• মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

বীর মুক্তিযোদ্ধা মং ঞো হ্লা অং ও তার আদিবাসী

  • প্রকাশিত ৩১ জানুয়ারি ২০২১

হাফিজ রশিদ খান

 

 

 

আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ প্রাগৈতিহাসিক, প্রাচীন ও মধ্যযুগবাহিত হয়ে একটি অতি প্রাচীন ভূখণ্ড। গঙ্গাঋদ্ধি নামে ছিল এটির পরিচয়। বৃহত্তর ভারতীয় উপমহাদেশের অংশ ছিল এটি। আজকের হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান রাষ্ট্রও ওই উপমহাদেশের অন্তর্গত। তবে সেই প্রাচীন বৃহত্তর ভারতের অস্তিত্ব আর নেই। আজকের বাংলাদেশ, হিন্দুস্তান বা ভারত ও পাকিস্তানের মানচিত্রের বাইরে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদায় সমাসীন। আবার উল্লিখিত ভারতীয় উপমহাদেশটি কখনোই একজাতি-একভাষা বা এক ধর্মবিশ্বাসের ভূখণ্ড ছিল না। এমনকি বৃহত্তর ভারত থেকে ক্রমে আলাদা হওয়া বর্তমানের স্বাধীন বাংলাদেশ ও পাকিস্তানও একজাতি, একভাষা বা এক ধর্মবিশ্বাসের রাষ্ট্র নয়। ভারতের বুকে বহুজাতিত্বের অস্তিত্বের বাস্তবতাকে স্মরণ করে এবং সেই বহুজাতিসত্তার বিকাশে আস্থা রেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একদা ‘ভারততীথর্’  নামক কবিতায় বলেছিলেন : ‘দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে/এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে ...।’

বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বহুজাতির বসবাসের মধ্যে যাদের কথা প্রায়ই অনুল্লিখিত থেকে যায় তাদের সাধারণ পরিচয় ‘উপজাতি’। সমকালীন সংজ্ঞা অনুসারে তাঁরা আসলে ‘আদিবাসী’। বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সুবোধ ঘোষের ভাষায়, ‘আদিবাসী কথাটি নতুন। বর্তমান ভারতের রাজনৈতিক আন্দোলনের সম্পর্কে ভারতের কতগুলি শ্রেণি ও সমাজের নতুন নামকরণ হয়েছে। সাধারণত যাদের আদিম অধিবাসী (Aborigines) বলা হয়, আধুনিক সমাজতাত্ত্বিক পরিভাষায় তাদেরই আদিবাসী বলা হয়েছে। ভারতের নদীবিধৌত শস্যশ্যামলা উর্বর অঞ্চলে আদিবাসীদের দেখা যায় না। গিরিবহুল আরণ্য অঞ্চলের নিভৃত ক্রোড়ে আদিবাসীরা আশ্রয় নিয়েছে। কোথাও অনড় প্রাচীন ব্যবস্থা ও বিধানের মধ্যে এরা অচল হয়ে আছে। কোথাও নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে হারিয়ে এরা আগের তুলনায় দীন হয়ে পড়েছে এবং কোথাও বা আধুনিক যুগের রীতিনীতির সঙ্গে কিছুটা খাপ খাইয়ে একটা পরিবর্তনকে বরণ করে নেওয়ার চেষ্টা চলছে।’

এ কথা সমকালীন বাংলাদেশের আদিবাসীদের বেলায়ও অনেকটা সত্য। বাংলাদেশে বৃহত্তর বাঙালি জাতিসত্তার পাশে প্রায় পঁয়তাল্লিশটির মতো আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী সুদীর্ঘকাল থেকে বসবাস করে আসছে একই বাস্তবতার মোকাবিলা করে। তার মধ্য থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাস করে এগারোটি ক্ষুদ্রজাতিগোষ্ঠী। যেমন :  চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তন্চংগ্যা ম্রো বা মুরং, খুমি, লুসাই, বম, চাক, খেয়াং ও পাংখো।

এখানে মারমা আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর একজন সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধ মং ঞো হ্লা অং আমাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। বিভিন্ন সময়ে তার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও সেই সময়ের পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং তাঁর অনুভব-অনুধাবনা নিয়ে যৎকিঞ্চিৎ কথাবার্তা হয়। সেসবের ভিত্তিতে এ লেখা গড়ে উঠেছে।

মং ঞো হ্লা অং-এর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ছিল জাতিসত্তাগত টানে নয়, স্বাধীন ও সার্বভৗম ভূখণ্ডগত চেতনার আলোকে। কারণ তিনি জাতিগতভাবে বাঙালি নন। অথচ জন্মসূত্রে ছিলেন এ মাটিরই সন্তান। খাগড়াছড়ি রাঙামাটি ও বান্দরবানের মুক্তিযোদ্ধা ও সচেতনমহলে ‘মং বাবু’ নামে পরিচিত এই মুক্তিযোদ্ধার জন্ম ১৯৪৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর চিকনিয়াখীল দাঁতমারা ইউনিয়ন (বর্তমান বাগান বাজার), ফটিকছড়ি-চট্টগ্রামে। তার পিতার নাম সুরেশী মগ। ৮ বছর বয়সে পার্বত্য চট্টগ্রামের রামগড়ে তার আগমন। আর ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন পার্বত্য বান্দরবান জেলায়, সত্তরোর্ধ্ব বয়োসীমায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ছিলেন পূর্ণ যুবক। মং ঞো হ্লা অং-এর ভাবনার সূত্রটি ব্যাখ্যা করলে যা ক্রমশ খোলসা হতে থাকে তা অনেকটা এ রকম : ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বানানো পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ভঙ্গুরদার্শনিক ভিত্তি নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল। ওই রাষ্ট্র সূচনাতেই এমন কিছু মৌলিক সমস্যা নিয়ে আবির্ভূত হয়, যা এতদঞ্চলের সচেতন-শিক্ষিত মানুষকে অস্বস্তির চোরাবালিতে নিক্ষেপ করে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বৃহৎ জনগোষ্ঠী ধর্মবিশ্বাসে ছিলেন মুসলমান। এবং উভয় পাকিস্তানে তারা ছিলেন সংখ্যগরিষ্ঠ। একই সঙ্গে নৃতাত্ত্বিক ও জাতিসত্তাগত পরিচয়ে তারা বাঙালি। পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে বৌদ্ধিক চেতনায় আপোষকামী বাঙালি মুসলমানদের একটি অতিক্ষুদ্র অংশ বৃহৎ জনসমাজের ওই পরিচয়ের দ্বিতীয় অংশটি নির্মমভাবে মুছে ফেলে নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে তীক্ষ নজর রেখে মুসলিম পরিচয়টিকেই মুখ্য করে তুলতে প্রয়াস পায়। কালক্রমে দেখা গেল, রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায় থেকে ওই ধর্মীয় পরিচয়টিকেও ইসলামের সাম্য-মৈত্রীর স্থান থেকে কৌশলে বিচ্যুত ও অবনমিত করে বাঙালি মুসলমানদের স্থান নির্ধারণ করা হচ্ছে নিম্নবর্গ বা ‘আতরাফ’ শ্রেণির কাতারে। এই খণ্ডায়ন, অপমান ও অবনমন প্রক্রিয়ার অবস্থান থেকে পূর্ববাঙলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের ভাষা-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্যের ওপর ক্রমাগত নেতিবাচক প্রচারণা ও ছুঁৎমার্গীয় আচরণের প্রকাশ ঘটে শাসকমহলের তরফে। এই বাস্তবতার অনুধাবনে বাঙালি মুসলমানের প্রাগ্রসর অংশটির মনে তীব্র ক্লেশ ও ক্ষোভ উপস্থিত হয়। এই ক্লেশদীর্ণ অংশটির প্রতিবাদী ও সংগ্রামী চৈতন্যমথিত পাল্টা বৌদ্ধিক প্রতিবেদনই হচ্ছে ১৯৪৮ সালে উর্দুর সমমর্যাদায় বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনের সূত্রপাত।

পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে তাকালে এ ধারণা দিবালোকের মতো স্পষ্টতা পায় যে, একটি রাষ্ট্রে দুটি রাষ্ট্রভাষা থাকাটা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। ইউরোপের বেলজিয়াম রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৩০ সালে। প্রথমে ফরাসিকে তাঁরা রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ করে। কিন্তু দশ বছর না-যেতেই ফ্লেমিশদের দিক থেকে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ওঠে। তারাও তো বেলজিয়ান। তাহলে তাদের ভাষা কেন ফরাসির সমমর্যাদা পাবে না?  ফলে ১৮৯৮ সালে আইন সংশোধন করে ফরাসি ও ফ্লেমিশ উভয় ভাষাকেই বেলজিয়ামের জাতীয় ভাষারূপে স্বীকৃতি দেয়া হয়। অন্যদিকে সুইজারল্যান্ডে ১৮৭৪ সালে শাসনতান্ত্রিকভাবেই  ঠিক করা হয় যে, তাদের জাতীয় ভাষা হবে তিনটি : জার্মান, ফরাসি ও ইতালিয়ান। এ তিনটি ভাষার ব্যবহার শুধু প্রশাসনের কাজকর্ম সম্পাদনের উদ্দেশ্যে ওপরের দিকেই সীমাবদ্ধ থাকবে। আর নিচের দিকে জেলা অনুসারে ভিন্ন-ভিন্ন ভাষায় প্রশাসনের কাজকর্ম চলবে। এছাড়া বেসরকারিভাবে ইংরেজি ভাষার ব্যবহারকেও মেনে নেয়া হয়।

১৯৪৮ সালে ভাষাভিত্তিক ওই আন্দোলনের মাধ্যমে যা জানিয়ে দেয়া হলো রাষ্ট্রাচালকদের কাছে তা স্পষ্টভাবে বোধগম্য হলেও ইতিহাসজ্ঞানের অপূর্ণতা কিংবা স্বৈরাচারী মনোভাবে সমাচ্ছন্ন অন্ধত্বের কারণে তাদের ভান্ডারে এমন কোনো জোরালো, ইতিবাচক প্রতিরোধক মন্ত্র বা অস্ত্র রইল না যার প্রয়োগে প্রশমিত হবে পূর্ববাংলার জনমানসের ওই সংক্ষুব্ধ বাস্তবতা। অতএব দৃষ্টির গাঢ় আবিলতার কারণে দমন-পীড়ন, শোষণ-নির্যাতন নামক নেতিবাচক বিবিধ শাস্ত্রের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাছে আর কোনো পথ খোলা রইল না। পরবর্তীকালে ১৯৫২-এর আরো বড় পরিসরের ভাষাকেন্দ্রিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিস্ফোরণ থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ওই ভঙ্গুর দর্শনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

তারুণ্যের প্রত্যয় ও স্বপ্নময়তার ভেতরে মারমা আদিবাসী যুবক মং ঞো হ্লা অং উপলব্ধি করলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানে যে-রাজনৈতিক জাগরণ শুরু হয়েছে, ‘যেমন কুকুর তেমন মুগুর’ বা ‘শঠে শাঠ্যং’ নীতিতে তা সমর্থনযোগ্য। তাঁর ব্যক্তিচৈতন্যও যেন তাঁকে জানালো, জাতীয়তাবাদের প্রধান উপাদান তো ধর্ম নয়, প্রধান উপাদান ভাষা। তাঁর দৃষ্টিতে ভাষাকেন্দ্রিক এই জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে শামিল হবার কারণ ছিল, একটি ভুল, মিথ্যা ও নড়বড়ে ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে চাওয়া বহিরাগত, বিভাষী শোষকশ্রেণিকে প্রতিহত করা। যারা স্বর্গাদপী গরীয়সী জন্মভূমিতে পঙ্গপালের মতো বেমামান। তাদের এ ভূমি থেকে বিতাড়ন অবশ্য কর্তব্যের অংশ। স্বদেশের বুকে এই নৈরাজ্যিক তাণ্ডব মেনে নেয়া যায় না। যুগপৎ এই জাজ্বল্যমান সংকট ও তা থেকে উচ্ছ্রিত চেতনার অলাতবহ্নি থেকে  নিজেকে পৃথক করে রাখার কোনো যুক্তি তার কাছে ছিল না। আর তাই সুদূরবর্তী আশার মান্দাসে ভর করে যুদ্ধে গিয়েছিলেন মং বাবু। সেই আশা পূর্ণতা পেয়েছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। মাতৃভূমি মুক্ত হয়েছে শোষণ-নিপীড়ন, বৈষম্য, অবদমন, ধর্ম, জাতি ও ভাষাগত বঞ্চনা থেকে। একটা গভীর কালো যবনিকা, যা দুর্বিষহ মনোদৈহিক প্রতিবন্ধকতা হিশেবে ছিল দীর্ঘদিন, সরে গেল যেন চিরতরে।

স্বাধীনতা অর্জনের পর, যুদ্ধোত্তর পরিবেশ থেকে পুনর্গঠনের পথে উত্তরণের কঠিন সময়ে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সরকার নানা দেশি-বিদেশি অপশক্তির মোকাবিলায় সামর্থ্যের পরিচয় দিতে অপারগ হয় তার অভ্যন্তরে বিদ্যমান বিভীষণচক্রের অশুভ তৎপরতার কারণে। ধীরে দেশ চলে যেতে লাগলো গভীর-গভীরতর অনিশ্চয়তার দিকে। বিপথগামী কিছু সেনাসদস্য কর্তৃক পনেরো আগস্ট জাতির পিতার অনাকাঙ্ক্ষিত হত্যাকাণ্ডের পর যারাই ক্ষমতায় এলেন এবং গেলেন তাদের সকলের অবয়বেই ছিল ভীতি আর সন্ত্রাস উৎপাদনের কালো ছায়া। আরো কোনো বড় বিপর্যয়, আরো কোনো বড় তাইফুনে তাদের তখ্ত উড়ে যায়-উবে যাবে, এমন শঙ্কা তাদের ক্ষমতার দিনগুলোকে স্বস্তি দেয়নি। দেশের মানুষ তাদের কাউকেই প্রকৃত কান্ডারিরূপে মেনে নিতে পারেনি, নীরবতার ভাষায় তারা প্রত্যাখ্যাত হন। পরবর্তীকালে দুর্বার গণআন্দোলনের মুখে পড়ে তারা। অস্ত্রে ভর রাখা ক্ষমতাসীনেরা সর্বমান্য সংবিধানের নীতি-আদর্শ নিয়ে চালালো নানা অনভিপ্রেত কাটাছেঁড়া। একটি প্রগতিমুখী, কল্যাণকামী রাষ্ট্রের যে উচ্চাশা মং ঞো হ্লা অং কে ঘিরেছিল, অঙ্কুরেই তার বিনাশ দেখতে হলো জাতিকেও। সামরিক উর্দির বুটের নিচে চাপা পড়ে গেল সারাদেশ। এই প্রবল দলন ও  প্রতিক্রিয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনপদে দেখা দিল জুম্ম জাতীয়তাবাদী চেতনার স্ফুরণ। এম এম লারমা ও তার সতীর্থরা ওই আওয়াজ তুলে পাহাড়ের তরুণ-যুবাদের চঞ্চল করে তুললেন। তাঁরা নিজেদের উদ্দীপনার ভেতরের অস্ফুট আগুনে পুড়তে লাগলেন দিবানিশি। সরকারি বাহিনী ও তাদের মধ্যে দীর্ঘকালব্যাপী চললো সশস্ত্র, অসম লড়াই। আর পাশাপাশি সামরিক ছাউনির ছত্রছায়ায় পাহাড়ে-পাহাড়ে গড়ে উঠতে লাগল সমতলের ভাগ্যবিড়ম্বিতদের নিয়ে গিয়ে পুনর্বাসিতদের বসতি। এভাবে জনবিন্যাসের আদিধারাটি বদলে যেতে থাকে। নানামুখী ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে জুম্ম জাতীয়তার ধারণাটি যত বিস্তার হতে চাইল, ততটাই তার অভ্যন্তরের অসঙ্গতি ও অসারত্বও দৃশ্যমান হতে থাকলো ক্রমে। দেখা গেল, ওই কনসেপ্টের ভেতরে সকলকে নিয়ে চলার পথ তত সহজ ও মসৃণ নয়। কারণ, পাহাড়ের ওই এগারো জাতিগোষ্ঠীর সকলের আর্থসামাজিক অবস্থান ও মর্যাদা, প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যার্জনের সক্ষমতা তথা সামগ্রিক জীবনযাপনের ধরনধারণ সমমাত্রার নয়। এদের কেউ-কেউ অতি সংখ্যালঘু হতদরিদ্র, তাদের পূর্বপুরুষেরা কোনোদিনও প্রচলিত পড়াশোনার ধারকাছটি মাড়ানোর সুযোগ পাননি। আবার কারো কারো বাপদাদারা সেই মোগল-ব্রিটিশ আমল থেকে সুবিধাভোগীর কাতারে থেকে তাদের উত্তরপুরুষের জন্যে রেখে গেছেন সেই একই সচ্ছল জীবনের সরোবর। এই সামাজিক ও আর্থিক বৈষম্যের সুকঠিন বাস্তবতায় সমমাত্রার আনন্দ বিদ্যমান থাকতে পারে না কোথাও। এই ফাঁকেই কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের নতুন অঙ্কুরোদ্গম অচিরাৎ মাথা তুললো নীরবে। ফলে দ্বন্দ্ব ও বিরোধের নতুন ক্ষেত্রপথে বিভক্ত ও মলিন হলো জুম্ম জাতীয়তার ধারণাটি।

এ অবস্থায় দ্বান্দ্বিকসূত্রের বািবতণ্ডার তিক্ততায় হত্যা ও রক্তপাতের ঘটনাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে দিকে দিকে। গুপ্তহত্যার শিকার হলেন অনেকে। এদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন জাতিগত স্বতন্ত্রতার প্রশ্নে উচ্চকিত। ক্রমে এখানেও নেমে আসে ভাটার টান। কেউ কেউ হতাশ হয়ে সংঘাতের পথ থেকে সরে গেলেন, সেই সঙ্গে সরে গেলেন ‘বিপ্লবী’ জীবনের ব্রত থেকেও। যারা তারপরও সক্রিয় ছিলেন রসদ সংগ্রহ ও গেরিলা জীবনের অপরিহার্য অস্ত্রশস্ত্র জোগাড়ের ক্ষেত্রে, হয়ে পড়লেন একপ্রকার কোণঠাসা। কারণ যে-গোপন উৎস থেকে এতদিন ওসবের সরবরাহ আসতো, সেই উৎসেই দেখা গেল উৎসাহের অভাব।

এ অবস্থায় গত শতকের নব্বই দশকের মধ্যপর্বে অর্থাৎ ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলো। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ভারতের মতের পরিবর্তন, পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার অনুধাবন ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠন জেএসএস-এর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও অনৈক্যের কালিমা আগের জৌলুস হারিয়ে তাকেও ঘরে ফেরার তাগিদ দিতে থাকে। আগের সরকারগুলোর জের ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের সংসদীয় কমিটির সঙ্গে দীর্ঘ সংলাপ চললো জেএসএস নেতৃত্বের। অবশেষে সম্পাদন হলো পার্বত্য চুক্তি ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর। সে এক ঐতিহাসিক দিন বটে। জেএএস গেরিলারা তাদের সশস্ত্র সংগ্রামের ইতি ঘটিয়ে অস্ত্রসমর্পণ করলেন। একটি নতুন পরিপ্রেক্ষিতে প্রবেশ করলো পার্বত্য চট্টগ্রাম ও তার আদিবাসী অধিবাসীরা। সেই সঙ্গে বাংলাদেশও।

এই পরিপ্রেক্ষিতে উনিশ শ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া মং ঞো হ্লা অং ও অন্য পাহাড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের মনোলোক বিচার্য। তাঁরা দেখলেন, রাষ্ট্রযন্ত্রের যে বৈষম্য ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে তারা অস্ত্রহাতে তুলে নিয়েছিলেন, সেই স্বদেশ, সেই রাষ্ট্রটি বৈষম্য ও বঞ্চনা উৎপাটনে আন্তরিক নয়। এ শুধু আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেই নয়, পুরো জাতীয় পরিপ্রেক্ষিতেই অসহ কাঁটার মতো বিদ্যমান। অপরপক্ষে তাঁদের এই অনুভূতিকে রাষ্ট্র বরাবরই ভুল বুঝেছে, ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে গেছে। বিশিষ্ট চিন্তক ও কথাশিল্পী আহমদ ছফা (১৯৪৩-২০০১) তাদের পোষিত ওই অব্যক্ত বেদনাকে যেন মুখর ভাষা দিয়েছেন :

‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একদিকে বাঙালি জাতীয়বাদকে প্রতিষ্ঠার লড়াই, অন্যদিকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার লড়াইও বটে। সকল বাঙালিই ওপরের দুটি লড়াই করেছেন কিন্তু বাঙালি ভিন্ন অন্য জাতিগোষ্ঠী করেছে একটি— সেটি হলো পাকিস্তানের শাসন-জুলুম-নির্যাতন থেকে মুক্তির লড়াই।’

মং ঞে  হ্লা অং-কে যতটা কাছ থেকে দেখেছি, জেনেছি তাঁকে যতটা, আমার মনে হয়েছে তিনি একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে বাকি জীবনটা কাটাতে চেয়েছিলেন। তিনি প্রায়শই প্রাক্তন জার্মান চ্যানসেলর উইলি ব্রান্টের (১৯১৩-১৯৯২) নিচের উক্তিটি উচ্চারণ করতেন  : 

We must more humanity in our society; equal chance in life; more social justice; more freedom for the individual; more securiry with in the country and more cooperation of the citizens in our communal life. Tolerance and solidarity with the fellow citizens should be the permanent policy of a democratic secular country.

 

লেখক : কবি, সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads