• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জৈষ্ঠ ১৪২৯
অপরাধ বাড়ছে প্রবণতায়!

কাজী রিয়াজুল, ইজিজুর রহমান ও এহসান হাবীব

ছবি : বাংলাদেশের খবর

জাতীয়

‘মানুষকে মানুষ হতে হবে’

অপরাধ বাড়ছে প্রবণতায়!

  • সাইদ আরমান
  • প্রকাশিত ২৮ জানুয়ারি ২০১৯

উত্তরণ আর প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট করণীয় না থাকায় সমাজে বেড়েই চলেছে অপরাধের প্রবণতা। একটি অপরাধ এখন কেবল নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে থাকছে না। বিশ্বায়নের সুবাধে ছড়িয়ে পড়ছে এক দেশ থেকে অন্য দেশে। আমাদের দেশেও ঘটছে এই অপরাধের ধারাবাহিক পুনরাবৃত্তি। ফলে একই অপরাধ একই কায়দায় দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, তথ্যপ্রযুক্তি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এমনকি সংবাদমাধ্যমে অপরাধের তথ্য জেনে সমাজের মানুষের মধ্যে একই ধরনের অপরাধ করার আরেকটি খারাপ প্রবণতা বাড়ছে, যা সমাজের জন্য ভয়ঙ্কর। সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী ও সরকারের প্রতিনিধিরা বলছেন, একটি অপরাধ শুরু হলে সেটি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। দ্রুত সেটি সমাজের অন্যত্র ছড়িয়ে যায়। পরিস্থিতিটা এমন যে, ধর্ষণের খবর যেন ধর্ষণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। একবার কোথাও শিশু নির্যাতন শুরু হলে চারদিকে যেন বেড়ে যায় এমন পাশবিক কর্মকাণ্ড।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে সামাজিক অপরাধের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। অনেক কারণের একটি, অপরাধ দেখে অপরাধে জড়িয়ে পড়া। এখনই যদি এ অবস্থা প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া না হয় তবে তা আরো ভয়ঙ্কর হবে।

সংবাদমাধ্যমে প্রতিদিন দুঃখজনক সব খবর আসছে। সন্তানের হাতে বাবা খুন, বাবা কিংবা মায়ের হাতে সন্তান, স্বামীর হাতে স্ত্রী, স্ত্রীর হাতে স্বামী, সহকর্মীকে খুন করছেন আরেক সহকর্মী, বন্ধুকে হত্যা করছেন বন্ধু অথবা ভাইয়ের হাতে ভাই। আর এক অপরাধ যেন একই ধরনের আরেক অপরাধ তৈরি করছে। 

জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বাংলাদেশের খবরকে বলেন, আমাদের মধ্যে একটি সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছেই। সমাজে সংঘটিত একটি অপরাধ দেখে আরেকজন একই অপরাধে সম্পৃক্ত হচ্ছে। ঘরে কিংবা বাইরে তারা একই অপরাধ করে যাচ্ছে। এটি হচ্ছে মূল্যবোধের অবক্ষয় থেকে।

তা ছাড়া একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে তারা ঘরে কিংবা বাইরে অপরাধ করে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করে সফল হচ্ছে। তারা অপরাধ করে প্রভাব খাটিয়ে বিচার প্রভাবিত করে। এটি যেকোনো মূল্যে বন্ধ করতে হবে। অপরাধ যেখানেই হোক জড়িত অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সেটি করা গেলে অপরাধী ভয় পাবে।

দীর্ঘদিন ধরে মানবাধিকার ইস্যু নিয়ে কাজ করা এই চেয়ারম্যান আরো বলেন, আইন প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সামাজিক আন্দোলন শুরু করতে হবে। পরিবার থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব জায়গায় নৈতিক শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সামাজিকভাবে অপরাধীকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব বলছে, বিদায়ী বছরে সারা দেশে ৭৩২ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৬৩ নারীকে। ধর্ষণের চেষ্টায় আক্রান্ত হয়েছেন আরো ১৩০ নারী। শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে ৫২১ জন। আর সহিংসতার শিকার হয়েছে ১ হাজার ১১ জন শিশু।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আজিজুর রহমান এই প্রতিবেদককে বলেন, অপরাধপ্রবণতার এই খারাপ পরিস্থিতি সামাল দিতে পারিবারিক বন্ধন জোরদার করতে হবে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বোঝাপড়া ও আলাপ-আলোচনা বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, আমরা অন্ধকারের দিকে যাচ্ছি। সহিংসতা থেকে আমাদের নারী ও শিশুরাও রক্ষা পাচ্ছে না। এর কারণ দুটি। এক, আইনের শাসনে ঘাটতি। দ্বিতীয়ত, বিচারহীনতা। মানুষ এখন অপরাধ দেখলেও প্রতিবাদ করেন না। পাশে দাঁড়ান না। কী ভয়ঙ্কর কথা। শহর থেকে গ্রাম সব স্তরে একই চিত্র।

এই মনোবিজ্ঞানী বলছেন, মানুষকে মানুষ হতে হবে। তার মধ্যে যে মাননিক গুণ থাকতে হয় সেটি প্রয়োগ জানতে হবে। সমাজের যেকোনো স্তরে অপরাধ হোক তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। 

অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহ এহসান হাবীব টেলিফোনে বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সমাজে পরিবর্তন এসেছে। ফলে অপরাধের ধরনে পরিবর্তন এসেছে। আমরা বিশ্বায়ন থেকে দূরে নই। ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো, সংবাদমাধ্যম আমাদের সব কাছে এনে দিচ্ছে। ফলে একটি অপরাধ একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে না থেকে ছড়িয়ে পড়ছে। সংঘটিত অপরাধ বিভিন্নভাবে জেনে আরেকজন একই অপরাধ করছে।

এই সমাজবিজ্ঞানী বলছেন, আমরা অর্থনীতিতে অনেক এগিয়েছি। তবে মানসিক স্বাস্থ্যের দিক থেকে আমরা এখনো পিছিয়ে। এখানে নজর দিতে হবে। বিনোদন নেই। পরিবারকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকায় আসতে হবে। আমাদের সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই সন্তানকে নৈতিক শিক্ষা এবং সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কে শিক্ষা দিতে হবে। প্রতিটি নাগরিককে ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারিবারিক ও সামাজিক নৃশংসতার বিষয়টি দিন দিন বাড়ছে। এর কারণ আমাদের পারিবারিক বন্ধন ও নৈতিক শিক্ষা দুর্বল হচ্ছে। তথ্য প্রযুুক্তির এই সময়ে এসে পরিবারের সদস্যরা আগের মতো আর কাছাকাছি নেই। দিন শেষে সবাই ঘরে ফিরলেও সবাই নিজের মতো ব্যস্ত থাকেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, টুইটার ও ইউটিউবে ব্যস্ত থাকেন সবাই। রেওয়াজ মোতাবেক খাবার টেবিলেও এখন সবার দেখা মিলে না।

তারা বলছেন, দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে এসব অপরাধ প্রকাশের ঘটনায় নতুন অপরাধ সৃষ্টিতে অনেক সময় উৎসাহ জুগিয়ে থাকে। সংবাদমাধ্যমগুলোর এক ধরনের প্রতিযোগিতা থাকে অপরাধের খবর প্রকাশের। দেশের বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যমে অপরাধ-বিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ নীতিমালা নেই। গত বছরের ২৫ নভেম্বর এক উপজাতি প্রতিবন্ধী নারী ধর্ষণের শিকার হন। বান্দরবানের আলীকদম উপজেলাতে এই ঘটনা ঘটে। বিষয়টি এক দিকে বিবেককে নাড়া দিলেও অন্য দিকে অপরাধ উসকে দিয়েছে।

সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, পরিবারের ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা একত্রিত হয়ে পারিবারিক হত্যাকাণ্ড ও অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। তবে এর পেছনে বড় কারণ ওই অর্থে বলা কঠিন। হতাশা পরকীয়া, আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কমে যাওয়া, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ইত্যাদি ও  থেকে পারিবারিক সহিংসতা বাড়ছে। নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাবে পারিবারিক বন্ধন ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই অপরাধ এখন সমাজে ব্যাধি হিসেবে ছড়িয়ে পড়ছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads