• শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

সামাজিক উন্নয়নের বিবিধ সূচক

  • প্রকাশিত ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১

কুমার দীপ

 

 

আর্থসামাজিক অগ্রগতির দৃশ্য ও পরিসংখ্যানই কি সবকিছু? এর বাইরে কি কোনো দৃশ্য বা হিসেবনিকেশ নেই? কোথাও কি কোনো ক্ষত বা খানাখন্দ নেই? আছে। আমরা পাকিস্তানের সাথে তুলনা করেছি; কিন্তু মালয়েশিয়ার সঙ্গে যদি তুলনা করি? রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান অধিকাংশ সময়ই অস্থিতিশীল, সামরিক বাহিনী ও মৌলবাদের হাতের পুতুল হয়ে থেকেছে। আর্থসামাজিকভাবে সেই দেশ তো পিছিয়ে থাকবেই। মালয়েশিয়ার মতো দেশ, যারা এক সময় আমাদের চেয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পিছিয়েই ছিল; গত শতকের সত্তরের দশকে আমাদের দেশ থেকে বহু চিকিৎসক ও প্রকৌশলী আমদানি করেছিল, আশি-নব্বইয়ের দশকেও এ দেশে এসে মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত যে দেশের ছেলেরা, সে দেশ আজ কোথায়? এ দেশ থেকেই ছেলেমেয়েরা এখন মালয়েশিয়ায় যাচ্ছে পড়ালেখা করতে, অনেকেই অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে অবৈধ পথে সমুদ্র সাঁতরাতে গিয়ে ডুবে মরছে! শিক্ষা-স্বাস্থ্য-প্রকৌশল সবদিক থেকে উন্নতি করতে করতে মালয়েশিয়া আজ বিশ্বের শীর্ষ উন্নত দেশগুলোর একটি। ১৯৬৫ সালে যাদের মাথাপিছু আয় ছিল ৩০৪ মার্কিন ডলার, তাদের বর্তমান মাথাপিছু আয় ১২,৭০০ মার্কিন ডলার। কেন এরকম হলো? প্রায় অভিন্ন প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলে দাঁড়িয়ে মালয়েশিয়া এত করল, আর আমরা সেই তুলনায় এত পিছিয়ে থাকলাম কেন? আমাদের সমস্যাগুলো কোথায়? 

বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই ১৯৫২ সালের অক্টোবরে একটি আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে চীনে গিয়েছিলেন। গণপ্রজাতন্ত্র হিসেবে সদ্য আত্মপ্রকাশকারী মাও সে তুং-এর চীনের কর্মকাণ্ড দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছেলিন তিনি। সম্মেলনে যোগদানকারী ৩৭টি দেশের কয়েকশ মানুষের জন্য মাত্র ৭০ দিনেই  তারা গড়ে তুলেছিলেন চারতলা এক বিরাট দালান! চীনের মানুষের কর্মনিষ্ঠা, দেশপ্রেম, দুর্নীতিমুক্ত ও জনকল্যাণমূলক সরকার ব্যবস্থা, জনগণের প্রতি সরকারি কর্মচারীদের অকুণ্ঠ নিবেদন, কারিগরি শিক্ষার প্রসারে ব্যাপক পদক্ষেপ, ঘরে ঘরে কুটিরশিল্প থেকে শুরু করে যে-কোনো ধরনের বৃহৎ শিল্প, তথা সমস্ত পণ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা, চাষের জমি সব কৃষকের মধ্যে সাম্যবাদের ভিত্তিতে বণ্টন, যে-কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিবিধান ইত্যাদি বিষয় নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন তখনকার তরুণ নেতা শেখ মুজিব। ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থের পাতায় পাতায় রয়েছে তার নমুনা। গণচীনের সঙ্গে আমাদের দেশের বিভিন্ন অনুষঙ্গের তুলনাও করেছেন তিনি, যেখানে এ দেশের কেরানি তৈরির শিক্ষা ব্যবস্থা, নারীশিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে পিছিয়ে থাকা, ধর্মের নামে রাজনীতি, সরকার ও সরকারি কর্মচারীদের দেশ ও জনগণের প্রতি দায়হীনতার মতো উদাহরণগুলো তাকে পীড়িত করেছে।

 

কেউ কেউ হয়তো ভাবছেন, আমি ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি কেন? কিন্তু বিজ্ঞ পাঠকেরা উল্লিখিত চীন সফরসংক্রান্ত কয়েকটি লাইনের ভেতরেই হয়তো উত্তর পেয়ে গেছেন। অনুমান করে ফেলেছেন, সমস্যাগুলোর সূত্রসন্ধানে কোন দিকে তর্জনী তুলতে চেয়েছি। আমরা যে কাজ করি না তা নয়; কিন্তু আমাদের কাজের ভেতরে সততা নেই, দেশপ্রেম নেই, জনগণের প্রতি পূর্ণ দায়বদ্ধতা নেই। আমাদের নেতাদের বিরাট অংশই যতটা দেশ ও জনগণের জন্য রাজনীতি করেন, তার চেয়ে অনেক বেশি করেন নিজেদের জন্য; ক্ষমতার ছোঁয়া পেলে তাদের কারো কারো সম্পত্তি আকাশের মেঘ স্পর্শ করে। আমাদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা দেশ থেকে অবৈধ অর্থ রোজগার করে বিদেশে বাড়ি-গাড়ি করেন, খুব সামান্য কর্মচারীও সুযোগ বুঝে দেশের ভেতরে গড়ে তোলেন সম্পদের হিমালয়। যে দেশে পুত্র ঘুষ খায় বলে পিতা গর্ব করেন; স্বামী বেতনের অতিরিক্ত ব্যাপক ইনকাম করেন বলে স্ত্রীর বাহাদুরি চলে; পিতার বিত্তের পাহাড়ে পুত্র গড়ে তোলে পাতালপুরীর রাজত্ব; রাজনীতির অনুকূল বাতাসে ছাত্র হয়ে ওঠে তুমুল সন্ত্রাসী, তুখোড় নারী নির্যাতনকারী, প্রচুর অর্থ-বিত্তের মালিক; যে দেশে জনগণকে চুষে চুষে মুনাফার প্রাচুর্য গড়া ছাড়া অধিকাংশ ব্যবসায়ীদের কোনো মূল্যবোধ নেই; যে দেশের মানুষ যে যেভাবে পারে অন্যকে ঠকিয়ে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করে অবিরাম... সেই দেশের অগ্রগতির গ্রাফটি যতই ঊর্ধ্বমুখী হোক, তার চেয়ে অধিক ঊর্ধ্বমুখী যে হতে পারত এইসব নেতিবাচক অনুষঙ্গ না থাকলে, সেকথা তো সাধারণ বুদ্ধিতেই বলে দেওয়া যায়।

আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলে বিবেকের কাছে দায়ী থাকতে হয়। সেটা হলো মানবিক মূল্যবোধ। বিগত এক দশকে আমাদের আর্থিক অগ্রগতি নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য, সামাজিক উন্নয়নের বিবিধ সূচকে আমরা অনেক এগিয়ে; কিন্তু আমাদের মানবিক মূল্যবোধ দিনে দিনে কোথায় নেমে যাচ্ছে, তার চিত্রও পাচ্ছি প্রতিনিয়ত। স্কুল-কলেজপড়ুয়া ছেলেদের কেউ কেউ সামান্য কারণে হত্যা করছে তার বন্ধু বা প্রতিবেশীকে; দলবদ্ধভাবে প্রকাশ্য হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠছে কোনো কোনো কিশোর গ্যাং। নারীর প্রতি প্রতিহিংসা, ধর্ষণ ও শিশু বলাৎকারের ভয়াবহতা; মৌলবাদের উত্থান ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা-এইসব অতীব অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় মাঝেমধ্যেই আমাদের পীড়িত ও ক্ষতবিক্ষত করছে। আর হ্যাঁ, স্বাধীনতার প্রায় পঞ্চাশ বছরে এসেও বাঙালি সংস্কৃতির পরিপন্থী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী মানুষেরা মাথা তুলতে চায় এ দেশে, স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিরূপ মনোভাব পোষণ করে, তার ভাস্কর্য ভাঙবার দুঃসাহস দেখায়... এ বড়ো বিস্ময়কর বটে! আর্থসামাজিক অগ্রগতির সংখ্যাগত পরিসংখ্যানের বাইরে এসব এক-একটি ক্ষত বটে। কেননা বড়ো বড়ো দালানকোঠা, দীর্ঘ-দীর্ঘতর পিচঢালা রাস্তা, বিরাট বিরাট নদীতে অতিকায় সেতু, হাতে হাতে অ্যান্ড্রয়েড ফোন-ইন্টারনেট আর ঘরে ঘরে বিজলি আলোর বাইরেও এই মানবিক মূল্যবোধ, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তবুদ্ধির চেতনাটিকেও একেবারে ফেলে দেওয়ার নয়। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের অধিকাংশেরই এমন বাঙালির সংস্কৃতিবিমুখ ক্রিয়াকলাপ এবং বইয়ের বদলে ইউটিউব-ফেসবুককেই জীবনের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে বেছে নেওয়া, আগামীর বাংলাদেশের জাতিগত মূল্যবোধ ও সৃজনশীল মেধাবিকাশের জন্য একটি অশনিসংকেত হয়ে উঠতে পারে। আর্থসামাজিক অগ্রগতির সার্বিক সূচকেও তৈরি করতে পারে গভীর ক্ষত।

 

৩.

যদিও করোনা বা কোভিড-১৯ নামের মহামারীর হাতে সারাবিশ্বের মতোই মার খাচ্ছে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য; ব্যাহত হচ্ছে আর্থিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানাবিধ কর্মকাণ্ড, তথাপি অন্য অনেক দেশের চাইতে আমাদের দেশের অবস্থা কিছুটা আশাব্যঞ্জক। আমাদের শ্রমিকেরা যথেষ্ট কর্মঠ, কৃষকেরা উৎপাদনে আলোর দিশারি। বৈদেশিক আয়ের প্রধানতম যে দুটি উৎস, তৈরি পোশাক রপ্তানি ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স আয়; সেখানেও ইতিবাচক তথ্যাদি দৃশ্যমান। বিজয়ের মাস চলছে। চলছে বাঙালির অসামান্য প্রেরণা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষের আনন্দ-আয়োজনও। হ্যাঁ, প্রেরণাই। ছাত্র-শিক্ষক, কর্মচারী-আমলা, রাজনীতিবিদ-সমাজকর্মী, শিল্পী-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিকর্মী সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু সবার জন্যই দিকনির্দেশনা আছে তার জীবন, কর্ম ও বক্তৃতায়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আর্থসামাজিক অগ্রগতির বর্তমান রেখাচিত্র আমাদের দারুণভাবে আশাবাদী করে তুলছে, উন্নত বিশ্বের উচ্চ কাতারে ওঠার তাগিদ দিচ্ছে। আমরা এগিয়ে যাব। তবে এর জন্য অবশ্যই টেকসই পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের এগোতে হবে। অর্থ-বাণিজ্যের পাশাপাশি অবশ্যই সামাজিক-সাংস্কৃতিক সবক্ষেত্রে নজর রাখতে হবে। দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত করতে হবে দেশকে। তবেই আসবে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য। তবেই না সম্পূর্ণ সার্থক হবে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ; স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী।

 

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads