• শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

বিয়েবিচ্ছেদ ও সমাজ-ভাবনা

  • প্রকাশিত ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১

সিনথিয়া সুমি

 

 

বিয়ের বন্ধন একটি পবিত্র বন্ধন। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান যে ধর্মেরই হোক না কেন, বিয়ের যে মূল মন্ত্র, তা হলো একটি ছেলে বা একটি মেয়ের একসঙ্গে থাকার প্রতিশ্রুতি। সামাজিকভাবে এই প্রতিশ্রুতিকে বৈধ করা হয়। এই বৈধতা বা পারস্পরিক প্রতিশ্রুতির আরেক নাম বিয়ে বা বিবাহবন্ধন। আজকাল বেশিরভাগ বিয়েবিচ্ছেদের কারণগুলো যেন স্বামী-স্ত্রী নিজেদের অজান্তে তৈরি করে ফেলছে। আমার মতে, বর্তমানে বিয়েবিচ্ছেদের অন্যতম কারণ স্বামী-স্ত্রীর একে অন্যের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও মূল্যবোধের অভাব। সমস্যাটা শিক্ষিত সমাজে সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, দিন দিন বেড়েই চলেছে বিয়েবিচ্ছেদের হার। বিয়েবিচ্ছেদ আজকাল বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। ফলে বিয়েবিচ্ছেদের ভয়ংকর ছোবলে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে অগণিত পরিবার। অবশ্য মা-বাবার বিচ্ছেদের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সন্তানরা। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলগুলোর চেয়ে শহরাঞ্চলে বিচ্ছেদ বেশি হচ্ছে।

বিশ্বাসই দাম্পত্য জীবনের মূল ‘চাবিকাঠি’। বিয়েটা যেভাবেই হোক, নিজের পছন্দ বা পারিবারিকভাবে, এমন কোনো বিষয় গোপন করা উচিত নয়, যেটা পরবর্তীকালে জানতে পারলে সমস্যা হতে পারে। যদি কোনো কিছু গোপন করে থাকেন, সে জানতে পারলে ভাববে আপনি তাকে ঠকিয়েছেন। এই সমস্যা থেকেই শুরু হয়ে গেল অবিশ্বাস কিংবা অশান্তির সূত্রপাত। বিয়েবিচ্ছেদের জন্য এটা একটা বড় কারণ। একে অপরকে সম্মান করা এটি এমন একটি সম্পর্ক যা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাকে কীভাবে সঠিকভাবে টিকিয়ে রাখা যায়, সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত। স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। ছেলে বা মেয়ে যেই হোক না কেন, বিয়ের জন্য কিন্তু উপযুক্ত একটা বয়সও বিশাল ব্যাপার। ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭’-তে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছর, ছেলেদের ২১ বছর পাস করা হয়েছে। বয়স কেন এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ? বয়সের ব্যাপারটা এজন্য এত গুরুত্বপূর্ণ কারণ বিয়ের জন্য শারীরিক এবং মানসিকভাবে দায়িত্ব নেওয়ার মতো মানসিকতা থাকতে হবে। লক্ষ করা যায়, ইদানীং আমরা ক্যারিয়ার নিয়ে এত বেশি ভেবে থাকি যে, আমাদেরও একটা সংসার আছে সেটা ভুলে যাই। নিজের আপন মানুষগুলোকে সময় না দিয়ে অফিসের কাজ বা মিটিং করে থাকি। ছুটির দিনটিকে পরিবারের জন্য রেখে দিলে দেখবেন কত সুন্দর একটি সময় একসাথে কাটাতে পারছেন। শত ব্যস্ততার মাঝেও কিছু সময় বের করুন আপনার পরিবারের জন্য। সম্পর্ক হলো একটা গাছের মতো, যাকে প্রতিদিন পানি দিয়ে যত্ন করতে হয়।

ভুল কিন্তু সবারই হতে পারে। তাই স্বামী বা স্ত্রী যদি কোনো ভুল বা অন্যায় করে থাকে, তাহলে সেটা একে-অপরকে জানিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। কেউ আগে ক্ষমা চাইলেই যে সে ছোট হয়ে যাবে ব্যাপারটি তেমন নয়। দুজনকেই দুজনের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে। স্বামী বা স্ত্রী যে কেউ ভুল করতেই পারে। ভুলটা যেই করুক না কেন, ফ্যামিলি, বন্ধু-বান্ধব বা বাইরের যে কারো সামনে না বলাই ভালো; কারণ পরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তৃতীয় পক্ষ ঢুকে পড়তে পারে, যেটা আপনাদের দুজনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে থাকবে।

যে কোনো ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হলে একে অপরকে সাপোর্ট করুন। সেটা হতে পারে পারিবারিক, আর্থিক, মানসিক, অফিসিয়াল ইত্যাদি। কাজের চাপ, অতিরিক্ত সময় অফিসে থাকা নিয়ে একে অপরকে দোষারোপ করবেন না। বরং দুজনই একে অপরের কাজের ক্ষেত্রটা এবং সমস্যা বোঝার চেষ্টা করুন।

আর একসাথে থাকলেই যে শুধু ভালোবাসতে হবে তেমন কিন্তু নয়। মাঝে মাঝে ঝগড়া করলে ভালোবাসাও বাড়ে। ঝগড়া হতেই পারে কিন্তু সেটা তুচ্ছ তুচ্ছ বিষয় নিয়ে বড় কিছু করে ফেলা নয়। কিন্তু যখন ঝগড়াটা আর নিজেদের মধ্যে থাকে না তখন হয়ে যায় বিপত্তি। কখনোই নিজেদের বিষয়টি তৃতীয় পক্ষকে জানাবেন না এমনকি বাবার বাড়িতেও না। আর্থিকভাবে অবস্থা আছে কি না বা কতটুকু সেটা কিন্তু বিয়ের আগেই দেখে নিচ্ছেন। বিয়ে হয়ে গেলে এটা দিতে পারছে না, ওটা পারছে না-এভাবে বলে তাকে আর ছোট করবেন না। যৌতুকের কারণে অনেক বিয়েবিচ্ছেদ হচ্ছে। সবারই স্বাধীনভাবে চলার অধিকার আছে, কিন্তু সেটা করারও একটা সীমাবদ্ধতা আছে। স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই দুজনের সম্মতি নিয়ে কাজ করা উচিত। বিশ্বাস করে কেউ কারো স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করে বরং বুঝে কাজ করুন। আপনাকেও বুঝতে হবে আপনার সাথে অন্য একজনের জীবন জড়িয়ে আছে।

প্রযুক্তিগত মিডিয়ার খারাপ দিকের জন্য সংসারে ঝামেলা হয়। সবকিছুরই ভালো-মন্দ দিক আছে। প্রযুক্তি আমাদেরকে যেমন সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তেমনি পেছনেও টানছে। ইদানিং দেখা যাচ্ছে, পাশ্চাত্য দেশের সিরিয়ালের জন্য ব্যাপকভাবে সংসারে অশান্তি দেখা যায়। জীবনটা কিন্তু টিভি-সিরিয়াল নয়। বাস্তবতার সাথে সাজানো নাটকের কোনো মিল পাওয়া যাবে না। যখনই নিজের জীবনকে টিভি সিরিয়ালের মতো ভাবতে যাবেন, তখনই কিন্তু বিপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইভার, ইমো ইত্যাদি সোশ্যাল মিডিয়া বিয়েবিচ্ছেদের জন্য অনেকদিক থেকেই দায়ী। বাড়তি বিনোদনের জন্য অনেকেই নতুন বন্ধুর খোঁজে নিজের বিবাহিত জীবনটিকে দুর্বিষহ করে তুলছেন। অন্য পুরুষ বা মহিলার প্রতি বিয়ের পর আসক্তিকেই পরকীয়া বলা হয়ে থাকে। নানান ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়ে অনেকেই এই কাজটি করে থাকেন। ভয়ংকর এই পরকীয়ার জন্য ঘটে বিয়েবিচ্ছেদ।

আসলে বিয়েবিচ্ছেদের কারণ খুঁজলে অনেক কিছুই পাওয়া যাবে। কিন্তু মাঝে মাঝে সংসারের জন্য হলেও ত্যাগ স্বীকার করুন। ডিভোর্স কথাটা খুব ছোট কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজ নয়। এর সাথে শুধু দুজন মানুষ নয়, দুটি পরিবারের সবাই জড়িত। বিয়ের মাধ্যমে নতুন একটি সংসারের যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু সংসার ভাঙনের এই প্রবণতা দিন দিন কেবলই বাড়ছে। যখন পারস্পরিক ভালোবাসা ও বিশ্বাস কমে যায়, তখন সেই সংসারের বন্ধন হালকা হয়ে যায় এবং একপর্যায়ে সংসার ভেঙে যায়।

অস্থিরতার মধ্যে কোনো সিদ্ধান্ত নয়। সুস্থির মনে সিদ্ধান্ত নিলেই সেই সিদ্ধান্ত হবে যথাযথ। এই ভয়াবহ বিচ্ছেদ ঠেকানোর জন্য দুজন মানুষকে সবসময়ই একে অন্যের ইচ্ছার সম্মান করতে হবে। আরেকটা কথা, যেটা তাদের মনে রাখতে হবে, বিচ্ছেদ কখনোই সুখকর হয় না।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads