• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জৈষ্ঠ ১৪২৯

ধর্ম

দান-সাদকার গুরুত্ব ও ফজিলত

  • প্রকাশিত ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১

মাওলানা মাহাথির মোবারক

 

 

দান-সাদকা  করা আল্লাহতায়ালার নৈকট্যলাভের অন্যতম একটি মাধ্যম। আল্লাহতায়ালা নিজে দানশীল এবং তিনি দানকারীকে পছন্দ করেন। গোপন-প্রকাশ্যে যে কোনোভাবে দান করা যায়। সব দানেই সাওয়াব রয়েছে। দানের মাধ্যমে মহান আল্লাহতায়ালা পৃথিবীর মানুষের মাঝে রিজিকের ভারসাম্যতা রক্ষা করেন। বিনিময়ে প্রতিদানও দিয়ে থাকেন। মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-সাদকা  কর, তবে তা কতই না উত্তম। আর যদি গোপনে ফকির-মিসকিনকে দান করে দাও, তবে আরো বেশি উত্তম। আর তিনি তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-২৭১)

ইসলামী পরিভাষায় দান করাকেই সাদকা  বলা হয়। সাদকা শব্দটি এসেছে আরবি ‘সিদকুন’ থেকে। অর্থ : সত্যতা, যথার্থতা। পরিভাষায় সাদকা বলা হয়, একমাত্র আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করার লক্ষ্যে স্বীয় সম্পদ ব্যয় করা। কারণ, মানুষের সর্বাপেক্ষা প্রিয়বস্তু এবং জীবনযাপনের প্রধান উপকরণ কষ্টার্জিত মাল ব্যয় করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আল্লাহতায়ালার প্রতি ভালোবাসা এবং তার নির্দেশাবলির প্রতি আনুগত্যের বাস্তব প্রমাণ দিয়ে থাকেন বলে এই ব্যয়কে সাদকা নামে অভিহিত করা হয়েছে। পবিত্র কোরআন-হাদিসে অত্যাবশ্যক এবং ঐচ্ছিক এ উভয় প্রকার দানকেই সাদকা বলা হয়েছে। তবে প্রচলিত অর্থে শুধুমাত্র ঐচ্ছিক নফল দানকেই সাদকা বলা হয়ে থাকে।

সাদকা দুই প্রকার : (১) সাধারণ সাদকা (২) সাদকায়ে জারিয়া। গরিব-দুঃখীকে টাকাপয়সা দান করা, ভালো ব্যবহার করা সাধারণ সাদকার অন্তর্ভুক্ত। আর সাদকায়ে জারিয়া বলা হয়, ওই সব সৎকর্ম যেগুলোর কল্যাণকারিতা স্থায়ী হয়। এর মধ্যে সর্বাগ্রে হচ্ছে দীনি এলেম শিক্ষা দান, দীনি বই পুস্তক রচনা ও প্রকাশ করে সর্বসাধারণের মধ্যে এলেম পৌঁছানো। কারণ, দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনে মানবসন্তানের জন্য সর্বাধিক কল্যাণকর বিষয় হচ্ছে, আল্লাহর সঙ্গে, তাঁর বিধিবিধানের সঙ্গে এবং রাসুলের সঙ্গে পরিচিতি লাভ। এক ব্যক্তি অন্যকে যদি দীনি এলেম শিক্ষা দেন তবে সে ব্যক্তি নিজে আমল করবে এবং প্রত্যক্ষভাবেই হোক বা পরোক্ষভাবেই হোক পরবর্তী কাউকে না কাউকে শিক্ষা দেবে। এভাবে কেয়ামত পর্যন্ত এ সৎকাজের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওই ব্যক্তিকে সর্বাপেক্ষা বড় দাতারূপে আখ্যায়িত করেছেন যিনি পবিত্র কোরআন-সুন্নাহর এলেম অন্যদেরকে শিক্ষা দেন। তার পরের স্থান মসজিদ, এতিমখানা, মাদরাসা, রাস্তাঘাট, সেতু-পুকুর প্রভৃতি গণকল্যাণমূলক খাতে দান করা। এসবের দ্বারা অনেক বেশি লোক উপকৃত হন এবং উপকারটুকু দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রাসুলপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যখন কোনো ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে, তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়, তিনটি ব্যতীত, সাদকায়ে জারিয়া, উপকারী জ্ঞান অথবা সৎকর্মশীল সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।’ (সহিহ মুসলিম শরিফ, হাদিস নং-১৬৩১) ইমাম নববী (রহ.) এই হাদিসের ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, ‘সাদকায়ে জারিয়া হলো ওয়াকফ।’ (শরহে মুসলিম, হাদিস নং-১১/৮৫)

পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াতে দান-সাদকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, তারা আপনার নিকট জিজ্ঞাসা করে, তারা কী ব্যয় করবে? (আল্লাহ বলেন,) জানিয়ে দিন, যা তোমাদের প্রয়োজনাতিরিক্ত।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-২১৯) মহান আল্লাহতায়ালা অন্য আয়াতে বলেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করে এবং কষ্ট দিয়ে নিজেদের দান-খয়রাত বরবাদ করো না সে ব্যক্তির মতো, যে নিজের ধন-সম্পদ লোক দেখানোর উদ্দেশে ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে না। অতএব, এ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত একটি মসৃণ পাথরের মতো যার ওপর কিছু মাটি পড়েছিল। অতঃপর এর ওপর প্রবল বৃষ্টি বর্ষিত হলো, অনন্তর তাকে সম্পূর্ণ পরিষ্কার করে দিল। তারা ওই বস্তুর কোনো সওয়াব পায় না, যা তারা উপার্জন করেছে। আল্লাহ কাফের সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেন না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-২৬৪) অপর আয়াতে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় স্বীয় ধন-সম্পদ ব্যয় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে এবং নিজের মনকে সুদৃঢ় করার জন্যে তাদের উদাহরণ টিলায় অবস্থিত বাগানের মতো, যাতে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়; অতঃপর দ্বিগুণ ফসল দান করে। যদি এমন প্রবল বৃষ্টিপাত না-ও হয়, তবে হাল্কা বর্ষণই যথেষ্ট। আল্লাহ তোমাদের কাজকর্ম যথার্থই প্রত্যক্ষ করেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-২৬৫) এছাড়াও সুরা আয্যারিয়াতের ১৯ নাম্বার আয়াতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, নিশ্চয়ই তোমাদের সম্পদে নিঃস্ব ও অসহায়দের অধিকার রয়েছে। অর্থাৎ আমরা যা দান করি, কোরআনের দৃষ্টিতে তা দয়া নয়; বরং তা অসহায়দের অধিকার বা হক্কুল ইবাদ। আপনি যখন দান করেন, তখন আপনি সৃষ্টির অধিকারকেই সম্মান করেন। তখন স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহ আপনাকে সম্মানিত করবেন। অপর আয়াতে আল্লাহ বলেন, আর তাদের সম্পদে নির্দিষ্ট হক রয়েছে। ভিক্ষুক এবং বঞ্চিত (অভাবী অথচ লজ্জায় কারো কাছে হাত পাতে না) সবার হক রয়েছে।’ (সুরা মাআরেজ, আয়াত-২৪, ২৫) পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহপাক আরো ইরশাদ করেন, যারা আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ ব্যয় করে তার উদাহরণ হচ্ছে সেই বীজের মতো যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। আর প্রতিটি শীষে একশতটি করে দানা থাকে। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অতিরিক্ত দান করেন। আল্লাহ সুপ্রশস্ত সুবিজ্ঞ।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-২৬১)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অসংখ্য হাদিসেও দান-সাদকার ফজিলত তুলে ধরা হয়েছে। গোপনে দান করার ব্যাপারে হাদিসে অধিক ফজিলতের কথা বর্ণিত হয়েছে। গোপনে দানকারী কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহর আরশের নিচে ছায়া লাভ করবে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কিয়ামত দিবসে সাত শ্রেণির মানুষ আরশের নিচে ছায়া লাভ করবে। তাদের মধ্যে একশ্রেণি হচ্ছে, ‘এক ব্যক্তি এত গোপনে দান করে যে, তার ডান হাত কি দান করে বাম হাত জানতেই পারে না।’ (বুখারি ও মুসলিম) দান-সাদকা  গুনাহ মাফ করে ও জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচায়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘হে কাব বিন উজরা! নামাজ (আল্লাহর) নৈকট্য দানকারী, রোজা ঢালস্বরূপ এবং দান-সাদকা  গুনাহ মিটিয়ে ফেলে যেমন পানি আগুনকে নিভিয়ে ফেলে।’ (আবু ইয়ালা, সনদ সহীহ)। অন্যত্র রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘খেজুরের একটি অংশ দান করে হলেও তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা কর।’ (বুখারি ও মুসলিম)

বর্তমান যুগে অনেক মানুষ এমন আছে, যারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে দান করেন মানুষকে দেখানোর জন্য। মানুষের ভালোবাসা নেওয়ার জন্য। মানুষের প্রশংসা কুড়ানোর জন্য। মানুষের মাঝে গর্ব অহংকার প্রকাশ করার জন্য। অনেকে দুনিয়াবি স্বার্থসিদ্ধির জন্যও দান করে থাকেন। যেমন, চেয়ারম্যান বা এমপি নির্বাচনে জেতার উদ্দেশে দান করে থাকেন অনেকেই। কিন্তু দান যদি একনিষ্ঠভাবে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য না হয় তা দ্বারা হয়ত দুনিয়াবি কিছু স্বার্থ হাসিল হতে পারে কিন্তু আখেরাতে এর কোনো প্রতিদান পাওয়া যাবে না। হাদিসে কুদসীতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, (আল্লাহপাক বলেন) : ‘আমি শিরককারীদের শিরক থেকে মুক্ত। যে ব্যক্তি কোনো আমল করে তাতে আমার সঙ্গে অন্যকে শিরিক করবে, তাকে এবং তার শিরকের আমলকে আমি পরিত্যাগ করব।’ (মুসলিম)

লোক দেখানো দান-সাদকার জন্য রয়েছে ভয়াবহ শাস্তি। যারা মানুষের প্রশংসা নেওয়ার উদ্দেশে দান করবে। তাদের দ্বারাই জাহান্নামের আগুনকে সর্বপ্রথম প্রজ্বলিত করা হবে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘সর্বপ্রথম তিন ব্যক্তিকে দিয়ে জাহান্নামের আগুনকে প্রজ্বলিত করা হবে।... তাদের মধ্যে (সর্ব প্রথম বিচার করা হবে) সেই ব্যক্তির, আল্লাহ যাকে প্রশস্ততা দান করেছিলেন, দান করেছিলেন বিভিন্ন ধরনের অর্থ-সম্পদ। তাকে সম্মুখে নিয়ে আসা হবে। অতঃপর (আল্লাহ) তাকে প্রদত্ত নেয়ামত পরিচয় করাবেন। সে তা চিনতে পারবে। তখন তিনি প্রশ্ন করবেন, কি কাজ করেছ এই নেয়ামতসমূহ দ্বারা? সে জবাব  দেবে, যে পথে অর্থ ব্যয় করলে আপনি খুশি হবেন এ ধরনের সকল পথে আপনার সন্তুষ্টির উদ্দেশে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করেছি। তিনি বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ; বরং তুমি এরূপ করেছ এই উদ্দেশে যে, তোমাকে বলা হবে, তুমি দানবীর। আর তা তো বলাই হয়েছে। অতঃপর তার ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হবে। তখন তাকে মুখের ওপর উপুড় করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ (মুসলিম)

 

লেখক : খতিব, মসজিদে বায়তুন নূর, মাওনা, গাজীপুর

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads