• শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

একুশ হোক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রেরণা

  • প্রকাশিত ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১

রেজওয়ান আহম্মেদ

 

 

‘ফেব্রুয়ারি’ মাস এলেই আমাদের ভাষা নিয়ে সব আবেগ বা দরদ বহুগুণে প্রকাশ হয়। পতাকা উড়িয়ে, উল্লাস করে, ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে মহা আড়ম্বরে পালিত হয় এ মাস, পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি শহীদদের। কিন্তু এর বিদায়ের সাথে সাথে আমাদের মন থেকেও গোধূলির মতো আস্তে আস্তে বিদায় নেয় ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, আবার হারিয়ে যাই পুরনো অভ্যাসে। প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারের এ যুগে আমরা প্রতিনিয়তই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যথেচ্ছ বিকৃতি ঘটাচ্ছি, যা বাহ্যিক দৃষ্টিতে আমাকে একটু ‘স্মার্ট’ বানালেও নিশ্চিতভাবেই ভাষাকে অপমান করছি। বানানের ভুল ব্যবহার তো আমাদের কাছে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, এমনকি বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যানার-বিজ্ঞপ্তিতেও মাঝেমাঝে এ দৃশ্য দেখা যায়, যা একেবারেই কাম্য নয়।

বাংলা ভাষার একটা বড় বৈশিষ্ট্যই হলো বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন রকম আঞ্চলিক ভাষার প্রচলন। যাদের রয়েছে নিজস্ব শব্দকোষ ও রীতি, যা বাংলা ভাষাকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন শব্দ দিয়ে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করছে। শুধু কথায় নয়, প্রাচীনযুগ থেকে আঞ্চলিক ভাষা কবিতা গান, সাহিত্য বা নাটকের সংলাপে ব্যবহূত হয়ে আসছে। কিন্তু বর্তমানে দেখা যায়, অনেকেই আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ তো করেনই না, বরং হীনম্মন্যতায় ভোগেন। আমাদের মনে রাখা উচিত, আঞ্চলিকতা মানে সংকীর্ণতা বা অনাধুনিকতা নয়, এটা আমাদের ঐতিহ্য। তাই ভাষার এই বৈচিত্র্যতা টিকিয়ে রাখতে হলে আমাদের ব্যক্তি, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের প্রত্যেককে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ ভাষার বিকাশ রুদ্ধ হয়ে গেলে আমাদের সংস্কৃতির বিকাশও পথ হারাতে বাধ্য।

বাংলা শুধু একটি কথা বলার মাধ্যম বা ভাষার নাম নয়, আমাদের আবেগ, অনুভূতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক। কিন্তু বর্তমানে আমাদের মধ্যে বাংলা সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে বিদেশি সংস্কৃতির প্রতি অধিক ঝোঁক লক্ষ করা যায়। ৮ ফাল্গুন ১৩৫৮ বললে হয়তো অনেকে চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকবেন; কিন্তু ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ বললেই আমাদের প্রিয় দিন। শোকাবহ আনন্দময় উৎসবের দিন। ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করার বিরোধিতা করছি না, তবে বাংলাটাও আমাদের জানা থাকা প্রয়োজন।

এ তো গেল বাংলা ভাষার দৈন্যের কথা, এবার দেখা যাক ইংরেজি ভাষার দাপটের কাছে বাংলা কতটুকু জায়গা করে নিতে পেরেছে। রাষ্ট্র, প্রশাসন, আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্র বাংলাকে যথাযথ সমাদর করা হয়েছে কি? তবে এ কথাও ঠিক যে, বিশ্বায়নের সাথে তাল মেলাতে গেলে সর্বত্র শুধু বাংলা নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না, তবে যেটুকু ব্যবহার করা যায়, সেটা যেন ত্রুটিমুক্ত থাকে। প্রতি বছর এই ফেব্রুয়ারিতেই জাতীয় বইমেলায় দেখা যায় হরেক রকমের বই। যেগুলোকে পাঠকপ্রিয় করে তুলতে কোনোটাতে ব্যবহার করা হয় বাংলা ও ইংরেজির মিশেল, কোনোটাতে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করা হয় ভুলেভরা বানান। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, জসীমউদ্দীনের মতো কবি যে ভাষায় সমাদৃত হয়েছেন, খ্যাতি লাভ করেছেন। অথচ সেই ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় পরবর্তী সময়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। এ লক্ষ্যে প্রকাশনার সাথে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এবং বাংলা একাডেমিসহ সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগের নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন।

একুশে ফেব্রুয়ারি কেবল ওই একটি দিন কিংবা তারিখকেন্দ্রিক কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; একটি জাতির, একটি ভাষার অস্তিত্ব ও মর্যাদার ওপর আসতে থাকা আঘাতের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা ধারাবাহিক-পরিকল্পিত চেতনার যোগফল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম সুসংহত স্ফুরণ; বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন ছিল মুখ্যত একটি জাতীয় সংগ্রাম। আর এর মূল কথা ছিল ভাষাগত স্বতন্ত্রচেতনা। তখন ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানের সাথে আরেকটি স্লোগান ধ্বনিত হচ্ছিল ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’। যা একটু বিশ্লেষণ করলেই আমরা দেখতে পাই, ভাষাসংগ্রামীরা দল-মত বিচার-বিশ্লেষণ না করে নানা মতের রাজবন্দিদের মুক্তির দাবি করে এসেছে। রাজনৈতিক মতাদর্শগত পরিচয় সে ক্ষেত্রে বাধা হয়ে ওঠেনি; বরং প্রকাশ পেয়েছিল আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনা। এই অসাম্প্রদায়িকতার লালন এবং বিকাশের পাশাপাশি তারুণ্যের উদ্যমই হোক ‘একুশ’ বা ‘ফেব্রুয়ারি’র চেতনা।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, ইংরেজি ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads