• বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪২৯
প্রচলিত শিক্ষায় দক্ষ জনশক্তি পাওয়া যাচ্ছে না

লোগো বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস)

শিক্ষা

বিআইডিএসের আলোচনা

প্রচলিত শিক্ষায় দক্ষ জনশক্তি পাওয়া যাচ্ছে না

সবার জন্য সমান সুযোগ প্রয়োজন : রেহমান সোবহান

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ৩০ এপ্রিল ২০১৯

অর্থনীতির গতি ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার রসদ দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় নেই। উচ্চতর পর্যায়ে কর্মমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। তাই দীর্ঘমেয়াদে দেশের উন্নয়নে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হচ্ছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। এ অবস্থায় দেশ মধ্যম আয়ে গেলেও সবার সমান উন্নয়ন হবে না। সবার জন্য উন্নয়ন নিশ্চিত করতে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। এজন্য বাজারভিত্তিক উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এজন্য মানসম্মত শিক্ষক তৈরির পাশাপাশি শিক্ষাকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সমালোচনামূলক কথন অনুষ্ঠানের সমাপনী দিনে গতকাল সোমবার এসব কথা বলেন বক্তারা।

রাজধানীর একটি হোটেলে গতকাল দুই দিনের সম্মেলন শেষ হয়েছে। এর আগে রোববার সম্মেলনের উদ্বোধন করেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। গতকাল শেষ দিনে শিক্ষার মান নিয়ে আয়োজিত অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মঞ্জুর হোসেন। বক্তব্য দেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এসএম নুরুল ইসলাম, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর ড. সামসাদ মর্তুজা প্রমুখ। এ অধিবেশনে কোয়ালিটি অব এডুকেশন অ্যান্ড গ্র্যাজুয়েট আনএমপ্লয়মেন্ট শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মিনহাজ মাহমুদ। তিনি বলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪৬ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে যেতে হলে সার্বিক উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। ড. মহীউদ্দীন আলমগীরের এক গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, লক্ষ্য অর্জনে ২০২১ সাল থেকে ২০৩১ সালের মধ্যে বর্তমানের উৎপাদনশীলতা শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২ দশমিক ৩ শতাংশে নিয়ে যেতে হবে। এছাড়া ২০৩২ সাল থেকে ২০৪১ সালের মধ্যে সেটি আরো বাড়িয়ে ৩ দশমিক ৬ শতাংশে নিতে হবে।

তিনি বলেন, আগামী দিনে অর্থনীতিতে একটি পরিবর্তন আনতে হলে শ্রমশক্তিকে দক্ষ করে গড়ে তোলার মতো শিক্ষা দিতে হবে। মাধ্যমিক পর্যায়ে যেসব শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে তাদের মাত্র ২০ শতাংশ উচ্চশিক্ষায় যুক্ত হয়, যা মোট শিক্ষার্থীর ৫ দশমিক ১ শতাংশ। বাকি ৮০ শতাংশ  এই পর্যন্ত আসতে পারে না। ভারতে এই হার ৫ দশমিক ৮ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ১০ দশমিক ৯ শতাংশ, মালেয়শিয়ায় যা ১০ দশমিক ১ শতাংশ এবং ভিয়েতনামে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ।

তিনি আরও বলেন, প্রতিবেশী সব দেশের তুলনায় বাংলাদেশ উচ্চ শিক্ষায় অংশগ্রহণের হার কম। ২০১৫-১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ কর্মে নিয়োজিত আছেন। এছাড়া প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করাদের মধ্যে ২৫ দশমিক ৯ শতাংশ, মাধ্যমিক পাস করা ৩০ দশমিক ১ শতাংশ, উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা ৬ শতাংশ, উচ্চশিক্ষা শেষ করাদের মধ্যে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ এবং অন্যান্যদের মধ্যে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ কর্মে নিয়োজিত। উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যেই বেকারের সংখ্যা বেশি থাকছে।

সভাপতির বক্তব্যে ড. মঞ্জুর হোসেন বলেন, মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষার বিকল্প নেই। সে শিক্ষা হতে হবে সময় উপযোগী। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়ন করতে হলে এ বিষয়ে নজর দিতে হবে। দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন ও মানসম্মত শিক্ষা এসডিজির সবগুলো লক্ষ্যের সঙ্গেই সম্পৃক্ত। টেকসই মানবসম্পদ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, প্রাথমিক পর্যায় থেকে যেসব শিক্ষার্থী উঠে আসছে তারা উচ্চশিক্ষার যোগ্য নয়। তাদেরকে নিয়েই উচ্চশিক্ষা চালাতে হচ্ছে। শিক্ষার মান বাড়ানোর জন্য নীতিনির্ধারকরা দায়িত্বপালন করছেন না। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনৈতিকভাবেই শিক্ষকসহ প্রায় সব নিয়োগই দেওয়া হচ্ছে। কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সার্টিফিকেট বিক্রি করছে। উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হচ্ছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা।

ড. এসএম নুরুল ইসলাম সার্টিফিকেটধারীদের অর্জিত শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, সার্টিফিকেট নিয়ে এলেও তারা চাকরির ইন্টারভিউতে সফল হচ্ছে না। শিক্ষাব্যবস্থায় অর্থনৈতিক ও শিক্ষক নিয়োগসহ সব ধরনের নিয়োগে ব্যবস্থাপনার অভাব রয়েছে। তাছাড়া শিক্ষকদের জবাবদিহিতার অভাব, সিলেবাস সময়পোযোগী না করা, অবকাঠামো না করেই বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক বিভাগ খোলার কারণে শিক্ষার মান বাড়ছে না।

ড. সামসাদ মর্তুজা বলেন, দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বাস্তবতার সঙ্গে মিল নেই। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব চলছে, মোবাইল ফোন ব্যবহার বাড়ছে, অথচ তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষতা বাড়ছে না।

রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ২ হাজার ২৫৪টি কলেজ রয়েছে। এর বাইরে ১৭৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং অনেকগুলো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। মানসম্মত শিক্ষার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ শিক্ষক। মানসম্মত শিক্ষক না থাকায় শিক্ষিত বেকার তৈরি হচ্ছে।

বিআইডিএসের মহাপরিচালক কে এ এস মুর্শিদ অনুষ্ঠানে বলেন, উচ্চশিক্ষার আগে প্রাথমিক শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। মৌলিক ভিত্তি শক্তিশালী না হলে পরবর্তীতে সারাজীবন তাদের নিয়ে সংগ্রাম করতে হবে।

এদিকে ‘অর্থনীতির গণতান্ত্রিকীকরণ : লক্ষ্য, নীতি ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক পৃথক অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান  প্রফেসর রেহমান সোবহান। এ অধিবেশনে বক্তব্য দেন ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সিনিয়র রিসার্স ফেলো ড. মীর্জা এম হাসান, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ড. হামিদা হোসেন এবং গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক ড. কাজী আলী তাৈফিক।

এ অধিবেশনে রেহমান সোবহান বলেন, ব্যাংকঋণের সুদের হার বেশি। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ১২ শতাংশের বেশি সুদে ঋণ নিয়ে উন্নতি করা যায় না। পুনঃতফসিল করে খেলাপি ঋণ কমালে হবে না। ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা আনতে হবে। গণতান্ত্রিক অর্থনীতি না থাকায় বৈষম্য বাড়ছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

রেহমান সোবহান আরো বলেন, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা নিজেদের প্রয়োজনে এক হতে পারছে না। তাদের পক্ষে বলার কোনো লোক নেই। ফলে তাদের স্বার্থও রক্ষা হচ্ছে না। অন্যদিকে বড় ব্যবসায়ীরা সব সময় ঐক্যবদ্ধ থাকে। তাদের স্বার্থ দেখার পক্ষও রয়েছে অনেক। সবার জন্য সমান সুযোগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার তাগিদ দেন তিনি।

ড. কাজী আলী তৌফিক বলেন, আমাদের বন সম্পদের প্রধান অংশই সরকারিভাবে রয়েছে। এগুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনা জরুরি। তাছাড়া শহরায়ন, জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে প্রাকৃতিক মৎস্যসম্পদ কমে যাচ্ছে। বাড়ছে চাষের মাছ। তিনি বলেন, যে সম্পদই হোক না কেন যারা ব্যবহার করেন, ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব  তাদের হাতে থাকলেই ভালো হয়। প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় নীতিমালার সমস্যা, সুশাসনের অভাবসহ নানা সমস্যা রয়েছে। তিনি সমবায় ব্যবস্থার উপর জোর দেন।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, আমাদের দেশে ওষুধের দাম বাড়ছে। ২০০০ সাল পর্যন্ত ওষুধের যে দাম ছিল সেটি এখন ৩০০ গুণ বেড়েছে। সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকা ১১৭টি ওষুধের দাম বাড়েনি। দেশে বৈষম্য বাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে চিকিৎসা ব্যয়।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads