• রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

আট বিভাগীয় শহরের চিত্র

রাতে অভুক্ত থাকে ১০ শতাংশ

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১

বাংলাদেশে যে হারে মানুষ দারিদ্র্যসীমা পেরিয়ে ওপরে ওঠে, ঠিক তার কাছাকাছি হারে নতুন করে দারিদ্র্যে নামছে। কর্মহীনের সংখ্যা বাড়ছে অনেক পরিবারে। কোনো কোনো পরিবারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তির আয় কমেছে, যদিও সরকার করোনা মহামারীতে বেকারত্ব, দারিদ্র্য, ক্ষুধা মোকাবিলায় ত্রাণ ও নগদ অর্থ সাহায্যের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, অনেকেই এই সাহায্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ফলে নগর-মহানগরীর গড় ১০ শতাংশ মানুষকে রাতে অভুক্ত থাকতে হচ্ছে। আর দারিদ্র্যঝুঁকিতে রয়েছে ৩১ শতাংশের বেশি শিশু।

বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (ডব্লিউএফপি) সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) নগর আর্থসামাজিক অবস্থার (গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত) সর্বশেষ জরিপে দেশের মহানগরগুলোতে নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের হাহাকারের এক চিত্র উঠে এসেছে। মানুষের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি তুলে আনতে আটটি বিভাগীয় শহরের ৮৬টি নমুনা এলাকায় জরিপটি পরিচালনা করে পরিসংখ্যান ব্যুরো। এসব এলাকায় ২ হাজার ১৫০টি পরিবারের (নগরাঞ্চলের খানা) তথ্য সংগ্রহ করা হয় জরিপের আওতায়। তাতে নগরে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য, সঞ্চয় ও ঋণ পরিস্থিতি, নাগরিক সুযোগ-সুবিধা, পানি ও পয়ঃব্যবস্থাপনা ও স্বাস্থ্যবিধি, খাদ্য নিরাপত্তা, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি, অভ্যন্তরীণ স্থানান্তর প্রভৃতি বিষয়ের চিত্র উঠে এসেছে।

বিবিএস-এর জরিপ সূত্র জানায়, করোনাকালের আগেই (২০১৯ সাল) মহানগরগুলোতে ৮ দশমিক ২২ শতাংশ পরিবারের কোনো না কোনো সদস্যকে খাবার না থাকায় ক্ষুধার্ত অবস্থাতেই রাত কাটাতে হয়েছে। শুধু রাজধানী ঢাকায় রাতে অভুক্ত থাকা মানুষের সংখ্যা গড়ে ৯ দশমিক ২৩ শতাংশ। চট্টগ্রামে এর সংখ্যা প্রায় ১২ শতাংশ। আর ঢাকা-চট্টগ্রামের বাইরে গড় হার ১০ দশমিক ০৩ শতাংশ। এছাড়া সাড়ে ১১ শতাংশ পরিবারে মাঝে মধ্যে দিন-রাতে কোনো খাবারই ছিল না। আর মোটামুটি কিংবা তীব্র ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাত-দিন কাটিয়েছেন ৬ শতাংশের বেশি মানুষ। সার্বিকভাবে দেশের অন্য মহানগরগুলোর তুলনায় খাদ্যসংকটে ভুগতে থাকা পরিবারের সংখ্যা ঢাকা ও চট্টগ্রামে বেশি। 

মহানগরীগুলোতে গড়ে ১৬ শতাংশ মানুষ শুধু পেটে-ভাতে কাজ করেন। প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষ দৈনিক শ্রমে কাজ করেন। প্রতি তিনজনে একজন প্রতিনিয়ত দারিদ্র্যঝুঁকিতে থেকে দিন কাটান। বিষয়টি জরিপের আরেকটি সূচক থেকে প্রমাণিত, সেখানে দেখা যাচ্ছে যে মাত্র ৩২ দশমিক ৮৮ শতাংশ খানা সঞ্চয়ে সক্ষম। অর্থাৎ ৬৭ দশমিক ১২ শতাংশ খানা সঞ্চয়ে অক্ষম। তাই যে-কোনো মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে কিংবা সড়ক, স্বাস্থ্য, পেশাগত আঘাত ও অন্যান্য নিরাপত্তা দুর্ঘটনায় কাজ না থাকাই তার জন্য ক্ষুধা ও দারিদ্র্য তৈরি করছে দ্রুত।

বিবিএস জরিপ বলছে, এক শতাংশেরও কম দুগ্ধদানকারী মা মাতৃত্বকালীন ভাতা পেয়েছেন। মাত্র দুই শতাংশ খানার শহুরে বয়স্ক মানুষ বয়স্ক ভাতা সুবিধা পেয়েছেন। আর মাত্র এক শতাংশ শহুরে খানার কম দামে চাল কেনার ওএমএস কার্ড আছে।

মহানগরীগুলোর ২৫ দশমিক ৭ শতাংশ খানায় নিজস্ব রান্নাঘর নেই। এতে শ্রম ঘণ্টার অপচয় হয়। ৬০ দশমিক ৭ শতাংশ খানার মানুষ অন্য খানার সঙ্গে টয়লেট শেয়ার করেন বলে স্বাস্থ্যঝুঁকি ও ব্যয় বাড়ছে। মাত্র ৩৮ শতাংশ রোগী সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পান। বৈদ্যুতিক পাখা নেই ৮ দশমিক ৯ শতাংশ খানায়। এসবের ফলে উৎপাদনশীলতা কমছে।

৩১ দশমিক ৬৩ শতাংশ ছেলেমেয়ে (১২-১৮) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে থাকার কথা থাকলেও স্কুলে যায় না, প্রাথমিকের পরেই ঝরে পড়েছে। অর্থাৎ প্রতি তিনজনের মধ্যে প্রায় একজন নগর শিশু ভবিষ্যৎ দারিদ্র্য ঝুঁকিতে আছে। ভবিষ্যৎ আয়ের উৎস হিসেবে শিক্ষায় সময়, শ্রম, মেধা ও অর্থ বিনিয়োগ করে এদের দারিদ্র্য ফাঁদের ওপরে ওঠার সম্ভাবনাটা ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। সব মিলে নতুন দারিদ্র্য তৈরির চক্রাকার ফাঁদ বন্ধের পথ কঠিন হয়ে পড়েছে।

বিবিএসের জরিপে উঠে এসেছে, জরিপে অংশ নেওয়া নগরাঞ্চলের পরিবারগুলোর মধ্যে ২১ দশমিক ২৫ শতাংশ পরিবার বলছে, তাদের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য থাকবে কি না, সেটি নিয়ে তারা শঙ্কিত। আর ২০ দশমিক ৬৪ শতাংশ পরিবার বলছে, তারা পছন্দসই খাবার খেতে পারেন না। এর বাইরেও তিন বেলা খাবার খাওয়ার জন্য একেক বেলায় খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে ১৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ পরিবারকে। আর অপছন্দের খাবার খেতে হয়েছে ১৪ দশমিক ৯৬ শতাংশ পরিবারকে। প্রয়োজনের তুলনায় কম খেয়েছে ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ পরিবার। বিবিএসের জরিপ বলছে, পরিবারগুলো চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি মানিয়ে নেওয়ার জন্য খাবারের গুণগত মান কিংবা খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে।

জরিপে আরো বলা হয়েছে, সামান্য ক্ষুধার্ত বা ক্ষুধার্ত নয় এমন পরিবার ঢাকা ও চট্টগ্রামে ৯৩ দশমিক ০৫ শতাংশ। ঢাকা-চট্টগ্রামের বাইরে বাকি নগরগুলোতে এর পরিমাণ ৯৫ দশমিক ১০ শতাংশ। সার্বিকভাবে এই হার ৯৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ। মোটামুটি ক্ষুধার্ত পরিবারের হার ঢাকা-চট্টগ্রামে ৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ, ঢাকা-চট্টগ্রামের বাইরে ৪ দশমিক ২৬ শতাংশ এবং সার্বিকভাবে ৬ দশমিক ০৬ শতাংশ। আর তীব্র ক্ষুধার্ত পরিবার ঢাকা-চট্টগ্রামে শূন্য দশমিক ৩৪ শতাংশ, ঢাকা-চট্টগ্রামের বাইরে শূন্য দশমিক ৬৪ শতাংশ এবং সার্বিকভাবে শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ।

জরিপে ব্যাংক ঋণের চিত্র আরো ভয়ংকর। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর ২০ দশমিক ২২ শতাংশ মানুষ বিপদে-আপদে সাহায্যের জন্য হাত পাতে আত্মীয় ও প্রতিবেশীর কাছে। ৩ দশমিক ০৪ শতাংশ যায় অর্থ মহাজনের কাছে। দেশে গড়ে ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ ঋণ সাহায্যের জন্য এনজিও-নির্ভর। সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান মিলে ব্যক্তি ঋণের জোগান দেয় মাত্র ৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ। যেখানে দেশের মহানগরগুলোতে ৬৭ দশমিক ১২ শতাংশ খানা সঞ্চয়ে অক্ষম, সেখানে বাণিজ্যিক ব্যাংকিং সেবায় মোট ৭৫ দশমিক ২ শতাংশ মানুষের প্রবেশ নেই।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহানগরের পরিবারগুলোতে প্রতি মাসে জনপ্রতি ব্যয় চার হাজার ৪২ টাকা। অন্য নগরগুলোতে এর পরিমাণ তিন হাজার ৬৮৩ টাকা। সার্বিকভাবে সব নগর মিলিয়ে জনপ্রতি খরচ মাসে ৩ হাজার ৯৬৬ টাকা। এর মধ্যে সিংহভাগ ২ হাজার ২৭ টাকা খরচ হয় খাবারের পেছনে, যা মোট খরচের ৫১ দশমিক ১০ শতাংশ। এর বাইরে বাড়ি ভাড়ায় ব্যয় ২১ শতাংশ ও চিকিৎসায় ব্যয় ৫ শতাংশ। অন্যান্য শহরের তুলনায় ঢাকা ও চট্টগ্রামে বাড়ি ভাড়া দিতে হয় অনেক বেশি।

পেশার বিষয়ে বলা হয়েছে, নগরাঞ্চলে ঝুঁকি প্রবণতার মধ্যে থাকা পরিবারগুলোর পরিবারপ্রধানের পেশার মধ্যে বেতনভিত্তিক কাজ করেন ২৫ শতাংশ, ২০ শতাংশ ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। এছাড়া ১৮ শতাংশ আত্মকর্মসংস্থান ও ১৫ শতাংশ দিনমজুর হিসেবে নিয়োজিত। এছাড়া ১৬ শতাংশের বেশি পরিবার প্রধান কোনো ধরনের আয়ের সঙ্গে যুক্ত নন।

বিবিএসের এই জরিপে আটটি বিভাগীয় শহরকে জরিপ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে নিম্ন আয়ের অংশকে প্রাধিকার দিয়ে নগরাঞ্চলের খানা তথা পরিবার নির্বাচন করা হয়। উচ্চ, মধ্যম ও নিম্ন আয় এই তিনটি স্তরে নির্বাচন করা হয় নমুনা পরিবার।  

জরিপের বিষয়ে বিবিএস মহাপরিচালক মো. তাজুল ইসলাম বলেন, দেশের সিটি করপোরেশন এলাকাগুলো থেকে কম্পিউটার অ্যাসিস্টেড পারসোনাল ইন্টারভিউ (ক্যাপি) মোবাইল অ্যাপে ২০টি মডিউলে দীর্ঘ প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। জরিপে যে তথ্য পাওয়া গেছে, আমরা সেই তথ্যই প্রকাশ করেছি। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads