• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জৈষ্ঠ ১৪২৯
চামড়া নিয়ে যাচ্ছেতাই

কোরবানির পশুর চামড়া

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

গরিবের হক মেরে খেল সঙ্ঘবদ্ধ সিন্ডিকেট

চামড়া নিয়ে যাচ্ছেতাই

  • আলতাফ মাসুদ
  • প্রকাশিত ২৫ আগস্ট ২০১৮

কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে সিন্ডিকেট চক্র বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আড়ত মালিক, মৌসুমি ব্যবসায়ী ও ফড়িয়াদের ষড়যন্ত্রে এবার গত তিন দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন দরে কেনাবেচা হয়েছে এ পণ্যটি। একদিকে সিন্ডিকেট, অন্যদিকে চামড়া যাতে পাচার না হতে পারে, সেজন্য সীমান্তে বসানো হয়েছে কড়া পাহারা। এতে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে, ন্যায্যমূল্য পাওয়া তো দূরে থাক, অনুরোধ-অনুনয় করে নামমাত্র মূল্যে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছে চামড়া বিক্রি করতে হয়েছে। আর ছাগলের চামড়া তো কিনতেই চাননি ফড়িয়ারা। এতে চামড়ার মূল্যের প্রকৃত হকদার এতিম, মিসকিন ও গরিবরা ঠকেছেন।

ঢাকায় গরুর চামড়া গড়ে প্রায় ৫০০ টাকা দরে বিক্রি হলেও বিভিন্ন জেলায় পাওয়া গেছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা করে। আর খাসির চামড়া ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রেই বিনামূল্যে খাসির চামড়া দিয়ে দিতে হয়েছে। ঢাকার ওয়ারীতে খাসির চামড়া রাস্তায় ফেলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

বিশ্ববাজারে মূল্য কমে যাওয়ার অজুহাতে গত পাঁচ বছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে কাঁচা চামড়ার ক্রয়মূল্য। ২০১২ সালে প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার ক্রয়মূল্য ছিল ৯৫ থেকে ১০০ টাকা। ছয় বছরের ব্যবধানে এবার প্রতি বর্গফুটের দর দাঁড়িয়েছে সর্বোচ্চ ৫০ আর সর্বনিম্ন ৪৫ টাকায়। এ হিসেবে ছয় বছরে লবণযুক্ত গরুর চামড়া ৫০ শতাংশের বেশি দর হারিয়েছে। একই সময়ে খাসির চামড়ার দাম ৬০ টাকা থেকে নেমে এসেছে ১৫ টাকায়।

চলতি বছরের ১৫ আগস্টের শোক দিবস ও কোরবানি উপলক্ষে প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ পশুর চামড়া সংগ্রহ হতে পারে বলে ট্যানারি ও আড়তদার মালিকরা ধারণা করছেন। এর মধ্যে গরুর সংখ্যা ৬০ থেকে ৬৫ লাখ হতে পারে। সারা দেশের সব গরুর চামড়ার দাম গড়ে যদি ৫০০ টাকা করেও ধরা হয়, তাহলে ৬৫ লাখ গরুর চামড়ার মূল্য দাঁড়ায় ৩২৫ কোটি টাকা। যদিও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কাঁচা চামড়া, চামড়াজাত পণ্য ও জুতা থেকে বাংলাদেশের রফতানি আয় ছিল ৯ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। এ সময়ে চামড়া শিল্পের রফতানি আয়ের ১৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ আসে তৈরি ফিনিশড লেদার থেকে, যার পরিমাণ দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি।

ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, মাগুরায় প্রতিটি গরুর চামড়া প্রকার ভেদে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা এবং খাসির চামড়া ৫০ থেকে ৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর বকরির চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র ২০ টাকায়। রাজশাহী, নাটোর, খুলনা, কুড়িগ্রাম, নেত্রকোনা, জামালপুর, জয়পুরহাটসহ দেশের বিভিন্ন জেলার পরিস্থিতি প্রায় একই রকম।

ঢাকার মিরপুরের সোলেমান মোল্লা জানান, ৮০ হাজার টাকা দিয়ে কেনা গরুর চামড়া অনেক অনুরোধ করে ৬০০ টাকায় বিক্রি করেছেন। আট বছর আগে একই আকারের গরুর চামড়া আড়াই হাজারে বিক্রি করেন তিনি। চামড়া সিন্ডিকেটের কারণে গরিব মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। ঢাকার বাউনিয়ার মঞ্জুর হোসেন জানান, একটি গরু ও তিনটি খাসির চামড়ার দাম ২০০ টাকা দিতে চাওয়ায় তিনি সেগুলো দান করে দিয়েছেন।

আবার কোথাও মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও পড়েছেন লোকসানের মুখে। মোহাম্মপুরের নূরুল আমিন জানান, বড় গরুর চামড়ায় সামান্য লাভ হলেও ছোট ও মাঝারি গরুতে লোকসান দিতে হয়েছে। তিনি জানান, মাঝারি আকারের গরুর চামড়া গড়ে ৫০০ টাকায় কিনলেও আড়তদারদের কাছে তা ৪৫০ টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে।

রংপুরের আদর্শপাড়ার মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী আবদুল জলিল জানান, এবার এমন লোকসান হয়েছে যে, কখনো এই ব্যবসা করতে আর কেউ এগিয়ে আসবেন না। যারা কোরবানি দিয়েছেন, খারাপ চামড়া হলেও ৬০০ টাকার নিচে বিক্রি করতে রাজি হননি। অনুরোধ-মিনতি করে ৫০০ টাকায় কিনেছি। কিন্তু বিক্রি করতে গিয়ে ৪০০ টাকাও পাইনি। একই কথা বলেন হামিদ, সাজু রহিমসহ কয়েকজন। সর্বনিম্ন দামে চামড়া কেনার পরও দাম পাওয়া নিয়ে চরম হতাশায় রয়েছেন কুড়িগ্রামের মৌসুমি ব্যবসায়িরা।

মাদরাসাগুলোও চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়েছে। অভিযোগ উঠেছে, গরিবদের ঠকিয়ে ট্যানারি মালিকরা কম দরে চামড়া কিনে উচ্চ দরে রফতানি করছেন। বাংলাদেশের তুলনায় ভারতে চামড়ার দাম বেশি। ফলে পণ্যটি পাচার হয়ে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মো. শাহীন আহমেদ বলেন, মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন সিন্ডিকেট কিংবা অনেকে সংগঠনের নামে কম মূল্যে চামড়া কিনে নিচ্ছেন। কিন্তু আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছি এবং সে দরেই চামড়া কিনছি। আমরা একটি গরুর চামড়া গড়ে প্রায় এক হাজার টাকায় কিনছি। মূল্য কমে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি জানান, গত বছর হাজারীবাগ থেকে সাভারে চামড়া শিল্প স্থানান্তরের কারণে দাম কিছুটা কমিয়ে রাখতে বলেছিলাম। আর এবার আমেরিকা, চীনসহ বিভিন্ন দেশে নতুন শুল্কারোপের কারণে চামড়ার দাম কমাতে বাধ্য হয়েছি।

জানা যায়, ২০১৭ সালে ঢাকায় প্রতি বর্গফুট কাঁচা চামড়া সর্বোচ্চ ৫৫ টাকায় কেনেন ট্যানারি মালিকরা। এটি রফতানি উপযোগী ও জাহাজিকরণ করতে সবমিলিয়ে সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ মূল্য সংযোজন হয়। সব মিলিয়ে প্রতি বর্গফুট চামড়া রফতানিতে খরচ পড়ে ৯৭ টাকা ৬৮ পয়সা। আর প্রতি বর্গফুট রফতানি হয় ১৮৯ টাকায়। ফলে প্রতি বর্গফুটে ৯০ টাকার বেশি মুনাফা হয়। এবার চামড়ার দাম অনেক কমে যাওয়ায় মুনাফা আরো বেশি হবে।

চামড়া ব্যবসায়ীদের সুবিধার্থে কোরবানির সময় নামমাত্র সুদে সরকার বড় অঙ্কের ঋণ দিয়ে থাকে। এমনকি হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরের সময়ও ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি নামমাত্র মূল্যে জমি দেওয়া হয়েছে। রফতানিতে প্রণোদনাও দিচ্ছে সরকার। তার পরও কাঁচা চামড়ার কম মূল্য দিয়ে তারা গরিবদের ঠকাচ্ছেন।  

অবশ্য ট্যানারি শিল্প মালিকরা জানান, এ বছর আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচা চামড়ার দাম ৩৩ শতাংশ কমেছে। ফলে এবারো দাম কমানো হয়েছে।

কোরবানির মৌসুমে মাঠপর্যায়ে জবাই হওয়া প্রতিটি গরু থেকে গড়ে ২২ বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। ফলে সর্বোচ্চ দরে হলেও একটি গরুর চামড়া বিক্রি হয় ১ হাজার ১০০ টাকায়। এরপর সেটি বিভিন্ন হাত ঘুরে রফতানি হয় ৩ হাজার ৯৬০ টাকায়।

চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়ার বিল বা চামড়া রফতানি সংক্রান্ত ব্যাংকের এলসি রেট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মাসওয়ারি এলসি রেটে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি গরু ও মহিষের চামড়ার গড় রফতানি মূল্য পাওয়া গেছে ২.২৫ মার্কিন ডলার বা ১৮৯ টাকা (প্রতি ডলারে ৮৪ টাকা হিসাবে)।

বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রাস্ট ও ফিনিশড- দুই ধরনের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি হচ্ছে। গত বছর অক্টোবর থেকে চলতি বছর জুন পর্যন্ত সময়ে প্রতি বর্গফুট ক্রাস্ট চামড়ার দাম দেড় থেকে আড়াই ডলার ও ফিনিশড চামড়ার দাম মানভেদে পৌনে ৩ থেকে ৫ মার্কিন ডলার পর্যন্ত ওঠানামা করেছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) সভাপতি হাজী মো. টিপু সুলতান বলেন, বিশ্ববাজারে মূল্য কম ও অর্থসঙ্কটের কারণে এবার চামড়ার দাম পড়ে গেছে। ট্যানারি মালিকদের কাছে অনেক টাকা বকেয়া পড়ে আছে। তারা যদি সময়মতো টাকা দিতেন, তাহলে এ সঙ্কট হতো না। সারা দেশের ফড়িয়া ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কাঁচা চামড়া কিনে লবণ দিয়ে তা সংরক্ষণ করেছি। আগামী সপ্তাহ থেকে ট্যানারিগুলো চামড়া কিনবে। আশা করছি, সরকার নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করতে পারব।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিশ্বে চামড়া, চামড়াজাত পণ্য ও জুতার বাজার ছিল ২৪৪ বিলিয়ন ডলারের। এর মধ্যে চামড়া ২৭ বিলিয়ন, ফুটওয়্যার ১৩৬ বিলিয়ন ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি থেকে ৮১ বিলিয়ন ডলার আসে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ চামড়া থেকে মোট ১০৮ কোটি ৫৪ লাখ ডলার আয় করে, যা আগের বছর ছিল ১২৩ কোটি ৩৯ লাখ ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ফিনিশড চামড়া থেকে ১৮ দশমিক ৩ কোটি ডলার, চামড়াজাত পণ্য থেকে ৩৩ দশমিক ৬৮ কোটি ডলার ও জুতা রফতানি করে ৫৬ দশমিক ৫৬ কোটি ডলার আয় হয়।

বাংলাদেশের চামড়ার সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে হংকং। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে হংকংয়ে ১১ কোটি ১৮ লাখ ডলারের চামড়াজাত পণ্য রফতানি হয়। একই সময়ে  ৬ কোটি ৬৯ লাখ ডলারের ফিনিশড চামড়া রফতানি হয় ওই দেশে। পরের অবস্থানে রয়েছে চীন। সদ্য শেষ হওয়া অর্থবছরে ৬ কোটি ৪০ লাখ ডলারের ফিনিশড চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি হয় সেখানে। একই সময়ে আমেরিকায় ৫ কোটি ২৪ লাখ ডলার, জাপানে ৫ কোটি ৭৪ লাখ ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি হয়। এ ছাড়া ইতালি, স্পেন, বেলজিয়াম, দক্ষিণ কোরিয়া ও নেদারল্যান্ডসে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে চামড়াজাত পণ্য রফতানি হয়। এর বাইরে ভারতে ৪৫ লাখ ডলারের ফিনিশড চামড়া রফতানি হয়েছে।

২০১৩-১৪ থেকে ২০১৬-১৭ সাল পর্যন্ত চামড়া শিল্পের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল গড়ে ১১ শতাংশ। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১২ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি ছিল। লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চামড়া শিল্পের রফতানি আয় কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ ছিল হাজারীবাগ থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে ট্যানারি স্থানান্তরের ঘটনা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads