• শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

আম রপ্তানি এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন

  • প্রকাশিত ২৪ জুন ২০২১

আবদুল হাই রঞ্জু

 

ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যে ঘেরা অপরূপ প্রকৃতির বাংলাদেশ। মূলত বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস এলেই নানা জাতের ফল ফলাদি দেশে পাওয়া যায়। বিশেষ করে আম, লিচু, কাঁঠাল, জাম, জামরুল, আনারস, তরমুজ, পেঁয়ারা, বাঙি অন্যতম। অনেকেই জ্যৈষ্ঠ মাসকে ‘মধু মাস’ বলেও ডাকেন। জ্যৈষ্ঠ পেরিয়ে আষাঢ় চলছে। আষাঢ় মাস তো বটেই, এমনকি আশ্বিন মাসেও এখন আশ্বিনা আম পাওয়া যায়। যদিও সে আমের মিষ্টি, স্বাদ কম আবার সরবরাহও কম। এখন চলছে আমের ভরা মৌসুম। কম-বেশি দেশের সর্বত্র নানা জাতীয় আম পাওয়া যায়। কারণ আমাদের দেশে প্রতিটি বাড়িতেই আমের গাছ আছে। আমের মৌসুমে প্রতিটি বাড়িতেই কম-বেশি আম পাওয়া যায়। এমনকি এমন পরিবার আছে যারা আমের মৌসুমে আম বিক্রি করেও অর্থ উপার্জন করে থাকেন। নিজেদের গাছে আম, কাঁঠাল থাকায় আম যেমন সহজেই খাওয়া যায়, তেমনি আম বিক্রি করে অনেকেই উপকারও পান। আবার আম এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষও হচ্ছে। একসময় চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী অঞ্চলে ব্যাপকভাবে আমের চাষাবাদ হলেও এখন দেশের সর্বত্র বাণিজ্যিকভাবে আমের চাষাবাদ হচ্ছে। এখন রংপুর অঞ্চলের বিখ্যাত সুস্বাদু ও জনপ্রিয় আম হচ্ছে হাঁড়িভাঙ্গা, আম্রপালি, গোপালভোগ, ক্ষীরশাপাতি, ল্যাংড়া, রাণীভোগ, ফজলিসহ নানা জাতের সুস্বাদু আম স্থানীয় মানুষের চাহিদা পূরণ করে অন্যান্য জেলায় দেদার সরবরাহ হচ্ছে। যদিও এ বছর আমের দাম বেশ চড়া। সচরাচর এ অঞ্চলে আমের দাম অন্যান্য বছর কম ছিল। কিন্তু এ বছর প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে আমের উৎপাদন কিছুটা কমই হয়েছে। আর অর্থনীতির সূত্রই হলো, যে কোনো পণ্যের সরবরাহ কম হলে তার দাম একটু বেশিই হবে। আবার সরবরাহ বাড়লে দাম কমবে। বাস্তবে এ মৌসুমে কুড়িগ্রামে আমের সরবরাহ অন্যান্য বছরের তুলনায় কম থাকায় চড়া দামেই আম কিনে খেতে হচ্ছে। পক্ষান্তরে মহামারি করোনার ছোবলে সাম্প্রতিক সময়ে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে সংক্রমণের হার বেশি থাকায় সেখানে স্থানীয়ভাবে চলছে লকডাউন। ফলে ভরা আমের মৌসুমে আম সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় আমচাষিরা আমের উপযুক্ত মূল্য থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন।

অথচ আম বাণিজ্যিকভাবে এখন চাষ হয়ে থাকে। করোনার কারণে এ বছর যেসব জেলা আম উৎপাদনে শীর্ষে, সেসব জেলায় করোনার প্রকোপও বেশি। ফলে আশংকা করা হচ্ছে, এ বছর আম চাষিরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। দেশের অন্তত ছয়টি জেলার অন্যতম বাণিজ্যিক কৃষিপণ্য হয়ে উঠেছে আম। বছর বছর আমের বাগানও বাড়ছে, আবার উৎপাদনও বৃদ্ধি পাচ্ছে। অমিত সম্ভাবনার ভিটামিনযুক্ত ফলের উৎপাদন যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে দেশীয় চাহিদা পূরণ করার পরও বিদেশে আম রপ্তানিও হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, দেশে ২ লাখ ৩৫ হাজার একর জমিতে আম বাগান রয়েছে। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমের উৎপাদন হয়েছে ১২ লাখ ২২ হাজার টন।

আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরা উন্নত জাতের আম ও উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করায় আম চাষে অনেক সমৃদ্ধি এসেছে। ফলে আমের বাণিজ্যিক উৎপাদন প্রতিনিয়তই বৃদ্ধিই পাচ্ছে। আমের উৎপাদন এখন আর বিশেষ কোন অঞ্চলে আটকে নেই, এখন গোটা দেশেই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আম উৎপাদন হচ্ছে। এখন পার্বত্য অঞ্চল থেকে শুরু করে দেশের সর্বত্রই আমের বাণিজ্যিক চাষাবাদ চলছে। দেশে এখন প্রায় ১৫ লাখ টনের বেশি আম উৎপাদন হয়। দেশের উৎপাদিত আমে দেশীয় চাহিদা পূরণ করে যেহেতু রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে, সরকারও আম রপ্তানির ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। আমের রাজধানী খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী জেলার আম উৎপাদন এলাকায় সরকার চারটি ভ্যাপার হিট ব্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা করছে। এতে আমের সংরক্ষণকাল বৃদ্ধি পাবে। ফলে আম সংরক্ষণ করে আম উৎপাদনকারীরা আম রপ্তানি করতে পারবে। এছাড়া আম উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সরকার আম উৎপাদনকারীদের অনুকূলে স্বল্পসুদে বিশেষ ঋণ প্রদান এবং আম বাগান করতে বিনামূল্যে উন্নত জাতের আমের চারা বিতরণেরও উদ্যোগ নিয়েছে। এ উদ্যোগ যে যথার্থ, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ উন্নত জাতের চারা বিনামূল্যে সরকারের তরফে বিতরণ করা হলে আমের বাগান বৃদ্ধি পাবে এবং আম উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে। যেহেতু প্রতিনিয়তই আমাদের জনসংখ্যা বাড়ছেই, সেহেতু লাগসই প্রযুক্তিনির্ভর চাষাবাদের দিকে আমাদের এগুতে হবে। এ জন্য সরকারের তরফে দীর্ঘমেয়াদি স্বল্পসুদে বিশেষ ঋণদানের কর্মসূচি বাস্তবায়ন হলে আম উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। কারণ আমাদের দেশে আম বাগান করার মতো যথেষ্ট সুযোগ এখনো বিদ্যমান রয়েছে। শুধু সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আম উৎপাদনে অভূতপূর্ব অর্জনে সক্ষম হবো বলে আমাদের বিশ্বাস। বিশেষ করে রংপুর অঞ্চলে হাঁড়িভাঙ্গা সুস্বাদু আমের উৎপাদন ও চাহিদা দুটোই বেড়েছে। এক্ষেত্রে হাঁড়িভাঙ্গার চারা বিনামূল্যে সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া সরকারের তরফে অতীব জরুরি বলে আমরা মনে করি।

সচরাচর হিমসাগর, ল্যাংড়া, আম্রপালি জাতের আম রপ্তানি হলেও এবার প্রথম বারের মতো সাতক্ষীরার গোবিন্দভোগ আম রপ্তানি হচ্ছে জার্মানিতে। গত ৮ মে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার কেরেলকাতা ইউনিয়নের পুটুলি এলাকার আমচাষি দাউদ মোল্লার বাগানের গোবিন্দভোগ আম পেড়ে প্রক্রিয়াজাত করে চলতি মৌসুমে আম রপ্তানির উদ্বোধন করা হয়। সাতক্ষীরার আম স্বাদে ও গন্ধে অতুলনীয়। তবে গত বছর আম্ফানের কারণে আম রপ্তানি বিঘ্নিত হলেও এ বছর সাতক্ষীরা থেকে আম রপ্তানি শুরু হয়েছে। ভৌগোলিক ও মাটির কারণে সাতক্ষীরার আম ন্যূনতম ১৫-২০ দিন আগে পাকে। ফলে মৌসুমের প্রথমেই সাতক্ষীরার আম দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহও শুরু হয়। যে কারণে সাতক্ষীরার আমচাষিরা আমের দামও ভালো পেয়ে থাকেন। এখন আর শুধু সাতক্ষীরা, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জই নয়- নওগাঁয় এখন ব্যাপকভাবে আমের চাষ হচ্ছে। নওগাঁর বরেন্দ্র এলাকার সাপাহার, পোরশা, নিয়ামতপুর ও পত্নীতলার আংশিক এলাকায় এখন সুস্বাদু আম্রপালির ব্যাপক চাষাবাদ হওয়ায় এ অঞ্চল বিখ্যাত হয়ে গেছে। সাপাহার উপজেলার ‘বরেন্দ্র অ্যাগ্রো পার্কের’ মালিক সোহেল রানার বাগান থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় আম্রপালি আম যুক্তরাজ্যে রপ্তানি করা হয়েছে। সোহেল রানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে ২০১৫ সালে নিজ গ্রামের খাড়িপাড়া এলাকায় ১২ বিঘা জমির ওপর গড়ে তোলেন ‘রুপগ্রাম অ্যাগ্রো ফার্ম’ সমন্বিত কৃষি খামার। নিজ মেধা, প্রজ্ঞা এবং পরিশ্রমে ১৪০ বিঘা জমির ওপর পৃথক দুটি সমন্বিত কৃষি খামার গড়ে তুলেছেন। এখানকার উৎপাদিত আম স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে রাজধানীতে ব্যাপকভাবে সরবরাহ করা হচ্ছে এবং বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। আর কীটনাশক ছাড়া আম উৎপাদন ও ব্যাগিং পদ্ধতির বদৌলতে আমাদের দেশের আম এখন বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে, আবার দেশের মানুষও বিষমুক্ত আম খেতে পাচ্ছেন। ‘ফ্রুট ব্যাগিং’ পদ্ধতিতে উৎপাদিত আম নিরাপদ বালাইমুক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত। এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত আমের চাহিদা দেশে বিদেশে সমান। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ‘ফ্রুট ব্যাগিং’ পদ্ধতিতে চাষ করা আম রপ্তানি হচ্ছে। গত ২ মে রাজশাহী সেনানিবাসের পাশে ৫ বিঘার একটি আম বাগানে ‘ফ্রুট ব্যাগিং’ পদ্ধতি কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন।

উল্লেখ্য, যে সময়ে আমরা আম ও ফলমূলে বালাইনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার নিয়ে চিহ্নিত ও উদ্বিগ্ন ছিলাম, সে মুহূর্তে ‘ফ্রুট ব্যাগিং’ প্রযুক্তিটি বাংলাদেশে একটি নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। কারণ ‘ফ্রুট ব্যাগিং’ পদ্ধতি বিষমুক্ত ফল উৎপাদন ও পরিবেশবান্ধব। ‘ফ্রুট ব্যাগিং’ পদ্ধতি আমের জন্য দুই ধরনের ব্যাগ ব্যবহূত হয়ে থাকে। বিশেষ করে বাদামি রঙের ব্যাগের চাহিদা বেশি। আর ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে শুধু আমই নয়- কলা, পেয়ারা, ডালিম, কাঁঠাল চাষ হচ্ছে। ফলে এ প্রযুক্তির বদৌলতে উৎপাদিত ফল নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত ও রপ্তানি উপযোগীও বটে। মূলত ৩৫ থেকে ৪০ দিন বয়সের আম ব্যাগিং করা হয়ে থাকে। অবশ্য ব্যাগিং পদ্ধতি টেকসই প্রযুক্তিতে নিয়ে আসতে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের নিরলস প্রচেষ্টা অনস্বীকার্য। বিশেষ করে ঘন গাছের আম বাগানে সূর্যের আলো ঠিকমতো না পৌঁছানোর কারণে আমের মাছি পোকার আক্রমণ বেশি হয়, যা কীটনাশক ব্যবহার করেও শতভাগ দমন করা সম্ভব হয় না। অথচ এই ‘ব্যাগিং প্রযুক্তির’ ব্যবহারে শতভাগ রোগ ও পোকামাকড় দমন করা সম্ভব। ফলে আমের গায়ে যেমন দাগ লাগে না, তেমনি বিষমুক্ত আমও পাওয়া সম্ভব। ফলে ব্যাগিং পদ্ধতির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং মানুষও বিষমুক্ত আমের স্বাদ গ্রহণে সক্ষম হচ্ছে। চলতি মৌসুমে আমের রাজ্য হিসেবে খ্যাত রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে অনন্ত ১১ কোটি আম নিরাপদ ও বিষমুক্ত করা হয়েছে ‘ফ্রুট ব্যাগিংয়ের’ মাধ্যমে। শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১০ কোটি ও রাজশাহীতে এক কোটি আমে ‘ফ্রুট ব্যাগিং’ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে তা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এসব এলাকায় একটি ব্যাগ ৩ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৭ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। বলতে দ্বিধা নেই, আমের ব্যাগিংয়ের জন্য একটি ব্যাগের যে দাম রাখা হচ্ছে, তা অনেক চড়া। এক্ষেত্রে সরকারের তরফে নিরাপদ ফল উৎপাদনের জন্য নিম্নমূল্যে ব্যাগ উৎপাদন করে চাষি পর্যায়ে বিপণন করা সম্ভব হলে উৎপাদন খরচও কম হবে এবং উৎপাদনকারীরা শতভাগ ‘ফ্রুট ব্যাগিং’ পদ্ধতিকে অনুসরণ করবে। কারণ আম কৃষির অন্তর্ভুক্ত পণ্য। যে কারণে আমসহ ৯টি পণ্য ভৌগোলিক নির্দেশ বা জিআই সনদ লাভ করেছে। এতে বাংলাদেশের উৎপাদিত আম বিশ্ববাজারে একটি ব্রান্ড হিসেবে চিহ্নিত হবে। অতি সম্প্রতি শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তরের (ডিপিডিটি) উদ্যোগে আয়োজিত ‘জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে মেধাসম্পদ’ শীর্ষক সেমিনার এবং মেধাসম্পদ দিবস-২০২১ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের হাতে জিআই সনদ তুলে দেওয়া হয়।

প্রকৃত অর্থে দেশীয় পণ্য উৎপাদনে সরকারের নানামুখী সহযোগিতার কোনো বিকল্প নেই। আমরা মনে করি, মাত্র ক’বছর আগেও যেখানে মোবাইল কোর্ট করে ফরমালিনযুক্ত শত শত মন আম নষ্ট করা হয়েছে, সেখানে নতুন এই ‘ফ্রুট ব্যাগিং’ প্রযুক্তি বিষমুক্ত আম উৎপাদনে এক যুগান্তকারী অবদান রাখতে সম্ভব হয়েছে। আম উৎপাদনকারীরা যেন ন্যূনতম স্বল্পমূল্যে ‘ফ্রুট ব্যাগ’ কিনতে পারে, সে ব্যাপারে সরকার যথোপযুক্ত সময়োচিত সঠিক সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করবে, এটাই দেশের মানুষের প্রত্যাশা।

 

লেখক : কৃষি বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads