• মঙ্গলবার, ৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

বুদ্ধিজীবী হত্যা ছিল ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র

  • প্রকাশিত ১৪ ডিসেম্বর ২০২০

অলোক আচার্য 

 

১৬ ডিসেম্বর বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়ের ঠিক আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নতুন ঘৃণ্য একটি ষড়যন্ত্র করে। মূলত যখন তারা দেখল সার্বিক পরিস্থিতি তাদের প্রতিকূলে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোনোভাবেই রোধ করা যাবে না, পাকিস্তানের তৎকালীন মিত্র রাষ্ট্রগুলোও যখন পাকিস্তানকে আর সাহায্য করতে পারছিল না তখনই তারা ঘৃণ্য এক ষড়যন্ত্র করে। তারা দেশের খ্যাতনামা মানুষদের তালিকা তৈরি করে হত্যা করতে আরম্ভ করে। এর প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল স্বাধীন দেশ মাথা তুলে দাঁড়াতে গেলে এসব বুদ্ধিজীবীর পরামর্শ এবং দিকনির্দেশনা একান্তভাবে প্রয়োজন হয়। তাই আমাদের অগ্রগতিটা যেন শ্লথ হয় সে ব্যবস্থা তারা করতে চেয়েছিল। তারা নির্মমভাবে বেছে বেছে মেধাবী মানুষগুলোকে হত্যা করে। এই লিস্ট তৈরিতেও পাকিস্তান বাহিনীকে সাহায্য করেছিল এ দেশের রাজাকাররা। মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সারের মতো মেধাবী মানুষদের ওরা হত্যা করে। তারপর তাদের রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে ফেলে রাখে। যুদ্ধ এবং তার পরবর্তী পরিস্থিতিতে একটি দেশের পরিচালনা অত্যন্ত কঠিন কাজ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সুদৃঢ় নেতৃত্বে সেই কঠিন কাজটিই করছিলেন। যদি এই মেধাবী মানুষদের নির্মমভাবে হত্যা করা না হতো তাহলে দেশের অগ্রগতি আরো ত্বরান্বিত হতো। সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতিতে বাংলাদেশ আরো অগ্রসর হতো। কারণ এই বুদ্ধিজীবীরা তাদের স্ব-স্ব ক্ষেত্রে ছিলেন একজন নক্ষত্র। তারা নতুন স্বাধীন দেশে যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে দেশটা আরো দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেত। এর ফলে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। কয়েকদিন আগে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের জননী তারামন বিবি মারা গেছেন। তার আগে বিদায় নিয়েছেন একাত্তরের জননীখ্যাত রমা চৌধুরী। একটি যুদ্ধ, একটি স্বাধীন দেশ পাওয়ার জন্য বহু মানুষের রক্ত, সম্মান, সাহস আর শক্তির সমন্বয় প্রয়োজন হয়। তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন হয় একটি স্বপ্নের, স্বাধীনতার স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন একদিন বাঙালি দেখেছিল। সেই স্বপ্ন বাঙালির চোখে এঁকে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যার হিসাব করে। ভয়াবহতার হিসাব করে না। নৃশংস ও নির্মমতার দিক থেকে পৃথিবীর যে-কোনো গণহত্যার চেয়ে ভয়ংকর ছিল পাকিস্তানিদের গণহত্যা। নির্মম বা নৃশংস কোনো শব্দই এই নির্মমতা প্রকাশের জন্য যথেষ্ট নয়। যেখানে এক রাতেই রক্তের নদী বানিয়ে ফেলেছিল ঢাকা শহরে। একদিন পৃথিবীতে আমাদের সেই বীর মানুষ থাকবেন না। সময়ের সাথে সাথে আমরা তাদের হারিয়ে ফেলব। কিন্তু তাদের স্বপ্ন, তাদের দেখানো পথ আমাদের সামনে থাকবে। আমাদের মাঝেই তারা বেঁচে থাকবেন। স্বাধীনতা একটি স্পর্শমণি যা প্রত্যেকেই চায়। আমরাও চেয়েছিলাম। অনেক ত্যাগ, অনেক শ্রম আর বুকের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্পর্শমণি পেয়েছি।

বাংলাদেশে গণহত্যা বইতে সিডনির শৈল চিকিৎসক ড. জিওফ্রে ডেভিস তার মতামতে বলেছেন, ধর্ষিত মহিলাদের সংখ্যা সরকারি কর্মচারীদের হিসাবে আনুমানিক দুই লাখ হলেও তার মতে এ সংখ্যা অনেক কম করে অনুমান করা হয়েছে। তিনি মনে করেন এই সংখ্যা চার থেকে চার লাখ ত্রিশ হাজারের মতো হতে পারে। তিনি আরো বলেন, অন্তঃসত্ত্বা মহিলার সংখ্যাই দুই লাখ। এসব মহিলার অনেকেই যৌন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন আবার অনেকেই বন্ধ্যাত্ব বরণ করেছেন। অনেক মহিলাকেই যুদ্ধের পর স্বামী ছেড়ে গেছে। অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করেছেন। সুতরাং পরিবার-পরিজনহীন একাকী জীবন সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা এসব বীরাঙ্গনাকে মর্যাদার আসনে বসাতে হবে। তাদের প্রাপ্য নিশ্চিত করতে হবে। শুধু বীরাঙ্গানা নয়, আজো অনেক মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পায়নি তাদের উৎসর্গের। যেসব মানুষ আমাদের একটি স্বাধীন দেশ এনে দিতে জীবন বাজি রেখেছেন তাদের কেউ কেউ আজো অবহেলিত। দেশকে ভালোবেসে যাওয়াই তাদের একমাত্র সান্ত্বনা। কিন্তু তাদের জন্য কিছু না করতে পারাটা আমাদের ব্যর্থতা। আমরা চাই একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যিনি এ দেশের জন্য রণাঙ্গনে জীবন বাজি রেখেছিলেন তিনি তার কর্মের স্বীকৃতি পাক। এসব মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে বের করে তাকে তার সম্মান দেওয়া হোক। একজন মুক্তিযোদ্ধা যদি আজো রিকশার প্যাডেলে জীবন চালান তাও আমাদের জন্য লজ্জার। তাদের ঋণের শোধ না হলেও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা করাই যায়। 

সত্যিকার অর্থে দেশকে এগিয়ে নিতে আজকের প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন করতে হবে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করাটা যে কতটা সৌভাগ্যের তা কেবল স্বাধীন দেশে জন্ম নেওয়া, বেড়ে ওঠা একটি শিশুই বলতে পারবে। যার একটি সুন্দর শৈশব থাকবে, যে নির্ভয়ে খেলা করবে, লেখাপড়া শিখবে। কারণ পৃথিবীতে আজ যারা স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে তাদের নির্মম পরিণতি চোখের সামনে দেখছি। আমরা ফিলিস্তিনের সংগ্রাম দেখছি। এমনকি একটু বেঁচে থাকার স্বাধীনতার জন্য মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সংগ্রামকে দেখছি। বহু জাতি বহু সংগ্রাম, যুদ্ধ, রক্ত, ইজ্জত, সম্পদ হারিয়েছে কেবল স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার জন্য। আমরাও করেছি। দীর্ঘ নয় মাস করেছি। রক্ত দিয়েছি, সম্পদ দিয়েছি, ইজ্জত দিয়েছি। সব দিয়েছি শুধু দেশ স্বাধীন করার জন্য। দেশ স্বাধীন মানে আমাদের নিজস্বতা অর্জন করা। বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করা প্রতিটি মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করে। ছোটবেলায় ব্যাকরণ বইয়ের ভাব সম্প্রসারণে পড়েছি, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। কিন্তু তখন এর অর্থ পুরোপুরি বুঝতে পারিনি। কথাটির গভীরতা এখন বুঝতে পারি। স্বাধীনতা বলতে যা বোঝায় তা ধরে রাখা এবং মুক্তিকামী মানুষের স্বপ্নের দেশে পরিণত করাটাই চ্যালেঞ্জের বিষয়। কতটা চ্যালেঞ্জের তা আমরা বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে বুঝতে পারি। কারণ প্রতি পদক্ষেপে বাধা আসবে। একটি রাষ্ট্র গঠনের জন্য দরকার ভূখণ্ড, সার্বভৌমত্ব, জনগণ ও সরকার। কিন্তু সেই রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন ঘুষ, দুর্নীতিমুক্ত হওয়া। আমাদের স্বাধীনতার উদ্দেশ্য আজ বাধাগ্রস্ত করছে অসৎ মানুষদের অসৎ মনোভাব। এক শ্রেণির অসাধু মানুষ ঘুষ নামক শব্দটিকে তাদের জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেলেছে। যার জাল ছিঁড়ে মুক্ত হওয়া  যাচ্ছে না। সেই জাল ছিঁড়ে মু্ক্ত করার দায়িত্ব নিতে হবে আজকের তরুণ প্রজন্মকে, যারা এই দেশটাকে ভালোবাসে। দেশের জন্য কাঁদে। জাতীয় সংগীতে যাদের কণ্ঠ সুর মেলায় তাদের হাত ধরেই আসবে প্রকৃত স্বাধীনতা।

এক সময় এই দেশটা দুর্নীতিতে প্রথম হয়েছে। অত্যন্ত লজ্জাজনক সে সময়টা আমরা পেছনে ফেলে এসেছি। আজ আর সেকথা মনে করতে চাই না। কিন্তু আর যেন বিশ্বের দরবারে আমাদের লজ্জা না পেতে হয় সে শপথ নিতে হবে। দুর্নীতি এখনো সমাজটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। সে অবস্থা থেকে বের হতে হবে। না হলে সেই স্বাধীনতার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। যে লাল সবুজ পতাকা আমরা পেয়েছি তা যেন সবার ওপরে নিয়ে ওড়াতে পারি সে দায়িত্ব কিন্তু আমাদেরই। কারণ যখনই কোনো কারণে এই সোনার দেশটার দিকে বিশ্ব আঙুল তুলে অভিযোগ করে আমাদের বুঝতে হবে তার দায় আমাদেরই। কারণ এই মানুষগুলোর জন্যই দেশটার দিকে অভিযোগ ওঠে। ধর্মীয় সম্প্রীতির এক অনন্য উদাহরেণর নাম বাংলাদেশ। সেই আদিকাল থেকেই এদেশে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান পাশাপাশি হাত ধরে বসবাস করে আসছে। স্বাধীনতার পর থেকেও একই পতাকার নিচে আমরা সবাই আজ বসবাস করছি। আমরা চাই না এদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ঘিরে ফেলুক। সব ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী যেন শান্তিতে বসবাস করতে পারে। স্বাধীনতার এটাও উদ্দেশ্য। দেশ নিয়ে একটি কথা আমাকে খুব টানে। সেটা হলো দেশ তোমাকে কি দিয়েছে তা বড় কথা নয়, তুমি দেশকে কি দিতে পেরেছ সেটাই বড় কথা। সত্যি তো, স্বাধীনতার তো বহু বছর পার হয়ে গেল। কি দিতে পেরেছি দেশটাকে। কতটুকুই বা দিতে পেরেছি। দেশের কাছে এট চাই ওটা চাই কিন্তু আমি কি দিচ্ছি। দেশটা তো আমাদের। বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে দেশটাকে সাময়িকভাবে অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করতে পারলেও বাস্তবিক পক্ষে আমরা আজ বহুদূর এগিয়েছি। কাউকে যে জোর করে দাবিয়ে রাখা যায় না তা আজ প্রমাণিত। পাকিস্তান নিজেরাই তাই আজ বাংলাদেশের উন্নতি দেখে অবাক। অবাক সারা বিশ্ব। সেই হারানো মানুষগুলো নেই ঠিক কিন্তু তাদের দেখানো তাদের স্বপ্ন দেখা পথ তো আছে। সে নিয়েই আমরা দুর্বার গতিতে সামনে এগিয়ে যাব।

 

লেখক : সাংবাদিক ও গদ্য লেখক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads