• বুধবার, ৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪২৯

শিক্ষা

কেজি স্কুল বাগে আনতে সরকারি প্রাথমিকে ‘নার্সারি’

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০৫ এপ্রিল ২০১৮

কিন্ডারগার্টেন (কেজি) স্কুলকে ঠেকাতে এবার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘নার্সারি’ শ্রেণি চালুর পরিকল্পনা করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। আগামী বছরের শুরুতে আনুষ্ঠানিকভাবে এ নার্সারি শ্রেণির আত্মপ্রকাশ ঘটতে পারে বলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। অথচ কেজি স্কুলগুলো বন্ধে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। এখন ফের নতুন পদ্ধতি বাতলানো হচ্ছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দেশের নানা প্রান্তে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের রমরমার কারণে সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা ঝিমিয়ে পড়ছে। শিশুরা ৫ বছর বয়সী না হলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না। অথচ ৩ বছর বয়সেই কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভর্তি হওয়া যায়। এতে একধরনের বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে।

এ রকম পরিস্থিতিতে বেশ কয়েকজন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির বয়স ৪ বছর করার জন্য বলেছেন। তবে এ প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, নিয়ম যা আছে, তা-ই থাকবে। শুধু ‘নার্সারি’ নামে আরেকটি শ্রেণি যুক্ত করা হবে। সে ক্ষেত্রে একটি শিশু ৪ বছর বয়সে প্রথমে ‘নার্সারি’, ৫ বছর বয়সে ‘শিশু শ্রেণি’ এবং ৬ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হবে। এর ফলে শিশুরা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে যেতে নিরুৎসাহিত হবে। আইন করে আর কিন্ডারগার্টেনের লাগাম টানতে হবে না।

জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. গিয়াস উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশের খবরকে জানান, বয়স কমিয়ে ভর্তি নয় বরং প্রাথমিকে ‘নার্সারি’ নামে আরেকটি শ্রেণি চালু করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। জানুয়ারি থেকেই তা হতে পারে। তবে এর আগে বিষয়টি নিয়ে শিক্ষাবিদ ও গবেষকদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নানা সুযোগ-সুবিধা পেয়েও চটকদারিতার কারণে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সঙ্গে পেরে উঠছে না সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো। একপর্যায়ে গত ২০১৬ সালে কিন্ডারগার্টেন স্কুলকে বাগে আনার জন্য মন্ত্রণালয় সারা দেশে ৫৫৯টি টাস্কফোর্স গঠন করেছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত সব টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে এসে পৌঁছায়নি।

এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গিয়াস উদ্দিন আহমেদ জানান, কিছু প্রতিবেদন এসেছে। কিন্তু তাতে কিন্ডারগার্টেন স্কুল নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু উল্লেখ না থাকায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় প্রাথমিকে ‘নার্সারি’ শ্রেণি বাড়ানো ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।

তবে অতিরিক্ত সচিব গিয়াস উদ্দিন আহমেদের এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ। তিনি বাংলাদেশের খবরকে জানান, একক ভাবনায় কোনো কিছু করা ঠিক হবে না। সবার মতামত নিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি হয়েছে। তাতে বলা আছে, কী করতে হবে। তবু যদি নতুন কিছু করতে হয়, তাহলে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হবে না।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সারা দেশেই, বিশেষত শহরাঞ্চল ও মহানগরগুলোয় চাহিদার তুলনায় মানসম্মত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অভাবে যত্রতত্র কিন্ডারগার্টেন স্কুল চালু হয়েছে। বাসস্থানের নিকটবর্তী হওয়ায় এবং নিরাপত্তার কারণে অনেক অভিভাবকই অনিচ্ছা সত্ত্বেও সন্তানকে এসব স্কুলে ভর্তি করান। কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা বিষয়ে সরকারি কোনো সুস্পষ্ট নীতিমালা না থাকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এবং ব্যক্তিবিশেষের মর্জিমাফিক এসব স্কুল পরিচালিত হয়। কিন্ডারগার্টেন শিক্ষাব্যবস্থায় প্রথম শ্রেণিতে পড়ার আগে একটি শিশুকে প্লে, নার্সারি ও কেজি- এ তিনটি শ্রেণিতে মোট তিন বছর কাটাতে হয়। প্রতিটি শিক্ষার্থীকে মোটা অঙ্কের ভর্তি ফিসহ নানা ধরনের চার্জ পরিশোধ করে প্রতিবছর নতুনভাবে ভর্তি হতে হয়।

অনুমোদনহীন কিন্ডারগার্টেনগুলো বন্ধের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এসব স্কুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) সমন্বয়ে ৫৫৯টি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। এসব টিম এখন পর্যন্ত মাত্র ২২টি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে।

প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনা করে জানা গেছে, কোন জেলায় কতটি স্কুল আছে, সে তথ্য অনেক ডিসি উল্লেখ করেননি। অনেক ডিসি দাবি করেছেন, তার জেলায় এ ধরনের স্কুল নেই। টাস্কফোর্সের কাছে স্কুলের বৈধতা যাচাই ও চালু রাখার প্রয়োজনীয়তা জানতে চাইলেও তা উল্লেখ করা হয়নি। স্কুলের ব্যবস্থাপনা, শিক্ষার্থী ভর্তি, ফি নির্ধারণ ও আদায়, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, অবকাঠামো সুবিধাসহ নানা বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্য চাওয়া হলেও তা দেওয়া হয়নি। স্কুলে কী ধরনের পাঠ্যপুস্তক পড়ানো হয়, কারা স্কুল পরিচালনা করছেন, অর্থের উৎস কী, আদায় করা অর্থ কোথায় ব্যয় হয়, ব্যয়ের ক্ষেত্রে সরকারি বিধিবিধান মানা হয় কি না, এসব বিষয়ে কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। ডিসিদের পাঠানো এসব প্রতিবেদন ‘দায়সারা’- এমন মন্তব্য করে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, করণীয় সম্পর্কেও সুস্পষ্ট মতামত দেননি তারা। এ কারণে অবৈধ স্কুলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টি আটকে আছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, অধিকাংশ কেজি স্কুল অবৈধ। সীমাহীন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ১৯৬২ সালের স্কুল নিবন্ধন আইনের আলোকে ২০১১ সালে একটি বিধিমালা করে। ওই বিধিমালায় কেজি স্কুল পরিচালনার জন্য ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন, টিউশন ফি নির্ধারণ, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত, শিক্ষক-কর্মচারীদের যোগ্যতা ও নিয়োগ, শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক, তহবিল পরিচালনা, বিদ্যালয়ের ভূমির পরিমাণ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট শর্ত আরোপ করা হয়। এতে সংরক্ষিত তহবিল, নিবন্ধন ফি, অস্থায়ী নিবন্ধন ফি, প্রাথমিক আবেদন ফি ইত্যাদিও সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু ওই প্রজ্ঞাপন জারির ঠিক এক বছরের মাথায় সেই ফির হার প্রায় অর্ধেক কমিয়ে সংশোধিত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। অর্থাৎ একটি বিদ্যালয়ের জন্য সংরক্ষিত তহবিল মহানগর এলাকার জন্য যেখানে এক লাখ টাকা ছিল, সেখানে তা ৫০ হাজার টাকা করা হয়। কেজি স্কুলের মালিকদের চাপে সরকার এ সংশোধনী আনতে বাধ্য হয়। ওই বিধিমালার আওতায় ৬১৬টি স্কুল নিবন্ধিত হয়। আরো ৭৫১টি অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। অথচ কেজি স্কুলের বিভিন্ন সমিতির তথ্য মতে, সারা দেশে এ ধরনের অন্তত ৫০ হাজার স্কুল রয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads