• বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪২৯

সাহিত্য

কিরণরেখার পত্রপুট

  • শহীদ ইকবাল
  • প্রকাশিত ১০ জানুয়ারি ২০২১

টেলিভিশন প্রথম দেখি আমরা নানার বাড়িতে। ঈদের দিনে। আকাশ ভরা ঈদ তখন আমাদের। রমণীমোহন দিন। অবাধ, অপার—উন্মুক্তের ছোঁয়া। কী যে সে সুখ, সকলের উষ্ণতায় বুঝে তা নেওয়া যায়। এ উষ্ণতা দিনভর স্বপ্ন ছড়ায়, মেঘের ভেলায় বেলা ফুরানোর হতাশার জোগান দেয়। দূরে দেখি, ওই বুঝি আজ দিন ফুরিয়ে এলো। বড় সড়কের তখন সব গাড়ি চলাচল বন্ধ। পাহাড়ের মতো উঁচু ধুলার রাস্তা সূর্যডোবা কমলা-শূন্যতায় ছড়ানো। সূর্যটা তখন আলাদা রঙের। ফুলের আভা সংকুচিত। চতুর্দিকে উৎকট ম-ম গন্ধ। হলুদ শর্ষে ক্ষেতে সার বাঁধা হিল্লোলের আশ্চর্য বাহারে মুখরিত। সেখানে এই টেলিভিশন— আমাদের এক পাড় উঠোনে ডাক দিয়ে যায়। আনন্দমেলার অনুষ্ঠান চলে। তার আগে জমে বসা চঞ্চল বুদ্ধির শিহরণ। কতো মানুষের মেলা ওই ছোট্ট ঝিরঝিরে আলোবাক্সটিকে ঘিরে। ফর্সা আকাশের নিচে নাতিশীতোষ্ণ হাওয়ায় তখন অনেক মানুষের ভিড়। আনন্দমেলার আসরে বড়বাড়ির মর্যাদা বেড়ে যায় আরো। এখানে বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা নাই, তাই রাতের অন্ধকার বিদূরিত করে ব্যাটারিতে চলে ওই আলোর বাক্স। জটলা পাকানো সঙ্গীদের নিয়ে গভীর অন্ধকার রাতে অনুষ্ঠানে জেঁকে বসা। এক মনোযোগে ওই বাক্সে তখন মুখ ডোবানো। না-ফেরা মনে না-জানা মোহে— কতো নিথর নিপাট দৃষ্টি— তাতে রাত গভীর হয়ে আসে। কুসুমের মাসে তখন এমন রাত বুঝি আর আসে নাই কখনো। আমাদের জোনাকি পাড়া পেরিয়ে, হাঁসডোবা পুকুরের ছায়া মাড়িয়ে, তখন অনেক রাতে ঘরে ফেরা। সেটা ঈদের বিষাদমাখা বিরহী রাত। এক বছর পর আবার আরেকটি ঈদের জন্য আমাদের ইরোটিক প্রতীক্ষা। তবে টেলিভিশন বাক্সটা সব্বার জীবন বদলে দিয়েছিল। এই বুঝি ছন্দোহারা অভিঘাত। প্রতিযোগিতার আর একটি রূপ। ক্রমশ একে একে ঘরে ঘরে ঊর্ধ্বাকাশে অ্যান্টিনার সংখ্যা বেড়ে যায়। ওটা সামাজিক সাম্মানিক মর্যাদা হয়ে দাঁড়ায়। টারজান আর মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীদের যুগ কারো জানালায়-দরজায়— কখনোবা ওসারার খুঁটিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একচোখে আটকে থাকে। ঝড়-বৃষ্টি কিংবা মেঘে ঢাকা তারার রাত্তিরেও আমরা বদ্ধ-বাক্সে ডুবে থাকি। আকাশের সূর্য আর মেঘের ছায়ায় সেই সুদূর প্রান্তে আমাদের অভিমানী চিত্ত হাওয়ায় পাল তুলে দেয়। ঘরটার পাশের এজমালি পুকুরটা, মাঝেমধ্যেই তাতে পানিসাপ সাঁতরিয়ে চলে; রাত্তিরে সে বড় পুকুরপাড়ের গাছের গুঁড়িতে ঝুইলে থাকে, কখনোবা উঠে আসে মসৃণ স্যাঁতসেঁতে উঠানে। আমরা টেলিভিশনের মুগ্ধতায় ওসবের তোয়াক্কা করি না। মর্যাদা-সম্মানের প্রশ্নও তুলি না। তবু আজ কৃতজ্ঞ হই, ওই লোহার শিকের পর-জানালা আর প্রতিবেশীর সেই উঠান-বারান্দার আবর্ত কিংবা ঘরের বিছানো মাদুরের কথা স্মরণ করে। কারণ, ওখানেই আমরা দেখি ওরা এগারোজন আর এক নদী রক্ত পেরিয়ে— ধরনের মুখর সুরবাঁধা গানগুলো। কৈশোর-কণিকায় কোষের স্তরে তখন জমে যায় মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর জয় কিংবা বিনিময় সিনেমায় বোবা মাসুমার গল্পসমূহ। আমরা গল্প বুঝি না, জীবন বুঝি; মানুষ বুঝি। সুখ-দুঃখ চিনতে থাকি। নিথর ক্রন্দনধ্বনি মাখানো সুর আর স্বরকে চিহ্নিত করতে থাকি। আমরা তখন লোরি হোমসের পক্ষ নিতে পারি নাই। আমরা মোহামেডানের জয় চেয়ে যাই। মনের মুদ্রায় তখন এসব অবচেতনার যুক্তিহীন স্মারক। বোবা মাসুমার স্বর আমরা চিরকাল বয়ে বেড়াই, অন্য কারো প্রেমিকার চোখের স্বপ্ন হয়ে। প্রণয়েরও রঙ আছে, সে রঙ পুব-আকাশে রঙধনুর চেয়েও উজ্জ্বলতর— সেটি কেমন করা আনন্দে গড়ে ওঠে। আমরা ভালোবেসেছিলাম, বিনিময়ের বোবা মাসুমাকে। পরে এক সত্যিকারের মাসুমাও আমাদের আত্মীয় হয়ে ওঠে। কিন্তু পর্দার মাসুমা আর অনেকরকম হয়ে অনেকদিনের চেনা মাসুমা ঠিক এক নয়। বায়োস্কোপের নায়িকারা তার জায়গা কোনোদিন পূরণ করতে পারে নাই। স্কুল মাঠটা আমাদের হাজার মাসুমার বোবা মনকে রঙিন করে রাখে। কখনোবা আনন্দে ভাসিয়ে দেয়। প্রান্তর ছুঁয়ে অনেক কামিনী আর বোবা শিউলি কতোবার আমাদের হাতছানি দিয়া ডাকে, বোবা মাসুমার মুখে ভাষা তবুও আমরা বুঝি নাই। বোবা প্রকৃতির মতো— কেউ তা জানে নাই। তবে স্কুলমাঠটা অনেক লোকে ভরে যায় একদিন। বিরাট উঁচুতে লালরঙে একটা মঞ্চ বানানো হয়েছিল। আমাদের মঞ্চের কাছে যাওয়ার খুব বাসনা জাগে। কিন্তু গমগম করা মানুষ ঠেলে আর সেদিকে যাওয়া হয় নাই। আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে হারিয়ে যাই।

বড় জোর তিন মিনিট সময় প্রেসিডেন্ট ছিলেন, জলপাই রঙা অনেক গাড়ির বহরে তিনি এসেছিলেন। বুঝি তার কালো সানগ্লাস ছিল। মাথায় মেলেটারি টুপি। শক্ত জবান আছিল। কড়া নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে তিনি এসেই দ্রুত চলে যান। খেই হারানো মঞ্চটায়— তিনি কখন এলেন বা গেলেন— একপ্রকার ‘নাই’ মনে হয়। আমাদের আর জায়গা খুঁজে পাওয়া হয়নি। বস্তুত কিছুই দেখা হয়নি। কয়েকদিন পর দল বেঁধে সেই বাতিল মঞ্চটা আমরা দেখতে গিয়েছিলাম। কী বড় আর উঁচু সে মঞ্চ— উপরে উঠলে মৃদুমন্দ হাওয়া বয়, কতোদূর চোখ যায়, এক ধরনের বাদশাহী আমেজ। হেডস্যারের রুমের সামনে অনেকদিন ওই পরিত্যক্ত মঞ্চটি বেহাল অবস্থায় শুষ্ক হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। এখানে দুটো ফুল ছিল আমাদের খুব প্রিয়, শিমুল আর কাঠগোলাপ। তারপর কড়ি ও কামিনী। আরো পরে একদিন কুয়াশাভোরে পাই নবফোঁটা গন্ধরাজ। ওটি লুকিয়ে ছিল ন্যাড়াগাছে। ফলে বহু ফুল আমাদের প্রিয় হয়। বুঝি ইউনিসেফের দেওয়া পোস্টারে নাকি নতুন আঠা গন্ধের ব্ল্যাকবোর্ডে পাখির নামও আমরা চিনে ফেলি। সবার আগে বুলবুলি। কারণ আমাদের সেজখালার নাম ছিল বুলবুলি। মা বলতেন বুলবুলি বু। তবে মাছরাঙা আর কাঠঠোকরাটা খুব সুন্দর আঁকা রঙিন ছবি। কোটাঘরের হাওয়ায় সেখানে পাখিরা আসতো, গান গেয়ে ফিরে যেত, আর আলোর ঘুলঘুলিতে শুধু এঘর-ওঘর করতো— আলোর নাচনের সঙ্গে। চেনা বুলবুলি বসেওনি কখনো কিন্তু পরে অধিক চেনা হয়ে যায়; এক নরসুন্দর আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। নাসারন্ধ্রে তার আলাদা বার্তা ছিল। সেই থেকে ওটা অনেক কিছুর মতো আলাদারকম প্রিয়। আরেকটি ফুল নয়নলোভন মনে হয়— ঠিক সাঁড়াশি যৌবনে, স্পন্দনের শিহরণ ছিল তাতে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য রাস্তার পাশে গুচ্ছ গুচ্ছ জারুলরঙা জারুলে— ওর তো তুলনা ছিল না কোনো কালে। কিন্তু কেন যেন প্রথম চেনা ফুল শিমুলেই আমরা বেশি মুখর থেকেছি— ওই মন-ধরা কুসুমগন্ধা যেন। বিজলী বাতি ছাড়া আমাদের ছোট্ট এলাকায় নীরবে সে বড় হতে থাকে। একুশের সকালে শ্রদ্ধা জানানোর একমাত্র ফুল ছিল ওটি। অসীম হাসি আর চোখমুখ ছিল আনন্দে ভরা। ভোরের আলো ফোটার আগেই ওর সব রঙ মনে গুচ্ছ গুচ্ছ হয়ে জুটে বসে। কুয়াশার শীত গভীরতর হলে টুপ করে তা পড়ে যায় পগারের গর্তে। ফুল কুড়ানোর আগেই তখন শহীদমিনার ভবিষ্যতের সংকেতে শোভাময় হয়ে ওঠে। একমাত্র বনেদি বাড়ির মানুষ সার্কেল অফিসার এসেন্সমাখা শাল পেঁচিয়ে শহীদ মিনারের বেদিতে উঠে ফুল দেন। আমরা অমনি করে চুপটি হয়ে যাই। গম্ভীর হলেও তিনি অনেকেরই প্রীতিভাজন ছিলেন। এমন শ্রেণিচরিত্রের আর কেউ তেমন ছিলেন না। থাকলেও তা চোখে পড়ে নাই। বায়ান্নর পরে কতো সময়, কতো শিমুলের ধারা— রাগ-অনুরাগে বর্ষিত হয়েছে, মানুষের মুখে-চোখে-আনন্দে বৃহৎ মানুষের মৃত্যুর অবান্তরতা সবকিছুই যেন ধুইয়ে দিয়েছে— এই শহীদমিনার। মৃত্যুর এক ‘বাস্তব’ ও সর্বোচ্চ ‘সত্য’ সেটি— কিন্তু সবটুকুই স্মৃতি বা মমতার ফানুসে মোড়ানো যেন। জীবন কি মৃত্যুর কাছে পরাস্ত হয়? জীবন বহমান— মহৎ— এক অর্থে তা কামিনীর টুপটাপ আওয়াজের সুরভিত ছায়াবাড়ি কিংবা তার অলক্ষ্য পুনর্জন্ম। তাই প্রস্তরীভূত আত্মারা হয়তো ফিরে আসেন, কোনো না কোনো স্বরূপে, কখনো কোনো আকারে— অবয়বে। এইসব ভাবনা দিয়েই গড়া— পরম শ্রদ্ধেয় আমাদের শহীদমিনার।

 

চলবে

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads