• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

সহজ কথা

লকডাউন ও আমাদের সিভিক সেন্স

  • এমদাদুল হক বাদল
  • প্রকাশিত ১৭ এপ্রিল ২০২১

কসাইখানায় সারি সারি গবাদিপশু বাঁধা থাকে। ওখান থেকে কসাই একটা একটা করে নিয়ে ওদের সামনেই জবাই করে। ওসব অবলা পশুরা চেয়ে চেয়ে দেখে ঠিকই কিন্তু তাতে তাদের কোনো ভাবান্তর হয় কি-না, তা বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন। তবে করোনাকালে বিধিনিষেধকে থোড়াই কেয়ার করে আমজনতার অবাধ মুভমেন্ট দেখে ওসব অবলাদের থেকে পার্থক্য নির্ণয় করা খুব মুশকিল! করোনা যতটাই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে, মানুষ যেন তার চেয়েও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। কী কাঁচা বাজার, কী শপিং মল, বাস-ট্রেন, ব্যাংক— কোথায় নেই উপচে পড়া ভীড়।

স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই তো নেইই, মুখে মাস্ক পর্যন্ত নেই। মাস্ক যদিও বা থাকে তা থুতনিতে, নয়তো নাকের নিচে। এ এক অদ্ভুত মানসিকতা। অনেক লোক আছেন যারা মাস্ক পকেটে নিয়ে ঘুরছেন, কিন্তু পরছেন না। চোখের সামনে আক্রান্ত হতে দেখছে, টিভিতে দেখছে, খবরের কাগজে পড়ছে, যে, করোনা আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লফিয়ে বাড়ছে, বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। কথায় বলে, নিজের ভালোটা নাকি পাগলেও বোঝে। আমরা কী তাও বুঝি?

মানছি, লকডাউন কোন স্থায়ী সমাধান নয়। এছাড়া পক্ষে-বিপক্ষে রয়েছে প্রচুর তর্ক। আমাদের মতো দেশে গরিব মানুষদের পেটে লাথি বলে একটা কথা আছে। কারণ, লকডাউনের ফলে খেটে খাওয়া এসব মানুষদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। মধ্যবিত্ত শ্রেণি ফাঁপড়ে পড়ে, বড়লোক শ্রেণি ব্যবসা গেলো বলে হায় হায় করে। কিন্তু এটাও তো ঠিক যে, ব্যাপক সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউনের বিকল্প নেই। বিশেষ করে জনগণ যেখানে স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা করে না! নিজে তো মানে না, অন্যের স্বাস্থ্যও ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে; যেখানে সেখানে যখন তখন খোলা হাঁচি দিয়ে, থুথু ফেলে, প্রস্রাব করে।

সহযোগী এক পত্রিকায় গত বছরের জুলাইয়ের শেষে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, শহর এলাকার মানুষের মাস্ক পড়ার হার ছিল শতকরা ৬০+, পল্লী এলাকায় তা ছিল শতকরা ৪৫+। মানুষের মনে নতুন রোগটি সম্পর্কে একটা ভয় ছিল বলে মানুষজনকে মাস্ক পরানোর ব্যাপারে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছিল। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে এ বছরের অবস্থা আরো খারাপ বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। শুধু মাস্ক ব্যবহারই নয়, হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহার ইত্যাদি ক্ষেত্রেও শৈথিল্য দেখা যাচ্ছে। ব্যাপকভাবে বেড়ানো, বিশেষ করে পর্যটন কেন্দ্রসমূহে ভিড়, বিয়ে-সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যাপক জনসমাগম খুবই উদ্বেগের সঙ্গে আমরা লক্ষ করেছি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মাস্ক একাই শতকরা ৯৫ ভাগ করোনা সংক্রমণ রুখে দিতে সক্ষম। কিন্তু মাস্ক ব্যবহারে আমাদের অনীহা এবং অযুহাত যেমন হাস্যকর, তেমনি অন্যায় অপরাধের। এক ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, এক যাত্রীকে মাস্ক পরতে বলাতে তিনি ২০ টাকার একটা ময়লা নোট নাকের ওপর গুঁজে দিচ্ছেন! বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং ব্যক্তি উদ্যোগে পরিচালিত কর্মসূচিতে মানুষের মাঝে মাস্ক বিতরণ ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করতে দেখা গেছে। কিন্তু বিষয়খানা এমন যেন, আমি না মানলে কার কী?

আমরা সবচেয়ে উৎসুক জাতি। ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে পরিষ্কার করতে গেলেও জনা দশেক লোক দাঁড়িয়ে যায় তা দেখতে! লকডাউন কেমন হচ্ছে তা দেখার জন্যও ভীড় জমে রাস্তায়! গতবারে যেমনটা ঘটেছিলো। আশা করা যায় এবারের লকডাউনে তা ঘটবে না। এবারের কঠোর লকডাউন ঘোষণার পর গত ১৩ এপ্রিলের রিপোর্ট অনুযায়ী, ঐ দিন বাইরে যাবার পাস সংগ্রহ করার জন্য প্রতি মিনিটে ১৫ হাজারেরও বেশি আবেদন পড়েছে। প্রথম ঘণ্টাতেই আবেদন পড়েছে এক লাখ পঁচিশ হাজার! কী বিচিত্র! সংশ্লিষ্ট মহল এতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন! 

অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সের প্রধান ড. রণদীপ গুলেরিয়া বলেছেন, আগে একজন করোনা সংক্রমিত মানুষ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ সুস্থ মানুষকে সংক্রমিত করতে পারতো। এখন করোনা ভাইরাসের নতুন স্ট্রেইন এতটাই শক্তিশালী যে একজন সংক্রমিত ব্যক্তি ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ মানুষের মাঝে সংক্রমণ ছড়িয়ে দিতে পারে। এর জন্য তিনি মাস্ক না পড়া, জনসমাগম করা, সামাজিক দূরত্ব না মানাকেই দায়ী করছেন। 

হাদিসে মহামারী চলাকালীন মহামারীপ্রবণ এলাকা থেকে মহামারীমুক্ত এলাকায় যাওয়া-আসা করা কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমান অধ্যুষিত জনপদে ক’জন মানছে ধর্মের কথা। পরিবার পরিজনের সঙ্গে যেন না মিললেই নয়! যেভাবেই হোক বাড়িতে যেতে হবে। কিন্তু বোঝেন না যে, কতটা বিপদ সেসব প্রিয়জনদের জন্য বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। দেশের ধর্মীয় আলেম-ওলামাগণ কিসের ভিত্তিতে বলেন, মসজিদ-মাদরাসায় করোনা আসবে না, হবে না; যেখানে করোনা বিদ্যুৎ গতিতে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে!

স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে মানুষের এক অদ্ভুত অনীহা। গোঁড়ামি, অন্ধ বিশ্বাস আর কেয়ারলেস ভাব করোনা ভাইরাসকে সুযোগ করে দিয়েছে ব্যাপকভাবে সংক্রমণ ঘটানোর, ছড়িয়ে পড়ার। সংক্রমণ কমাতে জনগণের ওপর জোর খাটানোর বিকল্প নেই। প্রয়োজন কঠোর লকডাউন। কিন্তু সেখানে আছে হাজারো প্রশ্ন। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দু’মুঠো অন্নের ব্যবস্থা করা, লকডাউনে ঘরবন্দি মানুষের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। অর্থাৎ মানুষের যাতে খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যেতে না হয় তার সুব্যবস্থা করা।

গত বছরের লকডাউনে আমরা দেখেছি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি উদ্যোগ এসব ব্যাপারে এগিয়ে এসেছিলেন এবং ব্যাপক প্রশংসাও কুড়িয়েছেন। যদিও সমন্বয়হীনতা ছিল প্রকট। যার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃত উপকারভোগীদের কাছে সেসব সামগ্রী পৌঁছেছে সামান্য। সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সেবা এবং ব্যবহারও ছিলো চোখে পড়ার মতো। কিছু মানুষের জন্য সব সময়ে একটু কঠোর হতে হয়, যাদের বিধি মানায় প্রবল অনীহা। এছাড়া আছে মানসিকতার সমস্যা, অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানোর প্রবণতা।

লকডাউন কঠোরভাবে পালিত না হওয়ার অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে সরকারি সিদ্ধান্তে সমন্বয়হীনতাও অন্যতম। জনগণকে ঘরে থাকতে বলে জরুরি সেবা বাদে কলকারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক তা অবশ্য বিশ্লেষণের ব্যাপার। অন্যদিকে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে এসব চালু রাখার বিকল্পও নেই। এখন ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ দশায় পড়ে আমরা না পারছি লকডাউন কার্যকর করতে, না পারছি করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে।

সুতরাং সব দায় সরকারের ঘাড়ে না চাপিয়ে আমাদেরকেও সিভিক সেন্স ব্যবহার করতে হবে। আইন সবকিছুর সমাধান দেয় না, যদি তা মানার ক্ষেত্রে আমরা উদাসীন হই। শুধু মাস্ক পড়া, লকডাউন মানাই নয়, যেখানে সেখানে থুথু, কফ, পিক ফেলা, প্রস্রাব করা বন্ধ করতে হবে। কারণ এগুলো এক প্রকার সামাজিক ন্যুইসেন্সও বটে। এসব বন্ধ করতে পারলে শুধু করোনা নয়, আরো অনেক রোগের প্রকোপ থেকেও বাঁচা সম্ভব। যক্ষ্মা, সাধারণ সর্দি-কাশি, ফুসফুস ক্যানসার, অ্যাজমা ইত্যাদি অনেক রোগ কমে আসার সম্ভাবনা থাকবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান তেদ্রোস আধানম গ্যাব্রিয়াসুস সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, করোনা সহজে বিদায় নিচ্ছে না। তবে একে দূর করার অস্ত্র আমাদের হাতেই আছে। আর তা হলো আমাদেরকে আরো বেশি সচেতন হতে হবে। অসচেতনতা আর অবহেলাই দিনকে দিন এই ভাইরাসকে শক্তিশালী ও ভয়ংকর হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। টিকা আবিষ্কার এবং গ্রহণের ফলে মানুষের মাঝে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের জন্ম হয়েছিল। তিনি আরো বলেছেন, করোনার বিরুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার অন্যতম উপায় টিকাকরণ। কিন্তু এটি একমাত্র উপায় নয়। টিকা গ্রহণের পাশাপাশি আমাদেরকে অবশ্যই শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক পরা, হাত ধোয়ার মতো নিয়মগুলো মেনে চলতে হবে। সেই সঙ্গে টেস্ট করানো, শনাক্তকরণের কাজও চালিয়ে যেতে হবে। করোনা আক্রান্ত হলে কিংবা আক্রান্তের সংস্পর্শে এলে অবশ্যই আইসোলেশন কিংবা কোয়ারেন্টাইনে যেতে হবে। 

মনে রাখতে হবে, কোভিড আক্রান্ত হওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কিন্তু সুদূরপ্রসারী। সুতরাং আক্রান্ত হতে না চাইলে, প্রিয়জন হারাতে না চাইলে, দীর্ঘমেয়াদে ভুগতে না চাইলে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। সরকার ঘোষিত লকডাউন মেনে চলতে হবে। যার যার অবস্থান থেকে নাগরিক বোধ বা সিভিক সেন্স বাড়াতে হবে এবং মেনে চলতে হবে।

 

লেখক : ফ্রি ল্যান্স সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads