• শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জৈষ্ঠ ১৪২৯

আইন-আদালত

নুসরাতের ১৬ খুনির ফাঁসি

দ্রুত কার্যকর চায় দেশবাসী 

  • সৌরভ পাটোয়ারী, ফেনী
  • প্রকাশিত ২৫ অক্টোবর ২০১৯

ফেনীর সোনাগাজীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে হাত-পা বেঁধে পুড়িয়ে হত্যা মামলায় ১৬ আসামির সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া আসামিদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ২১ মিনিটে রায় ঘোষণা করেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মামুনুর রশিদ। রায় শুনে আসামিরা কান্নায় ভেঙে পড়ে।

এদিকে রায় ঘোষণার পর দেশের সবস্তরের জনগণ সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় মানুষ সন্তুষ্টির বহিঃপ্রকাশ ঘটান এবং সাজা দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানান।  ফেনীতে আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করেছে নুসরাতের স্বজন-সহপাঠী ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা। বৃহস্পতিবার দুপুরে শহরের ট্রাংক রোড চত্বরে মিষ্টি বিতরণ শেষে একটি আনন্দ মিছিল বের হয়। মিছিলটি শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা অল্প সময়ের মধ্যে রায় ঘোষণায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন এবং দ্রুত তা কার্যকরের দাবি জানান।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, এ হত্যার বিষয়টি মানুষের সামনে আনার জন্য সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ধন্যবাদ। সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল ডিগ্রি মাদরাসা ফেনী জেলার অন্যতম বড় বিদ্যাপীঠ। দুই হাজারের বেশি ছাত্রছাত্রী সেখানে পড়ছে। এলাকার শিক্ষা সম্প্রসারণে এ মাদরাসার আলোকোজ্জ্বল ভূমিকায় কালিমালিপ্তকারী এ ঘটনা বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছে।

নারীত্বের মর্যাদা রক্ষায় ভিকটিম নুসরাত জাহান রাফির তেজোদীপ্ত আত্মত্যাগ তাকে ইতোমধ্যে অমরত্ব দিয়েছে। এ অমরত্ব চিরকালের অনুপ্রেরণা। পাশাপাশি আসামিদের ঔদ্ধত্য কালান্তরে মানবতাকে লজ্জিত করবে নিশ্চয় বিধায় দৃষ্টান্তমূলক কঠোরতম শাস্তিই আসামিদের প্রাপ্য। বিচারক এদিন বেলা ১০টা ৫০ মিনিটের দিকে রায় পড়া শুরু করেন। ১৭২ পৃষ্ঠার রায়ের চুম্বক অংশ পাঠ করেন তিনি।

রায়ে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত আসামিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দণ্ডাদেশ কার্যকর করতে এবং জরিমানার অর্থ আদায় করে নুসরাতের বাবা-মাকে দিতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া রায়ে চারজন পুলিশের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মামলার অভিযোগপত্রে ফেনীর তৎকালীন পুলিশ সুপার এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার ও সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনসহ চার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে দ্রুত আসামিদের সাজা কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন নুসরাতের পরিবারের সদস্যরা। দ্রুত বিচার নিশ্চিত করায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান।

এর আগে বেলা পৌনে ১১টার দিকে প্রিজন ভ্যানে করে আসামিদের ফেনী জেলা কারাগার থেকে আদালতের হাজতখানায় আনা হয়। তাদের কাঠগড়ায় তোলার পর বিচারক রায় পড়া শুরু করেন। রায় শেষে আসামিদের জেলা কারাগারে ফেরত নিয়ে যাওয়া হয়। গত ৩০ সেপ্টেম্বর মামলার দুপক্ষের যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে বিচারক রায়ের এ দিন ধার্য করেন। হত্যাকাণ্ডের সাড়ে ছয় মাসের মধ্যে রায় হলো।

দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলো- সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদরাসার বরখাস্ত হওয়া অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা, সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি রুহুল আমিন, সোনাগাজী পৌরসভার কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম, মাদরাসার শিক্ষক আবদুল কাদের, প্রভাষক আফসার উদ্দিন, মাদরাসার ছাত্র নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ যোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, কামরুন নাহার মণি, উম্মে সুলতানা পপি ওরফে তুহিন, আবদুর রহিম শরিফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন মামুন, মোহাম্মদ শামীম ও মহিউদ্দিন শাকিল।

মামলায় বাদীপক্ষে ছিলেন বিচারিক আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর হাফেজ আহমেদ, অ্যাডভোকেট আকরামুজ্জামান ও অ্যাডভোকেট এম শাহজাহান সাজু। সাজু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এ রায়কে বলেছেন দৃষ্টান্তমূলক। ৬২ কার্যদিবস শুনানির পর রায় দেওয়া হয়েছে, যাকে তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন বলেছেন।

আসামিপক্ষে ছিলেন হাইকোর্টের আাাইনজীবী অ্যাডভোকেট ফারুক আহমেদ ও এনামুল হক, ফেনী আদালতের সিনিয়র আইনজীবী গিয়াস উদ্দিন নান্নু, কামরুল হাসান, নূরুল ইসলাম, ফরিদ উদ্দিন নয়ন ও মাহফুজুল হক, আহসান কবির বেঙ্গল, সিরাজুল হক মিন্টুসহ ২০ আইনজীবী। তারা বলেছেন, রায়ে তারা সন্তুষ্ট নন। রায়ের বিরুদ্ধে তারা উচ্চ আদালতে যাবেন। নিয়ম অনুযায়ী, রায়ের বিরুদ্ধে সাত কার্যদিবসের মধ্যে হাইকোর্টে আপিল করতে পারবেন তারা।

এ মামলা তদন্তের দায়িত্বে থাকা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআইয়ের প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, আমরা যেটা প্রত্যাশা করেছিলাম সেটাই হয়েছে। আমরা পেশাদারিত্বের সঙ্গে মেধা দিয়ে কাজ করেছি। প্রত্যেকের পরিবারে নুসরাত আছে, আমরা সে ভাবনা নিয়েই কাজ করেছি।

প্রসঙ্গত, সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী ছিলেন নুসরাত। তাকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে ওই মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী থানায় মামলা করেন। এরপর অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সিরাজ গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার পক্ষে নামে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তার মুক্তির দাবিতে মানববন্ধনেও সক্রিয় ছিল মাদরাসার কিছু শিক্ষার্থী। মামলা তুলে নিতে নুসরাতের পরিবারকে বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হয়।

এর মধ্যেই গত ৬ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে আলিম পর্যায়ের আরবি প্রথম পত্রের পরীক্ষা দিতে ওই মাদরাসার কেন্দ্রে যান নুসরাত। এ সময় তাকে পাশের বহুতল ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেওয়া হয়। এ ঘটনায় তার বড়ভাই বাদী হয়ে গত ৮ এপ্রিল সোনাগাজী মডেল থানায় আটজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো কয়েকজনকে আসামি করে হত্যাচেষ্টার মামলা করেন। ১০ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় সে। তার মৃত্যুর পর এটি হত্যা মামলায় পরিণত হয়।

নুসরাতকে যখন ঢাকা মেডিকেলে আনা হয়েছিল, তখনো তিনি বলছিলেন, প্রতিবাদ করে যাবেন। প্রতিবাদী এই তরুণীর জন্য প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল দেশের মানুষ। বিচারের দাবিতে কর্মসূচি পালিত হয় দেশজুড়ে। ৭ এপ্রিল নুসরাত ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসকদের কাছে জবানবন্দি দেন। সেখানেও তিনি অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে যান।

১০ এপ্রিল থানা থেকে মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (পিবিআই) কাছে হস্তান্তর করা হয়। ২৯ মে এ মামলার প্রধান আসামি অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাসহ ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে ৮০৮ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দাখিল করে পিবিআই। আসামির মধ্যে ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।

৩০ মে মামলাটি ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ১০ জুন আদালত মামলাটি আমলে নিলে শুনানি শুরু হয়। ২০ জুন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন বিচারিক আদালত। ২৭ ও ৩০ জুন মামলার বাদী নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানকে জেরার মধ্য দিয়ে বিচার কাজ শুরু হয়। ৯২ সাক্ষীর মধ্যে ৮৭ জন সাক্ষ্য দেন আদালতে। অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে প্রথম মামলায় নুসরাতের জবানবন্দি নেওয়ার ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ায় সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালে পৃথক মামলা হয়েছে।

এদিকে রায়কে ঘিরে বুধবার রাত থেকে নুসরাতদের বাড়িতে পাহারা জোরদার করা হয়। আগে থেকেই প্রহরায় থাকা তিন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে আরো ৯ সদস্যকে যুক্ত করা হয়। আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিত লোকজনও রেজিস্ট্রার খাতায় সই না করে ওই বাড়িতে ঢোকার অনুমতি পাচ্ছেন না। উল্লেখ্য, গত ৭ এপ্রিল থেকে বাড়িটিতে পুলিশ পাহারা বসানো হয়। এ ছাড়া বৃহস্পতিবার ভোর থেকে জেলা সদর ও সোনাগাজীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে পুলিশের নিরাপত্তাচৌকি বসানো হয়েছে। র্যাব সদস্যদের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশও টহল দেয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads