• বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জৈষ্ঠ ১৪২৯
চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে

সেবার নামে বাণিজ্য

  • রায়হান উল্লাহ
  • প্রকাশিত ০১ আগস্ট ২০১৯

আমেনা খাতুনের বয়স ৬০ বছর। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার নেয়াগাঁও গ্রামের বাসিন্দা তিনি। তিন মাস আগে তার পেটে ব্যথা হয়। দুই দফা চিকিৎসা হয় সরাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। পরে ভর্তি হন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে। তাতেও লাভ হয়নি। পরে চলে আসেন ঢাকায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমেনার চিকিৎসা হয় অনেকদিন। সঙ্গে ছিলেন স্বামী হাসেম আলী ও বড় ছেলে সিদ্দিক আলী। চিকিৎসা শেষে অনেকটা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন আমেনা। তার চিকিৎসায় ৪০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়েছে বলে জানান ছেলে সিদ্দিক। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে দুই কাঠা জমি ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে বলেও জানান সিদ্দিক। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে দরিদ্র পরিবারটি আরো দরিদ্র হয়ে পড়ে।

ওপরের চিত্রটি দেশে চিকিৎসা ব্যয় বাড়ার সুনির্দিষ্ট তথ্য না দিলেও ওই পরিবারটি দরিদ্র হওয়ার পেছনে চিকিৎসা ব্যয় ও দুর্নীতিই দায়ী। যদিও মাতৃ স্বাস্থ্য, শিশু স্বাস্থ্য, মোট প্রজনন হার-এসব ক্ষেত্রে দেশের অর্জন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রশংসা পেয়েছে, নানা স্বীকৃতিও মিলেছে।  

অন্যদিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে আওয়ামী লীগের দেওয়া ইশতেহারে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ও পরিকল্পনার মধ্যে স্বাস্থ্য ও পুষ্টিসেবার উন্নতি করার কথা বলা হয়েছে। তাতে এক বছরের কম বয়সী ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সী সব নাগরিককে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

এর মধ্যেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে নাগরিকদের জীবনযাত্রার ব্যয় ক্রমশ বাড়ছে। সমানতালে বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়। চিকিৎসকদের ইচ্ছামতো ফি-নির্ধারণ, অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধের দাম বৃদ্ধি এবং দালালদের অপতৎপরতা এর জন্য দায়ী বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীসহ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

এসব নিয়েই দেশের চিকিৎসক ও চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থাপনায় আস্থা উঠে যাচ্ছে নাগরিকদের। অনেকেই যেকোনো অসুস্থতায় চিকিৎসা নিতে দেশের বাইরে যাচ্ছেন। 

অবশ্য এমন প্রবণতাকে অনেকে খারাপ চোখে দেখলেও এর পেছনে গ্রহণযোগ্য ও জোরাল যুক্তি দেখাচ্ছেন সেবাগ্রহীতারা। তাদের এন্তার অভিযোগও আছে—নামিদামি বেসরকারি হাসপাতালে গেলেই আগে ২০০ টাকায় রেজিস্ট্রেশন করতে হয়, চিকিৎসকরা ফি আদায় করেন ইচ্ছামতো। এ ছাড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ যেমন বেশি, তেমনি অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করতে হয় রোগীদের। হাসপাতালের বিভিন্ন সেবায় অতিরিক্ত খরচ তো আছেই। এসব কারণে অসুস্থতার পেছনেই খরচ হয়ে যাচ্ছে অনেক টাকা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চিকিৎসা খাতে একধরনের বিশৃঙ্খলা চলছে। এই বিশৃঙ্খলা রোধে নীতিমালা তৈরি করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সিপিআই প্রতিবেদন বলছে, দেশে চিকিৎসার খরচ প্রতি বছর বাড়ছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এসে এই খরচ বেড়েছে ২৭ শতাংশেরও বেশি। আর চিকিৎসা সেবার পেছনে মানুষের যে ব্যয়, তার ৬৪ শতাংশই খরচ করতে হয় পকেট থেকে, সরকার থেকে বহন করা হয় এই খরচের মাত্র ২৪ শতাংশ।

পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, ২০১৩-১৪ সালে যে পরিমাণ স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসা পেতে ১৬৪ টাকা ব্যয় করতে হতো, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে একই রকম সেবা পেতে ব্যয় করতে হয়েছে ১৮০ দশমিক ৭৭ টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সেই খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ১৯৯ দশমিক ৯৪ টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২০৬ দশমিক ৭০ টাকা। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ খরচ ছিল ২০৯ দশমিক ২৮ টাকা। অর্থাৎ পাঁচ বছরের ব্যবধানে একই চিকিৎসা পেতে খরচ বেড়েছে ৪৫ টাকা ২৮ পয়সা।

প্রতিবেদনে বিবিএস বলছে, শহরে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১৫৫ দশমিক ৮২ টাকায় যে চিকিৎসা সেবা পাওয়া যেত, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সেই একই সেবা পেতে ব্যয় করতে হতো ১৬৯ দশমিক ৮০ টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ওই সেবার পেছনে ব্যয় করতে হয় ১৮০ দশমিক ৯৩ টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৮৫ দশমিক ০৫ টাকা এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৮৮ দশমিক ৯৬ টাকা।

অন্যদিকে, গ্রামাঞ্চলে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১৬৮ দশমিক ৮৭ টাকায় যে চিকিৎসা সেবা পাওয়া যেত, সেই একই সেবা পেতে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ব্যয় করতে হয় ১৮৭ দশমিক ১৮ টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ওই সেবা পেতে ব্যয় করতে হতো ২১১ দশমিক ০৪ টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২১৯ দশমিক ৩৫ টাকা এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২২১ দশমিক ১৫ টাকা। সে হিসাবে শহরের তুলনায় গ্রামেই চিকিৎসার খরচ বেশি।

এদিকে গত ২৫ মে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বিকল্প বা ছায়া বাজেট প্রস্তাব করে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। সংগঠনটির সভাপতি ড. আবুল বারকাত বাজেট উপস্থাপনের সময় বলেন, পৃথিবীর বহু দেশের তুলনায় বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে রোগীর নিজস্ব অর্থ ব্যয় অনেক বেশি। এর পরিমাণ প্রায় ৬৪ শতাংশ, সরকার বহন করে প্রায় ২৪ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল অসংক্রামক রোগের বিস্তৃতি ও চিকিৎসায় ব্যক্তিগত ব্যয়ের উচ্চ হারের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৫০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে।

ছায়া বাজেট বক্তৃতায় ড. আবুল বারকাত আরো বলেন, স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বরাদ্দকে বিশ্ব উৎপাদনশীল বিনিয়োগের সঙ্গে তুলনা করছে। কিন্তু আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় আয়োজনেই এই খাতকে বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। সমাজের বিত্তশালী অংশ তো বটেই, মধ্যবিত্তরাও সুচিকিৎসার আশায় ছুটছেন দেশের বাইরে; নিদেনপক্ষে নামিদামি কোনো বেসরকারি হাসপাতালে। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বাস্থ্য সেবাদাতা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো স্বল্প বরাদ্দ, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, অবহেলা, অসদাচরণ ও জরাজীর্ণতার প্রতীক হয়ে আছে, যা দেশের দরিদ্র জনগণের জন্য মরণাঘাতের শামিল।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি মনে করছে, স্বাস্থ্য ব্যয়ের কারণে সমাজে বৈষম্যও বাড়তে পারে। তাই স্বাস্থ্য খাতে দারিদ্র্যের রোগ নির্ণায়ক উপখাতগুলোতে সরকারি বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন।

অর্থনীতি সমিতি বলছে, আগামীতে সরকার ও পরিবার-উভয় ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। তা না করতে পারলে দরিদ্ররা আরো দরিদ্র হবে, মধ্যবিত্তেরও অধোগতি হবে। ফলে সমাজে বৈষম্য বাড়বে।

অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওষুধের মূল্য বৃদ্ধি, অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বাণিজ্যিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে সেবা নেওয়ার প্রবণতা বাড়ার কারণে নিজস্ব স্বাস্থ্য ব্যয় বাড়ছে।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বলেন, চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে গিয়ে মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছে। অহেতুক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালে অস্বাভাবিক খরচের কারণে অসুস্থ হলে দরিদ্ররা আরো দরিদ্র হয়ে পড়ছে।

অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, কার্যকর স্যানিটেশনের অভাব, পুষ্টি সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণেই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। ফলে তারা, বিশেষ করে শিশুরা খুব সহজেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন অভিভাবকদের সবকিছু বাদ দিয়ে শিশুর চিকিৎসা করাতে হয়। সরকারি হাসপাতাল বা কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে সব ধরনের সেবা ঠিকমতো দেওয়া হলে হয়তো মানুষের পকেট থেকে এত টাকা খরচ হতো না। এ ক্ষেত্রে সরকারি স্বাস্থ্যসেবায় ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ জানান, বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতি বছর ৫০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, চিকিৎসার মতো, মানবিক স্পর্শকাতর ব্যাপারটিও রীতিমতো ব্যবসায় পরিণত হয়ে গেছে। বিশেষ করে বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতালে গরিব মানুষের কোনো জায়গা নেই বললেই চলে। আর সরকারি হাসপাতালেও সবাই চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে না। সব জায়গায় এখন টাকা দিয়ে চিকিৎসা সেবা কিনতে হয়। তিনি বলেন, এই বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। আমাদের চিকিৎসা ব্যয়কে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসা উচিত। পাশাপাশি সরকারি হাসপাতালগুলোতে মানুষের বিনামূল্যে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে।

সার্বিক বিষয়ে জনস্বাস্থ্যবিদ ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, স্বাস্থ্য খাতের সমস্যাগুলো পুরোনো ও বহুল আলোচিত। শুধু মুখের কথায় এসব সমস্যা দূর হবে না। প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে নজরদারি বাড়াতে হবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশের স্বাস্থ্য খাতে বাজেট ঘাটতি রয়েছে। এ জন্য সরকারি হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সেবা পায় না মানুষ। আর অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল সেবার নামে করছে বাণিজ্য। তাই মানুষের সঠিক স্বাস্থ্যসেবা  নিশ্চিত করতে সব অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে নীতিমালা তৈরি করতে হবে।

সামগ্রিক বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘ব্যক্তির ব্যয় কমানো, দুর্নীতি কমানো, সেবার মান বাড়ানোসহ বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন ও ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের স্বাস্থ্য খাতের লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জন করা। আমরা তা পারব।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads