• রবিবার, ৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪২৯
রানা প্লাজার দুঃসহ স্মৃতি তাড়া করত হিমুকে

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

রানা প্লাজার দুঃসহ স্মৃতি তাড়া করত হিমুকে

  • সাভার প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ২৭ এপ্রিল ২০১৯

রানা প্লাজা ধসের পর নিজের হাতে অনেকের হাত-পা কেটে তাদের উদ্ধার করেছিলেন স্বেচ্ছাসেবক নওশাদ হাসান হিমু ওরফে হিমু হিমালয়। ঘটনার শুরুর দিন থেকে প্রায় পনেরো দিন পর্যন্ত দিনরাত ছিলেন সেখানেই। আটকে পড়া শ্রমিকদের করাত দিয়ে হাত-পা কেটে উদ্ধার করেছেন তিনি।

আহতদের সেবায় পরে আরো টানা ১৭ দিন কাটিয়েছেন বিভিন্ন হাসপাতালে। নিজের উদ্যোগেই সেবা-শুশ্রূষা করেছেন পঙ্গু রোগীদের। এরপর থেকেই চোখের সামনে ভয়াবহ সেসব স্মৃতি মানসপটে ভেসে আসত তার। রক্ত বা কাঁচা মাংস দেখতে পারতেন না।

রানা প্লাজার সেসব দুঃসহ স্মৃতি প্রতিদিন তাড়া করে বেড়াত তাকে। মাঝেমধ্যে অস্বাভাবিক আচরণও করতেন। নিজের জীবন আর দেশের আর্থসামাজিক অবস্থাও হতাশ করে তুলেছিল তাকে। তাই গত ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজার দুর্ঘটনার ষষ্ঠ বার্ষিকীতে নিজের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি।

সাভারের বিরুলিয়া শ্যামপুর গ্রামে দুই বন্ধু মিলে জীবনযাপন করা হিমু বুধবার রাত ১০টার দিকে বাসার সামনে নিজের শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। পরে তার চিৎকার শুনে আশপাশের লোকজন এগিয়ে গিয়ে আগুন নেভালেও ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ছাত্র ফেডারেশনের সাবেক এই সাংগঠনিক সম্পাদকের। পরে পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠায় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে। খবর পেয়ে স্বজন, বন্ধু ও রাজনৈতিক সহকর্মীরা ছুটে যান মর্গে।

নিহতের মা আফরোজা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, ২০১৩ সালে তারা ঢাকার শ্যামলী এলাকায় থাকতেন। রানা প্লাজা ভবন ধসের খবর পেয়ে আহত শ্রমিকদের রক্ত দেওয়ার জন্য হিমু তার মাকে সঙ্গে নিয়ে সাভারের রানা প্লাজায় যায়। তবে ভেতরে অনেক শ্রমিককে আটকে পড়তে দেখে অন্যদের সঙ্গে শুরু করে দেয় উদ্ধারকাজ। ভবন ধসের উদ্ধারকাজ সমাপ্ত হওয়ার দিন পর্যন্ত সে রানা প্লাজায় কাজ করেছে। এরপর সাভারের গণ্যস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রানা প্লাজার আহত শ্রমিকদের সেবা করে সময় কাটাত।

রানা প্লাজার হতাহত শ্রমিকদের পরিবারের সঙ্গেও তার গড়ে ওঠে সখ্য। অনেকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখত হিমু।

আফরোজা বেগম আরো বলন, রানা প্লাজার পর প্রায় সময়ই হিমু পরিবারের সবার সঙ্গে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়া জীবিত ও মৃত মানুষদের কীভাবে উদ্ধার করেছে এসব বিষয়ে বলত।

এছাড়া ওর ভেতরে যেকোনো বিষয় নিয়ে জানার আগ্রহ খুব বেশি ছিল। যেকোনো বিষয় তার মাথায় একবার এলেই সে বিষয় নিয়ে সে খুব বেশি চিন্তা করত।

হিমুর বড় বোন নওশিন আফরোজ হিয়া বলেন, ‘সে ছোটবেলা থেকে মানুষের বিপদ-আপদে পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করত। এসব করতে করতেই সে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আমি তাকে একাধিকবার কাউন্সেলিং করার জন্য চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছি। কিন্তু ও যেতে চায়নি। আমাদের আসলে জোর করে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। ডিপ্রেশন তাকে শেষ করে দিল।’

ছাত্র ফেডারেশনের পক্ষ থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতেও বলা হয়, ‘রানা প্লাজা ধস হলে ছাত্র ফেডারেশনের উদ্ধার টিমের সবচেয়ে সাহসী ও পরিশ্রমী কর্মী হিসেবে উদ্ধারকাজ করেছে হিমু। রানা প্লাজায় চাপা পড়া মানুষের হাত-পা করাত দিয়ে কেটে বের করার কাজের যে অসহনীয় অভিজ্ঞতা তা প্রায়ই তাকে ঘুমাতে দিত না। বিভিন্ন সময় সে বলত মানুষের রক্তাক্ত শরীরের কাটা টুকরোগুলো ঘুমের ভেতর হাজির হয়। এই দুঃসহ স্মৃতি প্রতিদিন পীড়া দিত, তাড়া করে বেড়াত।

রানা প্লাজার উদ্ধারকর্মী হিসেবে কাজ করার সময়ের সহযোগী এমএইচ শরীফ অঙ্ক বলেন, তারা ছাত্র ফেডারেশনের পক্ষে একসঙ্গে উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছিলেন। হিমু আটকে পড়া অনেক লোকজনকে উদ্ধার করেছে। রানা প্লাজার আটকে পড়া মানুষের বীভৎস মৃত্যু হিমু কাছ থেকে দেখেছে। এসব তার মনে অনেক বেশি দাগ কেটেছিল। রানা প্লাজা ছাড়াও তুবা গার্মেন্টে আগুন লাগার পর সেখানে গিয়ে শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানো ও প্রতিবাদে শামিল হয়েছিল সে। এর আগে গণজাগরণ মঞ্চেরও সক্রিয় কর্মী ছিল। সুন্দরবন মুভমেন্টেও ছিল। রানা প্লাজার শকড ও অন্যান্য হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল সে।

হিমুর আরেক সহযোগী উদ্ধারকর্মী ও রাজনৈতিক সহকর্মী এমএইচ রিয়াদ বলেন, ‘আমরা একসঙ্গে উদ্ধারকাজে ছিলাম। ও অনেক মানুষের হাত-পা কেটে উদ্ধার করেছে। এর পর থেকে ও রক্ত এবং কাঁচা মাংস দেখতে পারত না। মাস দুয়েক আগেও এক বন্ধুর বাসায় ও মুরগি কাটতে দেখে চিৎকার করে ওঠে। ও আসলে ট্রমাটাইজড হয়ে গিয়েছিল অনেক বেশি। এছাড়া ব্যক্তিগত ও সামাজিক অনেক কারণও রয়েছে ওর মৃত্যুর পেছনে।’

পরিবারের সদস্যরা বলছেন, বরিশালের এ কে স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে পটুয়াখালী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে হিমু। এরপর আইন বিভাগে আশা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু পড়াশোনা শেষ করতে পারেনি। কুকুর-বিড়ালসহ অন্যান্য প্রাণীর প্রতি অগাধ ভালোবাসা ছিল তার। কুকুরপ্রেমী ছিল বেশি। ডগ ট্রেইনার হিসেবেও কাজ করত। এজন্য চীনে পড়তে যাওয়ার প্রস্তুতিও নিয়েছিল।

হিমুর এমন অকালমৃত্যুর খবর শুনে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে শেষ বিদায় জানাতে উপস্থিত হয়েছিলেন ছাত্র ফেডারেশনের অনেক নেতাকর্মী।

গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান ও গণসংহতি আন্দোলনের রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য তাসলিমা আক্তার লিমা বলেন, ‘হিমু কিছুটা ট্রমাটাইজড হয়ে গিয়েছিল। ডিপ্রেশনে ভুগছিল। আমরা তাকে গণস্বাস্থ্যের কর্মশালায় নিয়ে গিয়েছিলাম। তাকে দিয়ে এসব বিষয় লিখিয়েছি, যেন তার ভেতরে এসব দুঃসহ স্মৃতিগুলো গুমোট হয়ে না থেকে বের হয়ে আসে। ওকে আমরা ইজি করতে অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু এসব নিয়ে ও অনেক বেশি ভাবত। দুঃসহ স্মৃতিগুলো বারবার ফিরে এসেছে তার কাছে।’

হিমুর আত্মাহুতির খবরে মর্গে ছুটে আসা গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘ওর সঙ্গে আমাদের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে পরিচয় হয়। পরে রানা প্লাজার ঘটনায় ছাত্র ফেডারেশনের ছেলেদের সঙ্গে একসঙ্গে উদ্ধারকাজে। আটকে পড়া শ্রমিকদের করাত দিয়ে হাত-পা কেটে উদ্ধার করেছে। পরে আরো টানা ১৭ দিন কাটিয়েছেন হাসপাতালে। নিজের উদ্যোগেই সেবা-শুরু করেছে পঙ্গু রোগীদের। এরপর থেকেই চোখের সামনে ভয়াবহ সেসব স্মৃতি মানসপটে ভেসে আসত তার। মানবসেবায় আত্মত্যাগের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সে, তা সবার জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads