• রবিবার, ১২ মে ২০২৪, ২৯ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

যুক্তিবাদী সমাজ গঠন প্রয়োজন

  • প্রকাশিত ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১

হারুন হাবীব

 

 

 

যে সমাজ ও রাষ্ট্রে মানুষের চিন্তা এবং বিবেকের স্বাধীনতা রক্ষিত হয় না, মুক্তবুদ্ধি চর্চার অধিকার হরণ করা হয়, সে সমাজ ও রাষ্ট্রে অশুভ শক্তির বিকাশ ঘটে। ফলে সহনশীল সংস্কৃতির পরিবর্তে অসহনশীল দানবীয় সংস্কৃতি জায়গা দখল করে নেয় যা রাষ্ট্র ও সমাজকে আক্রান্ত করে, ক্ষতবিক্ষত করে। অতএব আধুনিক জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের মূল শর্ত পক্ষ-বিপক্ষ চিন্তার অধিকার রক্ষা করা। প্রত্যেক মানুষ নিজেকে নিয়ে ভাবার পাশাপাশি ব্যক্তি, পরিবার, জীবন-জীবিকা, সমাজ,  রাজনীতি নিয়ে যেমন ভাবেন; তেমনি ভাবেন ধর্ম নিয়ে, জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে। চিন্তার এই স্বাধীনতা তার স্বাভাবিক জীবনযাপনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই ক্ষমতাই মানুষকে অন্য সব জীব থেকে আলাদা হিসেবে চিহ্নিত করে। এর ব্যত্যয় ঘটলে মানুষ তার মর্যাদা হারায়। অতএব চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা মানুষের সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অধিকার; এ অধিকার হারালে মানুষের সব প্রাপ্তি ও অর্জন তুচ্ছ হয়ে যায়।  

গ্রিক দার্শনিক প্লেটো ও সক্রেটিসই সম্ভবত মানুষের এই অধিকার নিয়ে প্রথম কথা বলতে শুরু করেন। তৃতীয় শতাব্দীতে সম্রাট অশোকের কিছু পদক্ষেপ, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। তবে ইউরোপের বাতাবরণে দার্শনিক থেমিসটাস, মন্টেইগনি, স্পিনোজা, ভলতেয়ারসহ আরো কয়েকজন বিষয়টিকে কয়েক ধাপ এগিয়ে নেন। আধুনিক পর্যায়ে এটি নতুন মাত্রা লাভ করে যখন রানী প্রথম এলিজাবেথ চিন্তার স্বাধীনতারোধে প্রণীত একটি আইন বাতিল করেন। এ সময়েই ইউরোপের নানা জনপদ থেকে ভিন্নমতবাদীরা ইংল্যান্ডে আশ্রয় পেতে থাকেন। ঠিক তখনই  ইতালিতে দার্শনিক ব্রুনোকে হত্যা করা হয়। কারণ তিনি তার মত পরিবর্তন করতে অস্বীকার করেন। বলা যায়, মুক্তচিন্তার ধারাবাহিক সংগ্রামে  প্রথম শহীদ হলেন ব্রুনো।

স্বাধীন মত প্রকাশের ‘অপরাধে’ অনেক দার্শনিক ও লেখককে শাস্তি পেতে হয়েছে, দেশ ছাড়া হতে হয়েছে, এমনকি মৃত্যুবরণও করতে হয়েছে। নাজি জার্মানিতে ভিন্নমতাবলম্বী কারারুদ্ধ হয়েছেন, তাদের বইপুস্তক পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে ভিন্ন মত দমন করা হয়েছে নানান কৌশলে। ধর্ম অবমাননার দায়ে সৌদি লেখক রাইফ বাদাউইকে ১০ বছরের কারাদণ্ড ও ১ হাজার বেত্রাঘাত দেওয়া হয়েছে। ইরানে একের পর এক চলেছে মুক্তবুদ্ধির নিগৃহ। পাকিস্তান আমলে স্বাধীন মত প্রকাশের জন্যে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের প্রচুর নিগ্রহ সইতে হয়েছে। দেশটিতে আজো বহাল আছে ধর্ম রক্ষার নামে ভয়ংকর সব রীতিনীতি, আছে ‘ব্লাসফেমি’ আইন। পলপটের সময় কম্বোডিয়ায় ভিন্নমতের বিরুদ্ধে নারকীয় নিগ্রহ চালানো হয়েছে। চীনেও দমনপীড়ন চলেছে ভিন্নমতের বিরুদ্ধে। চিলিতে পিনোসেটের আমলে চলেছে ভয়াবহ নিপীড়ন। ফ্রাঙ্কোর আমলে নিপীড়ন চলেছে স্পেনে।

ভারত ও বাংলাদেশে মুক্তচিন্তার পরিবেশ আপাতত উন্মুক্ত হলেও বহুক্ষেত্রে তা বাধার সম্মুখীন হয়। ধর্ম রক্ষার জিগির তুলে উগ্রবাদীরা বহুক্ষেত্রেই প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টায় রত। পাকিস্তানে মুক্তচিন্তার মানুষ ভয়ংকরভাবে ভীতসন্ত্রস্ত। ধর্মীয় উগ্রবাদ পাকিস্তান রাষ্ট্রকে বেশিরভাগই গ্রাস করে রেখেছে। ভারতের উগ্র ধর্মবাদীরা প্রায়ই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে যা বড় শঙ্কার কারণ। ধর্মীয় উন্মাদনা কিংবা ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতির শিকার হতে হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তচিন্তার মানুষকে, বিশেষ করে যারা জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী।

কিন্তু এতসবের পরও বলতে হবে, মুক্তচিন্তার বিকল্প নেই; চিন্তার স্বাধীনতার কোনো বিকল্প নেই। এ অধিকার মানুষের শ্রেষ্ঠ অধিকার যা রক্ষা করা জরুরি। যে সমাজ ও রাষ্ট্র এই অধিকার ক্ষুণ্ন করে, সে সমাজ ও রাষ্ট্র সভ্য হয় না, গণতান্ত্রিকও হয় না। সমালোচনাকে মোকাবিলা করতে হয় পাল্টা যুক্তি দিয়ে, পাল্টা সমালোচনা দিয়ে— অস্ত্র দিয়ে নয়, বর্বরতার পথে নয়।

কিন্তু দৃশ্যত তা হয় না। স্বাধীন মত প্রকাশ বা মুক্তবুদ্ধি চর্চার প্রতিপক্ষরা আগের যে কোনো সময়ের চাইতে সঙ্ঘবদ্ধ ও অসহিষ্ণু। এরা তাদের মতের বিরুদ্ধবাদীদের হত্যা করার কৌশলও নিতে পিছপা হয় না! হয়তো তারা এটিই ভাবেন যে, এ পথেই তাদের বিজয় আসবে! কিন্তু তা আসলেই সম্ভব নয়। কোনো সমাজেই এ পথে কেউ বিজয়ী হতে পারেননি। বর্বরতা বা কপটতা কোনো আদর্শ প্রচারের হাতিয়ার হতে পারে না; বরং প্রয়োজন যুক্তিনির্ভর বক্তব্য— যা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করে।

বিশ্বের কোথাও কোনো মতকে পরাস্ত করা গেছে এমনটা ঘটেনি। হয়তো একজন বা কয়েকজনকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, খুন বা হত্যাও করা হয়েছে; কিন্তু মানুষের স্বাধীন  উচ্চারণের  অধিকার পরাস্ত করা সম্ভব হয়নি। লক্ষ করার মতো যে, মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধবাদী ঘাতকরা কখনোই প্রকাশ্যে বিচরণ করেন না, নিজেদের মতের বিরুদ্ধবাদীদের তারা যুক্তির তরবারি দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন না; বরং তারা লুকিয়ে থাকেন এবং নিজের মতের বিরুদ্ধে বক্তব্য দানকারীদের আক্রমণের পরিকল্পনা আঁটেন। এর চাইতে বড় আদর্শিক পরাজয়, লজ্জা আর কী হতে পারে!

বিশ্বের সব সমাজ বা লোকালয়ে একই বোধবুদ্ধি, একই ভাষা-সংস্কৃতি বা মূল্যবোধ বিকশিত হয় না। একেকটি লোকালয়ে একেকজন মানুষ তার নিজস্বতা নিয়ে জন্মায় এবং বেড়ে ওঠে। এই যে নিজস্বতা তা অন্যের কাছে কখনো গ্রহণযোগ্য হয়, কখনো হয় না। কারণ একজনের মতকে গ্রহণ বা বর্জন করার অধিকার আরেকজনের থাকে। সে কারণে যা আমার নয় বা যা আমি ভাবি, তার বিপরীতে কেউ অবস্থান নিলে তাকে আঘাত করতে হবে, হত্যা করতে হবে, এটা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কেউ যদি তা করতে যায়, তা নিষ্ঠুর বর্বরতা ছাড়া আর কিছুই না। 

মোটকথা, মানবসভ্যতা বিকাশের পাশাপাশি নানা মতও গড়ে ওঠে। পরমত সহনশীলতার চর্চা ছাড়া কোনো সমাজ সুস্থ হয় না, সভ্য হয় না, আধুনিক হয় না।   

এখানে একটি প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বাধীনতা কি সীমাহীন— না, তা নয়! যে কোনো স্বাধীনতাই নিয়ন্ত্রণহীন নয়! বলা সঙ্গত যে, কোনো স্বাধীনতাই অবাধ ও নিয়ন্ত্রণহীন নয়, হওয়া উচিত নয়। তবে নিয়ম বা নিয়ন্ত্রণ না থাকায় আবার নানারকম সংকট তৈরি হয়। রাজতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্রের কথা ভিন্ন, সেখানে রাজা-রানি বা স্বৈরশাসকের ইচ্ছে-অনিচ্ছাই আইন। এ ধরনের সমাজে মানুষ কার্যত বন্দি হয়েই থাকে। মুক্তবুদ্ধির চর্চা সেখানে থাকে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। তবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোতে কিছু নিয়ম, রীতি বা বাধানিষেধের প্রয়োজন পড়ে বৈকি এবং তা দরকার হয় বৃহত্তর স্বার্থের প্রয়োজনেই।

স্বীকার করতে বাধ্য যে, স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণহীন হলে, অনেক ক্ষেত্রেই তার অপব্যবহার রোধ করা সম্ভব হয় না। একশ্রেণির মানুষ আছেন, জেনে বা না জেনে, যারা এর সুযোগ গ্রহণ করেন, নৈরাজ্য সৃষ্টি করেন এবং ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষার নামে নিজের অধিকারের সীমা অতিক্রম করেন। সংকট আরো আছে। এমন রাষ্ট্রশক্তি কিংবা সমাজশক্তিও আছে যে নিজের প্রভাব বিস্তারের প্রয়োজনে অন্যের স্বাভাবিক চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা হরণ করতে উদ্যত হয়। এই হরণ করার চেষ্টাই হলো শঙ্কার কারণ। আবার রাষ্ট্র কখনো এমন আইন তৈরি  করে, যা নাগরিকের স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কুশীলবরা অন্য মতকে সমূলে উৎপাটন করতে চান সহিংস পথ বেছে নিয়ে।

ধর্ম পালন করা মানুষের শ্রেষ্ঠ মৌলিক অধিকারের অংশ; এ অধিকারে আঘাত হানার অর্থ অন্যের অধিকার হরণ করার শামিল। ইচ্ছেকৃতভাবে যারা এ কাজ করেন, তারা তাদের অধিকারের সঠিক প্রয়োগ করেন ভাবা মোটেও ঠিক নয়। এ সবই অসুস্থ প্রবণতা। এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে এবং তা করতে হবে স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই। যে কোনো সমাজের সুস্থ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশের ধারাকে বেগবান করতে এ লড়াইয়ের বিকল্প নেই। অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুগে যুগে লড়াই হয়েছে— আজো তার ব্যতিক্রম হওয়ার কোনো কারণ নেই। এর প্রতিপক্ষরা নিজেদের অজ্ঞতার কারণে কারো না কারো পক্ষে অন্ধ লাঠিয়ালের ভূমিকা পালন করে। তাই স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে প্রয়োজন যুক্তিবাদী সমাজ গঠনের লক্ষ্যে গণসচেতনতা তৈরি করা।

 

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads