• বৃহস্পতিবার, ৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪২৯
নিরাপদ খাদ্য : প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

নিরাপদ খাদ্য : প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ৩১ মে ২০১৯

খাদ্যে যখন ভেজাল আর বিষের ছড়াছড়ি, খাবারের প্রতি তখন মানুষের অবিশ্বাসের মাত্রা চরমে পৌঁছে যায়। কিন্তু বাঁচতে হবে খেয়েপরেই। খাদ্য নিয়ে মানুষ এখন আতঙ্কিত ও দিশেহারা। ভেজালমুক্ত খাবার আদৌ কি পাওয়া সম্ভব এমন সন্দেহ প্রতিনিয়ত ঘুরপাক খাচ্ছে মানুষের মনে। সৃষ্টির অমোঘ নিয়মে মানুষ সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য খায়। কিন্তু বাংলাদেশে খাবারে যেভাবে বিষ আর ভেজাল মেশানো হয়, তাতে মনে হয় মানুষ এখন ভেজাল খাওয়ার কারণেই মারা যাবে।

সম্প্রতি জাতীয় প্রেস ক্লাবে সাওল হার্ট সেন্টার আয়োজিত ‘নিরাপদ খাদ্যের স্বরূপ সন্ধানে’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের মানুষ দিনের পর দিন ভেজাল খাদ্য খেয়ে মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আর ভয়ঙ্কর সব মরণব্যাধির চিকিৎসা করাতে গিয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ দেশে অধিকাংশ খাদ্যদ্রব্য অনিরাপদ ও বিভিন্ন মাত্রায় ভেজালযুক্ত।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশে ভেজাল ও নিম্নমানের খাদ্যসামগ্রীর অবাধ ব্যবহারে বছরে দ্বিগুণহারে বিভিন্ন মরণব্যাধি বাড়ছে। এমন তথ্য জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। এরকম অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ২০২০ সালের মধ্যে দেশে মরণব্যাধি মহামারী আকার ধারণ করবে বলে তাদের আশঙ্কা। কিডনি, লিভার, শিশু, গাইনি ও ক্যানসার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, সময় থাকতে ভেজাল খাদ্যসামগ্রীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বড় ধরনের পদক্ষেপ এবং কঠোর আইন প্রয়োগ করা অনিবার্য হয়ে পড়েছে। কারণ বর্তমান সময়ে আমরা জেনে বুঝে ভেজাল খাবার খাচ্ছি। কেননা এই  ভেজাল  থেকে মুক্তির পথ আপাতত আমাদের নেই। অতিরিক্ত মুনাফার জন্যে আজ মানুষ ভেজাল ও অসদুপায়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। অথচ লক্ষ করলে দেখেবেন আমি আপনি এক জায়গায় ক্রেতা তো আরেক জায়গায় বিক্রেতা। আমরা এক জায়গায় ঠকছি আরেক জায়গায় ঠকাচ্ছি। লাভের লাভ বলতে যা হচ্ছে তা হলো আমাদের শরীরে রোগব্যাধি আর ভোগান্তি।

বিভিন্ন বিশ্লেষণ থেকে জানা গেছে, চলতি দশকে দেশের মানুষ নিরাপদ খাদ্য নিয়ে রীতিমতো আতঙ্কে ভুগছেন। এর মূলে রয়েছে প্রতিনিয়ত খাদ্যে ভেজাল ও অস্বাস্থ্যকর খাবারের সহজলভ্যতা। উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার হাতে আসা পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে খাবারের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য। এই ভয়াবহ প্রক্রিয়া প্রতিহত করতে  ভোক্তাদের তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন এবং সংঘবদ্ধ হতে হবে। সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সদিচ্ছাও এক্ষেত্রে অতি জরুরি।

এক তথ্যে জানা গেছে, বাজারে প্রচলিত পণ্য ও খাদ্যসামগ্রীর শতকরা ৯৬ ভাগই বিষাক্ত এবং খাবার অযোগ্য। তাহলে কী খেয়ে বেঁচে আছি আমরা! পত্রিকার খবরে জানতে পারি, প্রতি বছর দ্বিগুণ হারে হাবা-গোবা ও বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ ভেজাল খাদ্যসামগ্রী। গর্ভাবস্থায় বিষাক্ত খাদ্যসামগ্রী খাওয়ার কারণে মা ও তার পেটের সন্তানটি মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ৯৯ ভাগ। দেশে বছরে ২ লাখের অধিক লোক নতুন করে ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হচ্ছে (সূত্র : বারডেম)। ডায়াবেটিস রোগী ব্যাপক হারে বৃদ্ধির জন্য ভেজাল ও বিষাক্ত খাদ্যসামগ্রী অন্যতম কারণ বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অভিমত। কিডনি বিশেষজ্ঞদের মতে- ফরমালিনযুক্ত দুধ, মাছ, ফলমূল এবং বিষাক্ত রং মেশানো লাল আটা, চাল ও আলুসহ নানা ধরনের লোভনীয় ফাস্টফুড এ রোগের প্রধান উৎস।

ভেজালবিরোধী অভিযানের সংবাদে জানা গেছে, রাজধানীর খাবার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও নকল ওষুধ তৈরির কারখানায় অভিযান চালিয়ে সাধারণ খাদ্যদ্রব্য চাল, ডাল, আটা, মুড়ি থেকে শুরু করে শিশুখাদ্য গুঁড়ো দুধ, পাস্তুরিত তরল দুধ, দই, আইসক্রিম, চকোলেট, জুস, জেলি, কোল্ডড্রিংকস, মিষ্টি, ঘি, হোটেলের খাবার, ফলমূল, শাকসবজি, মাছ-মাংস, মুরগি, ওষুধ, জর্দা, খাবার ওরাল স্যালাইন, ভোজ্যতেল, বেকারির খাদ্যসামগ্রী ও বিদেশি কসমেটিকসহ শতাধিক রকমের পণ্যসামগ্রীতে ভেজাল খুঁজে পেয়েছেন।

জানা গেছে, ডাই ব্যবহার করার ফলে নুডলস ও বিস্কুট মচমচে থাকে এবং স্যাঁতসেঁতে হয় না। দেশের অধিকাংশ খামারে গরুকে খাওয়ানো হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া সার ও খাবার সোডা। এর ফলে গরু দ্রুত মোটাতাজা হলেও এর মাংস মানুষের শরীরে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা না দিলেও লিভার ও কিডনি ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে। পাবলিক হেলথ ইনস্টিটিউটের পরীক্ষকদের মতে, বিষাক্ত নকল ট্যাং ও চকোলেট খেলে শিশু বা বয়স্ক যে কোনো মানুষের দ্রুত কিডনি নষ্ট, ক্যানসার, লিভার ব্যাধি, দীর্ঘমেয়াদি পেটের পীড়া, ডায়রিয়া, শিশুদের হার্টের রোগ ও দৃষ্টিশক্তিও হ্রাস পেতে পারে। চায়নিজ রেস্টুরেন্টগুলোতে খাবারকে সুস্বাদু করতে মাত্রাতিরিক্ত টেস্টিং সল্ট ব্যবহার মানুষের শরীরের জন্য বিশেষ করে গর্ভবতী মহিলাদের ভয়ঙ্কর ক্ষতির কারণ। এ ধরনের খাদ্য গ্রহণে গর্ভজাত শিশু বিকলাঙ্গ এমনকি গর্ভপাতও হতে পারে।

বক্তারা বলেন, নীতি নির্ধারণ এবং আইন প্রয়োগের মাধ্যমে ভেজালের এই সামাজিক ব্যাধি রোধ করা সম্ভব নয়। এর জন্য সামাজিক আন্দোলনও প্রয়োজন, প্রয়োজন দায়বদ্ধতা। কারণ এ সংকট নিরসনে কেবল সরকারের প্রচেষ্টায় সম্ভব নয়। তাই সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ও ব্যক্তি উদ্যোগ আর সমন্বিত প্রচেষ্টায় সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। এজন্য প্রয়োজন সাজাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করা। ভোক্তা এবং উৎপাদক পর্যায়ে এই সচেতনতাকে ছড়িয়ে দিতে না পারলে খাদ্যে ভেজাল থামানো যাবে না বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা। কারণ অনেকে অসাবধানতাবশতও খাদ্যে ভেজাল মেশাচ্ছে। কেউবা অতি লোভের বশবর্তী হয়ে খাবারে ভেজাল করছে। এই সমস্যার সমাধান সম্ভব সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে। তাই সমন্বিত সামাজিক উদ্যোগের মাধ্যমে সমাজের সর্বস্তরে সচেতনতা সৃষ্টির পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এখনই।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ। সভায় প্রধান আলোচক ছিলেন কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম। বিশেষ আলোচক ছিলেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক মহাসচিব ডা. শরফুদ্দিন আহমেদ, বাপার সাধারণ সম্পাদক ডা. আবদুল মতিন, ড. সলিমুল্লাহ খান, অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ এবং বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান মুশতাক হাসান মো. ইফতেখার। আরো বক্তব্য রাখেন সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, সাবেক সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম মনি, ডাকসুর সাবেক জিএস ডা. মুশতাক হোসেন ও সমাজকর্মী খুশী কবির।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads