পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে জরুরিভাবে স্থায়ী পদ্ধতির দিকে যাওয়া উচিত। বর্তমান ব্যবস্থায় স্থায়ীভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা সম্ভব নয় বলে মনে করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত প্রশাসনিক তদন্ত কমিটির সুপারিশ না পাওয়ায় প্রশ্ন ফাঁসরোধে স্থায়ী কোনো ব্যবস্থার দিকে যেতে পারছে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, সাময়িকভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে আমরা সফল হলেও এটি স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা নয়। তাই জরুরিভাবে স্থায়ী পদ্ধতির দিকে যাওয়া উচিত। হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত প্রশাসনিক তদন্ত কমিটির কাছে এ বিষয়ে সার্বিকভাবে একটি সুপারিশ আমাদের জানাতে বলা হয়েছিল। আমাদের জানানো হয়নি। ফলে আমরা স্থায়ী পদ্ধতির দিকে যেতে পারছি না।
হাইকোর্টের নির্দেশে প্রশ্নপত্র ফাঁস তদন্তে গঠিত প্রশাসনিক কমিটির সদস্য বুয়েটের অধ্যাপক সোহেল রহমান বলেন, যথাসময়ে আমরা আদালতে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব তদন্ত কমিটিতে সদস্য ছিলেন। মন্ত্রণালয় তার কাছ থেকে প্রতিবেদন পেতে পারে। তিনি বলেন, তদন্ত করার সময় যা চেখে পড়েছে তাতে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার সুযোগ রয়েছে বিভিন্ন ধাপে। বর্তমান ব্যবস্থায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঝুঁকি থেকে রক্ষা পেতে হলে বিজি প্রেসের সক্ষমতা বাড়ানোসহ গোপনীয়তার নিরাপত্তা আরো বাড়াতে হবে। প্রশ্নপত্র ছাপার সঙ্গে যুক্ত ১৫০ লোকবল না রেখে লোকবল কমাতে হবে। বিজি প্রেসের প্রতিটি কোনায় উন্নত সিসি ক্যামেরা বসাতে হবে। বহুনির্বাচনী প্রশ্নপত্রের একাধিক সেট ছাপাতে হবে। বর্তমান ব্যবস্থায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঝুঁকি এড়াতে একাধিক বহুনির্বাচনী পরীক্ষার প্রশ্নপত্র একাধিক সেটে ছাপানোর সুপারিশ করেছি। প্রয়োজনে বহুনির্বাচনী পরীক্ষা বন্ধ করার সুপারিশও করেছি। তবে আধুনিক যুগে বহুনির্বাচনী পরীক্ষা বাদ না দেওয়াই ভালো। স্থায়ী ব্যবস্থার দিকে যাওয়া উচিত। সেই সুপারিশও করেছি।
বর্তমান ব্যবস্থার দুর্বলতা তুলে ধরে সোহেল রহমান বলেন, বিজি প্রেসে গোপন শাখার ইনচার্জ (দায়িত্বশীল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা) নন, এমন ব্যক্তি দায়িত্ব পালন করেন। সেখানে একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নিয়োগ করতে হবে। আসলে কার কী দায়িত্ব, তা ঠিক করা দরকার। পুলিশ আমাদের তল্লাশি করেছে (আগে ছিল না)। কিন্তু গুগল গ্লাস পরে ঢুকলে বুঝতেও পারত না। আমরা ভেতরে ঢুকে দেখলাম প্রশ্ন ছাপা হচ্ছে, আমরা অনেকখানি প্রশ্ন দেখতেও পেয়েছে। সেখানে জায়গা কম, প্রশ্ন ছাপার পর স্তরে স্তরে সাজানো আছে প্যাকেট হওয়ার অপেক্ষায়, সেখানেও খানিকটা দেখা যাচ্ছে। গুগল গ্লাস নিয়ে গেলে দেখতে পারতাম। সিসি ক্যামেরায় সব জায়গা কাভার করে না।
কয়েক বছর ধরে পাবলিক পরীক্ষা শুরুর আগেই প্রশ্নফাঁস হওয়ায় বিব্রত পরিস্থিতিতে পড়ে সরকার। শিক্ষা মন্ত্রণালয় নানা উদ্যোগ নিলেও ব্যর্থ হয়। প্রশ্ন ফাঁসকারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটায়। এ পরিস্থিতিতে সরকার কঠোর অবস্থান নেয়। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও ছাপার কাজে সতর্ক ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সরাসরি সম্পৃক্ত করা, আইনি পদক্ষেপ নেওয়া, প্রশ্নপত্র পরিবহন ও প্যাকেটজাত করার ক্ষেত্রে নতুন পদক্ষেপ, পরীক্ষার আধা ঘণ্টা আগে পরীক্ষার্থীকে হলে নিজ আসনে নেওয়াসহ সংশ্লিষ্ট সব সেক্টরকে কাজে লাগিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা হচ্ছে। তাতেও ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, এসব ক্ষেত্রে যেকোনো একটিতে সামান্য অব্যবস্থাপনা, অবহেলা বা কেউ অসৎ হতে চাইলেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে।
প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ১১ সদস্যের কমিটি গঠন করে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ ও বিটিআরসি প্রতিনিধি, আট সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, কারিগরি এবং মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের প্রতিনিধি রাখা হয় ওই কমিটিতে। অন্যদিকে ২০১৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বুয়েটের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদের নেতৃত্বে প্রশাসনিক কমিটি এবং ঢাকা জেলা ও দায়রা জজের নেতৃত্বে বিচারিক তদন্ত কমিটি গঠন করেন হাইকোর্ট। এসব কমিটি প্রশ্নফাঁস রোধে স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ এবং আপাতত প্রশ্নফাঁস রোধে বিভিন্ন সুপারিশ করে।
প্রশ্নফাঁস রোধে স্থায়ী ব্যবস্থার বিষয়ে বুয়েটের শিক্ষক অধ্যাপক সোহেল রহমান বলেন, ‘প্রযুক্তিগত তিন থেকে চারটি সুপারিশ আমরা করেছি। কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র ছাপানোর কথা বলেছি। ক্যামেরা রেডি কপি (মডারেটরদের নির্বাচিত কপি সরাসরি প্রেসে অবিকল ছাপানো) করবেন মডারেটররা সে সুপারিশ করেছি। প্রশ্ন তৈরি অবস্থায় প্রেসে গেলে ঝুঁকি কমে যাবে। অটোমেটিক প্রিন্টিং চালুর সুপারিশ করা হয়। এই প্রস্তাবটি দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রিন্টিং মেশিন কেনা দরকার। প্রশ্ন আনা-নেওয়ার জন্য স্মার্টবক্স রাখতে হবে। যেকোনো সময় ওপেন করলে তা কেন্দ্র থেকেই জানা যাবে। যেখানে ইন্টারনেট কানেকটিভিটি নেই সেখানে কেন্দ্র না রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। স্থায়ী ব্যবস্থা প্রসঙ্গে বিজি প্রেসের সক্ষমতা বাড়ানোসহ বিভিন্ন ধাপে পরিবর্তন আনার কথা জানিয়েছেন সোহেল রহমান।