগ ও ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। একাত্তরের ঘাতকদের যেমন ঘৃণা করতে হবে, তেমনি তাদের প্রগতিবিরোধী চিন্তা-চেতনাকেও সচেতনভাবে বর্জন করতে হবে। তাহলেই কেবল আমাদের স্বপ্নের সোনার বাংলা পৃথিবীর বুকে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।

 

লেখক : আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads