• সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জৈষ্ঠ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু এবং বাবা-মায়ের সম্পর্ক

  • প্রকাশিত ২১ মে ২০২১

কানিজ ফাতেমা করবী

 

আকাশ (ছদ্মনাম) ১০ বছর বয়সি অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু। আকাশের মা তার একমাত্র পরিচর্যাকারী। আকাশের মা যখন তার মনোবৈজ্ঞানিক অবস্থা যাচাই করার জন্য প্রথম দেখায় তখন তার বয়স বেশ অল্প ছিল। তাকে পর্যবেক্ষণে খুব অস্থির আর অমনোযোগী দেখা গিয়েছিল। পূর্বে তাকে অতি মাত্রায় চঞ্চল শিশু হিসেবে শনাক্ত করা হয়। আকাশের মা খুব চিন্তিত হয়ে কথাগুলো মনোবিজ্ঞানীকে বলছিলেন। সেশনে আকাশের মাকে অতি মাত্রায় বিষণ্ন ও উদ্বিগ্ন মনে হয়েছিল। প্রতিদিনের স্বাভাবিক কাজগুলো আকাশ করতে পারলেও অন্যদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে তার সমস্যাগুলো বেশ খানিকটা তীব্র। আকাশের বাবা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আছেন এবং নিজের কাজের বাইরে আকাশকে তিনি মোটেই সময় দেন না, কথাগুলো আকাশের মা কষ্ট নিয়ে বলছিলেন। পুরোটা দায়িত্ব আকাশের মাকে একা হাতে সামলাতে হয়। এ ক্ষেত্রে তিনি কিছুটা বিধ্বস্ত এবং ক্লান্ত। আকাশের বাবা যদি অবসর সময়ের কিছুটা দায়িত্ব নিতেন, তাহলে হয়তো আকাশ আরো বেশি সক্রিয় হতো—এমনটাই ধারণা তার, সেশনে কেঁদে কেঁদে কথাগুলো বলছিলেন আকাশের মা।

আহনাফ (ছদ্মনাম) ১৪ বছর বয়সি অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কিশোর। আহনাফ যে স্কুলে  পড়ে, সেই স্কুলের টিচাররা তাকে মনোবৈজ্ঞানিক অবস্থা যাচাই করার জন্য পাঠায়। আহনাফের মা মূলত তার সার্বক্ষণিক দেখাশোনা করে। ইদানীং সে কিছুটা আগ্রাসী আচরণ প্রকাশ করছে এবং বার বার একই শব্দ বলার যে প্রবণতা, সেই পরিপ্রেক্ষিতে সে নেতিবাচক শব্দগুলোকে অতিমাত্রায় গ্রহণ করছে। নেতিবাচক কথা বা শব্দ তার সামনে কেউ বলতে পারবে না, এমনটাই হয়ে আসছে। বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া আর সেগুলোকে বোঝানোর ক্ষেত্রে মা অনেকটাই হিমশিম খাচ্ছে। আহনাফের বাবা বিষয়গুলো নিয়ে কোনো দায়িত্ব পালন করছে না, এমনটাই মা সেশনে বলছিলেন। ছেলেটি তার সব রাগ আর জেদ মায়ের সঙ্গে প্রকাশ করে থাকে। ফলে মা অনেকটাই হতাশ আর নিরুপায় হয়ে কথাগুলো শেয়ার করছিলেন।

দুটো প্রেক্ষাপট আমাদের চারপাশেরই। যাদের এমন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু আছে, তারা খুব ভালোভাবে নিজেদের একই জায়গায় আবিষ্কার করতে পারবেন আশা করি। আমরা জানি যে, ইতিবাচক পদ্ধতি হচ্ছে শিশুর বর্তমান পরিস্থিতিকে মেনে নেওয়া এবং শিশুর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলোকে মূল্যায়ন করা। শিশুটির অবস্থাকে বোঝা, শিশুর বয়স অনুযায়ী কী কী পারে এবং কী কী পারে না তা বোঝা বাবা-মা উভয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ২০১২ সালে বেনসন এক গবেষণায় দেখেছেন, যেসব বাবা-মায়ের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু আছে তাদের দীর্ঘ সময় পরিচর্যা করতে গিয়ে সেটি তাদের বিয়ে, প্রফেশন, সম্পর্ক ইত্যাদির ওপর প্রভাব ফেলছে। যেটি উদ্বিগ্নতা তৈরি করে এবং প্রায়ই তাদের সামগ্রিক পরিবারকে প্রভাবিত করে থাকে। বেশির ভাগ গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর মা-বাবাদের অতিমাত্রায় চাপ এবং মানসিক স্বাস্থ্যজনিত ঝুঁকি থাকে স্বাভাবিক শিশুর বাবা-মায়ের তুলনায়। যথাযথ সাপোর্ট এবং গাইডেন্সের মাধ্যমে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর মা-বাবারা খুব ভালোভাবে চ্যালেঞ্জের সঙ্গে মোকাবিলা ও সমস্যার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে (শিলিং এটএল ২০১৩)।  বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর মা-বাবাদের প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব, দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক চাপ, তৃতীয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মা-বাবাদের ওয়েলবিইয়িং। এই ক্রমবর্ধমান চাপ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর পরিচর্যা করার সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয় এবং তা প্রভাবিত করে মা-বাবাদের আবেগীয় অবস্থা, মানসিক অবস্থা এবং শারীরিক অবস্থার ওপর। এর কারণ হচ্ছে বাবা-মা তাদের সুস্থ এবং অসুস্থ বাচ্চাদের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে এবং সেখানে ভারসাম্য রাখতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। অর্থনৈতিক চাপ, কাজের চাপ এবং পরিবারের সামগ্রিক ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। বাবা-মায়ের মধ্যে নিজের প্রতি অথবা অন্যের প্রতি দোষারোপ তৈরি, যা তাদের মধ্যে বিষণ্নতা অথবা তাদের আত্মসম্মানকে কমিয়ে দিতে পারে। 

একই সঙ্গে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর সঙ্গে বসবাসরতদের গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক প্রভাবগুলো তাদের পরিবারে বেশিমাত্রায় অনন্য, সম্ভাব্যভাবে আলোকিত হওয়ার মতো। এই পরিস্থিতি তাদের মধ্যে নৈকট্য, অভ্যন্তরীণ শক্তি, পরিবারের একাত্মতা, ধর্মীয় ও সামাজিক অধিভুক্তিতে সংযোগ ঘটাতে উৎসাহ বৃদ্ধি করে। যখনই পিতা-মাতারা নিজেদের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত শ্রম বিভাজন পরিস্থিতিতে দেখে, তাদের ভূমিকার পরিবর্তন হতে দেখে, তখনই সেটা হতাশার জন্ম দেয়, একে অন্যের সঙ্গে দূরত্বের কারণ ঘটে। তারা উপলব্ধি করে যে, তারা নিজেদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাগুলো থেকে হাল ছেড়ে দিচ্ছে। উপরন্তু নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে। এক গবেষণায় (সলোমন এবং চাং ২০১২) দেখা গেছে,  দম্পতিদের নিজেদের মধ্যে মিটিং, যদি সেটি তাদের নিজেদের জন্য আলাদা সময় রাখার মধ্যে হয়, তাহলে সেটি একে অন্যকে দোষারোপ করা, সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার মতো বিষয়ের ঝুঁকি অনেকটা কমাবে। প্রাত্যহিক জীবনের অভিজ্ঞতাগুলোকে কথা বলার সুযোগ করে দিলে বেশ খানিকটা চাপ তাদের কমে যায়—এই বিষয়টিও গবেষণায় প্রমাণ মেলে। বাসায় থেকে সার্বক্ষণিক কাজ করার ফলে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর মায়ের মধ্যে হতাশা এবং অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার বিষয়টি বেশি কাজ করে থাকে। এ ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গীরা যদি সামাজিক কার্যকলাপের মধ্য তাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে, তাহলে সেটি শিশুর মায়েদের চাপকে অনেকটাই কমায়। বিশেষজ্ঞরা ব্যক্তির মূল্যায়নের ওপরও গুরুত্ব দিয়েছেন, মূলত পরিস্থিতির সঙ্গে তার আবেগকে প্রকাশের ক্ষেত্রে।

ইতিবাচক মূল্যায়নের বিষয়টা বেশিরভাগ গবেষণায় দেখা যায়, শুধু মায়ের দিক থেকে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর প্রতি ইতিবাচক মূল্যায়ন থাকলে চলবে না, পিতা-মাতা উভয়ের মূল্যায়ন পরিবারের ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। অন্যকে দোষারোপ করা, পালিয়ে বাঁচা, নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া কিংবা অসহায় বোধ করার মতো নেতিবাচক খাপ খাওয়ার কৌশলগুলো দৈনন্দিন মেজাজের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তাই সেগুলোকে বাদ দিয়ে অতিমাত্রায় ইতিবাচক মেজাজ বজায় রাখার জন্য যা দরকার তা হচ্ছে—ইতিবাচক রিফ্রেমিং, আপস সমঝোতা, এবং আবেগকে নিয়ন্ত্রণ। এ ক্ষেত্রে পিতামাতাদের বেশি বেশি আনন্দদায়ক কার্যক্রমের মধ্যে যুক্ত হওয়া জরুরি যা প্রাত্যহিক মেজাজের উন্নতি ঘটাতে সহায়ক হবে।

মনোবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল গোল্ডম্যানের মতে, আবেগিয় বুদ্ধিমত্তা যে পাঁচটি উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত তা হলো— আত্মসচেতনতা, যেটি ব্যক্তিগত অনুভূতিগুলো বুঝতে পারার মাধ্যমে হয়; আত্মনিয়ন্ত্রন, আবেগীয় প্রক্রিয়া (জেদ, রাগ, হিংসা, ঈর্ষা), ফলে হুটহাট বা ক্ষতিকর কিছু করে ফেলার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা; প্রেরণা, যা ব্যক্তির আকাঙ্ক্ষা অর্থাৎ যে কোনো কাজের ক্ষেত্রে উৎসাহ প্রদান করে থাকে; সহমর্মিতা তথা ব্যক্তির পরিস্থিতিকে তার দৃষ্টিভঙ্গিকে বুঝতে পারা, অর্থাৎ পারস্পরিক সমর্থন ও সহযোগিতাবিষয়ক মানবিক গুণ এবং  সামাজিক দক্ষতা, যার মাধ্যমে সঠিক প্রক্রিয়ায় আবেগীয় প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ করা সম্ভব।

মূলত অন্যের অনুভূতি বুঝে সরাসরি কথোপকথনের মাধ্যমে নিজের বক্তব্য প্রকাশ করা ও অপরের বক্তব্য বুঝতে পারার মাধ্যমে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ বিষয়গুলো চর্চার মাধ্যমে পিতা-মাতা তাদের অটিজম অথবা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর পরিচর্যার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের আন্তঃসম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে পারে।

 

লেখক : ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, ইপনা, বিএসএমএমইউ, ঢাকা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads