• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জৈষ্ঠ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

চরাঞ্চলের চাষাবাদ

সৃষ্টি করেছে নতুন সম্ভাবনা

  • আবদুল হাই রঞ্জু
  • প্রকাশিত ২৮ মে ২০২১

বাংলাদেশ নদীমাতৃক হলেও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত, উজান থেকে আসা পানির স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা, অনাবৃষ্টির দরুন নদ-নদীগুলো এখন পানির অভাবে শুকিয়ে সংকোচিত হয়ে পড়েছে। প্রথিতযশা প্রয়াত কলাম লেখক আবুল মুকসুদ এক সমাবেশে বলেছিলেন, বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। তবে এটি এখন নদী মৃত্যুর দেশে পরিণত হয়েছে। কথাটি সত্য, কিন্তু এ দেশের কৃষক যখন যে অবস্থা, সে অবস্থাকেই পোষ মানিয়ে জীবন-জীবিকার লড়াই করে আসছে সেই আদিকাল থেকেই। এখন জনসংখ্যা বাড়তে বাড়তে ছোট্ট ভূখণ্ডের এই বাংলাদেশে আজ প্রায় ১৮ কোটি মানুষের বসবাস! দেশের ভৌগোলিক সীমারেখা কার্যত স্থির। এমনকি প্রতিবছরই নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, রাস্তাঘাট, বসতবাড়ি, হাটবাজার, অফিস আদালত নির্মাণে আবাদি জমি কমে আসছে। এরপরও বৃহৎ জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা দেশীয়ভাবেই উৎপাদন করে আজ জোগান দিচ্ছে এদেশের কৃষক। ফলে মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম নিয়ামক ভাতের জোগানও দেশীয়ভাবেই নিশ্চিত হচ্ছে। যদিও মাঝে মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে ধানের ফলন বিপর্যয়ের কারণে সাময়িক কষ্টে পড়ে সাধারণ ভোক্তারা। তবু সার্বিকভাবে খাদ্যশস্য উৎপাদন করে স্থানীয় চাহিদা তো পূরণ হচ্ছে, এমনকি চাহিদা পূরণের পর বিভিন্ন জাতের সবজি এখন দেদার বিদেশে রপ্তানিও হচ্ছে।

মূলত নদ-নদীগুলো সংকোচিত হয়ে বিশাল বিশাল চরের সৃষ্টি হচ্ছে। আবার এসব চরে পলি পড়ায় যে উর্বরতা সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে বাদাম, আলু, শসা, কুমড়া, লাউ, শীমসহ নানা জাতীয় সবজির চাষাবাদ হচ্ছে। রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম জেলার ভিতর দিয়ে তিস্তা ও প্রমত্তা ব্রহ্মপুত্র প্রবাহিত হচ্ছে। এসব নদীর মধ্যে তিস্তা রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, পীরগাছা, লালমনিরহাট, গাইবান্ধার সীমানা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রামের চিলমারী বন্দরের ভাটিতে এসে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ফলে মাইলের পর মাইল জুড়ে চর পড়েছে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে। আর এসব চরাঞ্চলে এখন বন্যার পানির সঙ্গে পলি এসে পড়ায় উর্বতা শক্তি এমন বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে সামান্য পরিমাণ রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে বাদাম, লাউ, কুমড়াসহ নানা জাতীয় সবজির ব্যাপক চাষাবাদ হচ্ছে। বিশেষ করে রংপুর অঞ্চলের এসব চরের বাদামের মান এতই ভালো যে, প্রতিবছরই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকাররা এসে বাদাম কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। গঙ্গাচড়া উপজেলার চর চিলাখাল, মানুষ খাওয়া, নেল্টা, মহিপুর, চালাপাক ও কাউনিয়া উপজেলার গড্ডিমারী, মধ্যপুরসহ বিভিন্ন চরে এবছর বাদামের বাম্পার ফলন হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূল থাকায় ফলনও ভালো হয়েছে এবং বাদামচাষিরা লাভবানও হয়েছেন। রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এ বছর রংপুর জেলায় ৩৯০ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ করা হয়েছে। আর গত বছর চাষের আওতায় ছিল ২৫০ হেক্টর জমি। বাদাম চাষ করে লাভবান হওয়ায় প্রতিবছরই বাদাম চাষের আওতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ থেকে সার, বীজ দিয়েও সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। যদিও এসহায়তার পরিমাণ অনেক কম। যদি সরকারি ভাবে বাদাম উৎপাদনে প্রয়োজনীয় উপকরণ সহায়তা প্রদান ও সহজ শর্তে স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে আমিষ সমৃদ্ধ বাদাম ব্যাপক ভাবে চাষ করা সম্ভব হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মোট চাহিদার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ বাদাম উৎপাদিত হয়। অর্থাৎ এখনও বাদামের প্রচুর ঘাটতি রয়েই গেছে। যদিও এ চাহিদা পূরণ করতে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা উন্নতজাতের চিনাবাদাম উদ্ভাবনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। ইতিমধ্যেই বিনা চিনাবাদাম-৪ নামে চিনাবাদামের বীজ জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক বাণিজ্যিকভাবে সারা বছর চাষাবাদের জন্য ছাড়পত্র দিয়েছে। এ জাতটি মূলত খরাসহিষ্ণু, ফলে চরাঞ্চলে চাষাবাদের জন্য অধিক উপযোগী। এমনকি জাতটি কলাররট, সার্কোম্পোরা লিফস্পট ও মরিচা রোগ সহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন। আর এটি বাদাম ও বীজ মাতৃজাত ঢাকা-১ এর চেয়ে বড়। ফলে বাজারে এটার চাহিদাও বেশি হবে এবং বাদামচাষিরা লাভবান হতে পারবেন।

শুধু রংপুর, লালমনিরহাটের চরাঞ্চলেই বাদাম ও শাক সবজির আবাদ হচ্ছে তাই নয়। কুড়িগ্রামের দুর্গম চরাঞ্চলেও এখন নানাজাতের শাকসবজি ও বাদামের ব্যাপক চাষাবাদ হচ্ছে। কুড়িগ্রাম জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সূত্রমতে, জেলায় ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমরসহ ১৬টি নদ-নদীর অববাহিকায় প্রায় সাড়ে চার শতাধিক চরের ৪৬ হাজার ৪ শত ২৮ হেক্টর জমির মধ্যে বর্তমানে চাষাবাদ হচ্ছে ৩৫ হাজার ৮৭ হাজার হেক্টর জমিতে। এসব জমিতে চাষীরা এখন নানা জাতের ফসল-ফলাদি চাষাবাদ করছে। কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জানান, চরাঞ্চলসহ জেলার ১ লাখ ১৯ হাজার কৃষককে কৃষি প্রণোদনার আওতায় উন্নত জাতের বীজ ও সার সরবরাহ করা হয়েছে। বিশেষ করে চরাঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে বীজ, সার সরবরাহের পাশাপাশি উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদের পরামর্শ দেয়ায় এখন চরাঞ্চলে শাকসবজিসহ নানা জাতের ফসল উৎপাদন হচ্ছে। বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় চরাঞ্চলে এখন চাষিরা শ্যালোমেশিনের সাহায্যে সেচ দিয়ে বোরো ধান, পাট, ভুট্টা, গম, কালাই, সরিষা, সূর্যমুখী, চিনাবাদাম, টমেটো, মরিচ, পেঁয়াজসহ নানা জাতীয় ফসলের চাষাবাদ করছে। প্রকৃত অর্থে এক সময়ে পড়ে থাকা সুবিশাল চকচকে বালির চরাঞ্চলে এখন চাষাবাদ করায় সবুজের সমারোহ চোখে পড়ছে। এখন চরের মানুষের জীবন-জীবিকার সমূহ উন্নতি হয়েছে। তবে সনাতন পদ্ধতির চাষাবাদের কারণে অনেক সময়ই ভাল ফলন পাওয়া থেকে তারা বঞ্চিতও হচ্ছেন। তবে, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ যেভাবে তদারকি ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে,তার পরিধি আরো বৃদ্ধি করতে হবে এবং সরকারকে সহজ শর্তে কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে চরাঞ্চলের চাষাবাদ বৃদ্ধি করে আমাদের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর খাদ্য উৎপাদনের পরিধি আরো বৃদ্ধি করা সম্ভব। আমরা দেখে আসছি, সরকার গুটিকতক শিল্প গ্রুপের সমৃদ্ধিতে নানাভাবে ঋণ সুবিধা ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ সুবিধা, সুদ মওকুফ কিম্বা ঋণ পরিশোধে সময়সীমা বৃদ্ধির মতো নানাভাবে সহায়তা দিয়ে থাকে। অথচ কৃষিভিত্তিক আমাদের দেশে কৃষকদের স্বার্থে এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় না বললেই চলে।

যদিও সরকার প্রতিবছরই কৃষিখাতে বাজেটে অর্থ বরাদ্দ রাখেন, কিংবা ভর্তুকি প্রদান করেন, যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। অথচ এই কৃষকরাই আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। কারণ কৃষক চাষাবাদ করে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা পুরণ করে আসছে। ফলে এখন আর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে খাদ্য আমদানি করতে হয় না। যদিও বিশেষ পরিস্থিতিতে চাল ও গম আমদানি করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রেও সরকারের অদূরদর্শিতাই দায়ী! কারণ গম চাষের জমির পরিধি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে সামান্য সেচে চরাঞ্চলে গমের ব্যাপক চাষাবাদ করা সম্ভব। দুর্ভাগ্য, আমাদের দেশের সরকার গম আমদানিতে যে ভাবে আগ্রহী, সেভাবে গম উৎপাদনের দিকে আগ্রহী নন। অথচ বিশেষ প্রকল্পের আওতায় গম চাষে প্রনোদনা, ঋণ সহায়তা, বীজ সরবরাহ উপকরণ সরবরাহ করলে গমের উৎপাদনও বৃদ্ধি করা সম্ভব হতো। বিশেষ করে গম উৎপাদনের পর তা সরকারিভাবে উপযুক্ত মূল্যে কেনার ব্যবস্থা নিলে গম উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। বাস্তবে সরকার নানা অজুহাতে গম উৎপাদনের দিকে নজর না দিয়ে আমদানি নির্ভরতা থেকে সরে আসছে না। এতে গম আমদানির সহিত জড়িত একটি গোষ্ঠীর পোয়াবারো অবস্থা হলেও দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা মনে করি, যেহেতু চরাঞ্চলে এখন ব্যাপকভাবে নানাজাতের ফসল চাষাবাদ হচ্ছে। সেখানে উন্নতমানের বীজ সরবরাহ করে গমচাষিদের প্রণোদনা দিলে গম উৎপাদন বৃদ্ধি করে স্থানীয় চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ করা সম্ভব।

এমন এক সময় ছিল, যখন সেচভিত্তিক চাষাবাদের তেমন প্রচলন ছিল না। শৈশবে এসব চাষাবাদের চিত্র দেখেছি। তখন মানুষের খাদ্য সংকট ছিল প্রবল। মানুষ চালের ভাতের পরিবর্তে কাউনের চালের ভাতও খেতো। এখন সেচভিত্তিক চাষাবাদের বদৌলতে মানুষের যে খাদ্য সংকট আর নেই। তবে কাউনের তৈরি চালে মানুষ এখন ভাত না খেলেও মজাদার খাবার পায়েস, মলা জাতীয় খাবার তৈরি করে খাচ্ছে।

আর এখন কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার অববাহিকার চর বুড়াবুড়ি, সাহেবের আলগা, বেগমগঞ্জ, হাতিয়া, তিস্তার চর, থেতরাই, দলদলিয়া, গুনাইগাছ, বজরা ইউনিয়নের শতাধিক চর ও দ্বীপচরে এখন ব্যাপকভাবে কাউনের চাষাবাদ হচ্ছে। এখন ধু-ধু বালুচরগুলোয় সবুজের সমারোহ। যেহেতু কাউনের চাষ ব্যাপকভাবে করা সম্ভব হচ্ছে, সেখানে সরকার পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হলে গমের চাষাবাদেও এক বিপ্লব ঘটানো সম্ভব বলে আমরা মনে করি। কারণ আমাদের দেশের কৃষি বিভাগের বিজ্ঞানী ও উদ্যোগী কর্মকর্তাদের পরামর্শে কৃষিতে ব্যাপক সাফল্য এসেছে। সুতরাং মনে করাই স্বাভাবিক, গম উৎপাদন বৃদ্ধি করে আমরা আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে এনে বৈদেশিক মুদ্রাও সঞ্চয় করতে সক্ষম হবো। দুর্ভাগ্য, আমাদের দেশের ক্ষমতাসীনরা শুধু শ্রেণিস্বার্থেই জনগণের অর্থ অপচয় করে পুঁজিপতি গোষ্ঠীর সমৃদ্ধিতে নানাভাবে উদ্যোগ নিলেও কৃষক ও কৃষির স্বার্থে সেভাবে অর্থব্যয়ের দিকে নজর দেয় না। দিন যাচ্ছে মানুষ বাড়ছে, যা প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের ভৌগোলিক সীমারেখা তো আর বাড়ছে না বরং দিন দিন নানা কারণে আবাদি জমির পরিমাণ কমে আসছে। সেহেতু আমরা মনে করি, খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে চরাঞ্চলের চাষাবাদকে উন্নত প্রযুক্তির চাষাবাদে সমৃদ্ধ করা উচিৎ। তাহলে মানুষ বৃদ্ধি পেলেও দেশীয়ভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি করে আমরা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা পূরণে সক্ষম হবো। সরকার জনস্বার্থে উন্নত প্রযুক্তির চাষাবাদে চরাঞ্চলগুলোকে সমৃদ্ধ করে গমসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদনের দিকে বিশেষ ভাবে নজর দিয়ে ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করবে, এটাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা।

 

লেখক : সমাজকর্মী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads