• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯

দারুণ ফল। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজে তাই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা মেতে ওঠে আনন্দ উল্লাসে

মিজানুর রহমান খান

শিক্ষা

জিপিএ ছাড়া সব সূচক নিম্নমুখী

  • অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য
  • প্রকাশিত ০৭ মে ২০১৮

regular_2070_news_1525623893 (1)

একমাত্র জিপিএ-৫ বেড়ে যাওয়া ছাড়া সব সূচকে এবারকার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলে অবনমন ঘটেছে। গত বছর যেখানে সার্বিক পাসের হার ছিল ৮০ দশমিক ৩৫ শতাংশ, এবার তা ৭৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৬২৯ শিক্ষার্থী। গতবার এই সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৪ হাজার ৭৬১। গতকাল রোববার চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার প্রকাশিত ফলের প্রাথমিক বিশ্লেষণে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

চলতি বছরের ফলাফলে ৮১ দশমিক ৪৮ শতাংশ পাসের হারের মধ্য দিয়ে রাজশাহী বোর্ড দেশসেরা হয়েছে। খারাপ ফলাফল সিলেট বোর্ডের। বোর্ডটিতে এবার পাস করেছে ৭০ দশমিক ৪২ শতাংশ। কুমিল্লা বোর্ডে যেখানে গত বছর সর্বনিম্ন ফল ৫৯ দশমিক ০৩ শতাংশ হয়েছিল, সেখানে এ বছর হয়েছে ৮০ দশমিক ৪০ শতাংশ।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, একমাত্র কুমিল্লা ছাড়া সব বোর্ডেই গত বছরের চেয়ে পাসের হার কমেছে।

বিশ্লেষকদের মধ্যে কেউ কেউ এ ফলকে খুব খারাপ না বললেও শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানরা বলছেন ফল ভালো হয়নি। তাদের মতে, এবার মানবিক বিভাগ ও জেলাওয়ারি পাসের হারে ধাক্কা লাগায় সার্বিক ফলে তার রেশ লেগেছে। পাশাপাশি সব সময়ের মতো এবারো গণিত ও ইংরেজিতে খারাপ করেছে শিক্ষার্থীরা। আর উত্তরপত্র মূল্যায়নে সারা দেশের মধ্যে সমতা আনতে কড়াকড়ি হওয়ার কারণেও পাসের হার কমেছে।

জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেন, মানবিক বিভাগের খারাপ ফল এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে গণিত ও ইংরেজিতে শিক্ষার্থীরা বেশি ফেল করায় সার্বিক ফলে ধাক্কা লেগেছে। আর সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুছ বলেছেন, গণিতের ‘সিকিউ’ অংশে শিক্ষার্থীরা বেশি খারাপ করায় তার বোর্ডে পাসের হার কমেছে।

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ যথারীতি গতকাল রোববার সংবাদ সম্মেলন করে ফলাফলের খুঁটিনাটি তুলে ধরেন। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনের ঠিক পরেই অনেকটা নজিরবিহীনভাবে ফল খারাপের কারণ খুঁজতে সব বোর্ড চেয়ারম্যানকে নিয়ে নিজ দফতরেই বৈঠকে বসেন তিনি।

বৈঠক শেষ হওয়ার পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এবার সিলেট বোর্ডে ১০ শতাংশের বেশি পাসের হার কেন কমল, কীভাবে কুমিল্লা বোর্ডে ২১ শতাংশের বেশি পাস বাড়ল, গণিত-ইংরেজিতে কেন এত শিক্ষার্থী ফেল করল তার কারণ খুঁজে বের করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বোর্ড চেয়ারম্যানদের নির্দেশ দিয়েছি। সাধারণ শিক্ষা বোর্ডগুলো ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমে এবং মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড সরাসরি মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠাবে।

এর আগে শিক্ষামন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ফাঁস হওয়া প্রশ্নে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া আনুমানিক পাঁচ হাজার শিক্ষার্থীর সবাইকেই খুঁজে বের করা হবে। কেউই রেহাই পাবে না। পরীক্ষার সময় অনেকে ধরা পড়েছে, ১৫৭ জন জেলে আছে, ৩২টি মামলা হয়েছে। পরে আরো শতাধিক গ্রেফতার হয়েছে। যারা গ্রেফতার হয়েছে, ধরা পড়েছে, তাদের সবার পরীক্ষা, শিক্ষাজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রশ্ন কেনা বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে যারা লেনদেন করেছে তাদেরকেও চিহ্নিত করা হচ্ছে বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী। এবারের এসএসসি পরীক্ষার ১৭টির মধ্যে ১২টি বিষয়ের এমসিকিউ অংশের ‘খ’ সেটের প্রশ্ন ফাঁস হয়েছিল বলে সরকারের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে আসে।

মানবিক বিভাগ এবং জেলাওয়ারি ফলাফলে এবার ধস : চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিজ্ঞান বিভাগে ৯৩ দশমিক ০৭ এবং ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে পাসের হার ৮০ দশমিক ৯১ শতাংশ হলেও মানবিক বিভাগে তা ৬৯ শতাংশ। বাণিজ্য বিভাগ থেকে ১১ দশমিক ৯১ এবং বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ২৪ দশমিক ০৭ শতাংশ পিছিয়ে আছে মানবিক বিভাগ। এটা সার্বিক ফলাফলে ভূমিকা রেখেছে। অধিকাংশ শিক্ষা বোর্ডে মানবিক বিভাগের ফলাফল ৬০ শতাংশের ঘরে রয়েছে। অথচ অন্যান্য বিভাগের সাফল্য কোথাও ৭০, কোথাও ৮০ শতাংশ ছাড়িয়েছে।

পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ঢাকা মহানগরী এবং জেলায় পাসের হার যেখানে ৯৮ শতাংশের ওপরে সেখানে টাঙ্গাইল জেলায় ইংরেজি ও গণিতে পাস করেছে ৭৭ দশমিক ১৩ এবং ৭৩ দশমিক ৬০ শতাংশ পরীক্ষার্থী। একইভাবে ইংরেজি ও গণিতে খারাপ ফল করেছে ফরিদপুর, রাজবাড়ী, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, মাদারীপুর জেলা।

পাশাপাশি বিষয়ভিত্তিক ফল বিশ্লেষণেও দেখা গেছে, গণিতে সবচেয়ে বেশি খারাপ ফল হয়েছে সিলেটে। ঢাকা বোর্ডে গণিতে পাসের হার ৮৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ হলেও সিলেট বোর্ডে একই বিষয়ে পাসের হার মাত্র ৭৬ দশমিক ৬১। ইংরেজিতে মোটামুটি সব বোর্ডেই পাসের হার ৯০ শতাংশ পার হলেও গণিতে কুমিল্লা ও রাজশাহী ছাড়া কোনো বোর্ডেই পাসের হার ৯০ শতাংশ ছুঁতে পারেনি। তবে গত বছর ইংরেজি বিষয়ে পাসের হার যেখানে ৯৯ শতাংশ ছুঁয়েছিল সেখানে এ বছর ৯৫ শতাংশের ওপর পাসের হার হয়েছে একমাত্র রাজশাহী বোর্ডে।

অথচ কঠিন দুই বিষয় ইংরেজি ও গণিতে ভালো ফল করার জন্য ‘সেকায়েপ’ প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন স্কুলে প্রশিক্ষণ ও অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু এটা কাজে আসেনি। শুধু সাধারণ শিক্ষা বোর্ডেই নয়, মাদরাসা বোর্ডের গণিত বিষয়েও পাসের হার কমেছে। গত বছর মাদরাসা বোর্ডের অধীনে গণিত বিষয়ে যেখানে পাসের হার ছিল ৯৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ, সেখানে এবার তা ৮০ দশমিক ২৯ শতাংশ।

জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, সারা দেশে মাত্র ২০০ উপজেলায় সেকায়েপের মাধ্যমে গণিত ও ইংরেজিতে অতিরিক্ত ক্লাস করানো হয়েছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, এতে খুব একটা কাজ হয়নি। তাই প্রকল্পটির মাধ্যমে আরো বেশি উপজেলায় যাতে অতিরিক্ত ক্লাস করানো যায় সে বিষয়ে কাজ করা হবে।

মাদরাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএম ছায়েফ উল্যাহ বলেন, গণিতের কারণে মূলত পাসের হার কমেছে ৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। তার মতে, গণিতে এবার প্রশ্ন কঠিন হয়েছিল।

আট বোর্ডে সেরা রাজশাহী, পিছিয়ে সিলেট, জিপিএ-৫ শীর্ষে ঢাকা : চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষায় আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে গড় পাসের হারে সবচেয়ে এগিয়ে রাজশাহী। এ বোর্ডে গড় পাসের হার ৮৬ দশমিক ০৭ শতাংশ। আর সবচেয়ে পিছিয়ে সিলেট বোর্ড। এ বোর্ডে গড় পাসের হার ৭০ দশমিক ৪২ শতাংশ। গতবার কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড অনেক পিছিয়ে থাকলেও এবার সেখানে পাসের হার ৮০ দশমিক ৪০ শতাংশ। এছাড়া ঢাকা বোর্ডে ৮১ দশমিক ৪৮, যশোরে ৭৬ দশমিক ৬৪, চট্টগ্রাম বোর্ডে ৭৫ দশমিক ৫০, বরিশালে ৭৭ দশমিক ১১ এবং দিনাজপুরে ৭৭ দশমিক ৬২ শতাংশ পাস করেছে। ২০০১ সাল থেকে গ্রেডিং পদ্ধতি চালুর পর থেকে ঢাকা বোর্ডের শিক্ষার্থীরা জিপিএ-৫ পাওয়ায় শীর্ষে অবস্থান করছে। এবার রাজশাহী বোর্ডে ১৯ হাজার ৪৯৮, কুমিল্লায় ৬ হাজার ৮৬৫, যশোরে ৯ হাজার ৩৯৫, চট্টগ্রামে ৮ হাজার ৯৪, বরিশালে ৩ হাজার ৪৬২, সিলেটে ৩ হাজার ১৯১ এবং দিনাজপুর বোর্ডে ১০ হাজার ৭৫৫ শিক্ষার্থী পূর্ণ জিপিএ পেয়েছে। এছাড়া মাদরাসা বোর্ডে ৩ হাজার ৩৭১ জন এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে ৪ হাজার ৪১৩ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে এবার।

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, মূল্যায়নের পদ্ধতি পরিবর্তনের কারণ এবার সার্বিকভাবে পাসের হার কমেছে। আগে অনেকে খাতা না দেখেই নম্বর দিয়ে দিতেন। এখন ভালো করে খাতা দেখার ফলে গতবারের মতো এবারো পাসের হার কমেছে। এর ফলে শিক্ষার ‘মান বৃদ্ধি পাচ্ছে’ দাবি করে নাহিদ বলেন, এখন ঝরে পড়ার হারও কমছে।

পাসে মেয়েরা, জিপিএ-৫-এ ছেলেরা : পাসের হারে এবারো মেয়েরা এগিয়ে। তবে মেধার সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ-৫ বেশি পেয়েছে ছেলেরা। ছেলেদের পাসের হার ৭৬ দশমিক ৭১ আর মেয়েদের ৭৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। ছাত্রদের তুলনায় ২ দশমিক ১৪ শতাংশ বেশি ছাত্রী পাস করেছে। মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৬২৯ শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে ছাত্র ৫৫ হাজার ৭০১, ছাত্রী ৫৪ হাজার ৯২৮। ১০ বোর্ডে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ২০ লাখ ২৬ হাজার ৫৭৪, পাস করেছে ১৫ লাখ ৭৬ হাজার ১০৪ জন। অংশগ্রহণকারী পরীক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্র ছিল ১০ লাখ ২২ হাজার ৩২০ জন। পাস করেছে ৭ লাখ ৮৪ হাজার ২৪৫ জন। ছাত্রী ছিল ১০ লাখ ৪ হাজার ২৫৪ জন। পাস করেছে ৭ লাখ ৯১ হাজার ৮৫৯ জন। অন্যদিকে মাদরাসা বোর্ডে পাসের হার ৭০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। ১ হাজার ৯৮৮ জন ছেলে ও ১ হাজার ৩৮৩ জন মেয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে। কারিগরি বোর্ডে পাসের হার ৭১ দশমিক ৯৬ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ হাজার ৯১৪ মেয়ে ও ২ হাজার ৪৯৯ জন ছেলে।

১৫৭৪ স্কুলে সবাই পাস, সবাই ফেল ১০৯ প্রতিষ্ঠানে : এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এবার শতভাগ শিক্ষার্থী পাসের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা গতবারের চেয়ে ৬৯২টি কমেছে। আর সবাই ফেল করেছে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে ১৬টি। এবার সারা দেশে ১ হাজার ৫৭৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শতভাগ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছে। গত বছর ২ হাজার ২৬৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছিল। আর ১০৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একজনও পাস করেনি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads