• রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

ডোপ টেস্টেও অধরা মাদকাসক্তরা

সরকারি প্রতিষ্ঠানে নেই প্রয়োজনীয় কোনো সরঞ্জাম

  • সালাহ উদ্দিন চৌধুরী
  • প্রকাশিত ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১

সরকারি চাকরিতে মাদকাসক্ত প্রবেশ বন্ধে কঠোর অবস্থানের পরও তাদের শনাক্তে সরকারি প্রতিষ্ঠানেই নেই প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। সীমাবদ্ধতার এই ফাঁক গলে মাদকাসক্তদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের আশঙ্কা রয়েছে। এমনটা হলে মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের নেওয়া উদ্যোগ ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সরকারি কর্মচারীদের কেউ মাদকাসক্ত সন্দেহ হলে তাকে দিতে হচ্ছে ডোপ টেস্ট। আবার সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানেই চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত প্রার্থীদের মুখোমুখি হয় ডোপ টেস্টের। কিন্তু দেশে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান-মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে (ডিএনসি) মাদক পরীক্ষার (ডোপ টেস্ট) জন্য নেই যথাযথ সরঞ্জাম। এতে অনেক মাদকাসক্তই ডোপ টেস্টে শনাক্ত হচ্ছে না।

গত বছর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক চিঠিতে দেশে বিপুল সংখ্যক মাদকাসক্তের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, দেশে বর্তমানে মাদকাসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছেন। বিভিন্ন পেশাজীবীদের মধ্যেও মাদক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। এতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হচ্ছে ও কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। ডোপ টেস্টের বিষয়টি বাধ্যতামূলক করলে যুবসমাজের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এরপর থেকেই প্রথমে সরকারি ও পরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠনেও ডোপ টেস্টের বিষয়ে আগ্রহের সৃষ্টি হয়।

ডিএনসি সূত্রে জানা যায়, মাদকাসক্ত নির্ণয়ের জন্য বর্তমানে এখানে শুধুমাত্র নন এসপেসিফিক বা কোয়ালিটিটিভ টেস্ট করা হচ্ছে। এই টেস্টের মাধ্যমে সর্বশেষ ৩ দিনের ভেতর কেউ মাদক গ্রহণ করলে তা শনাক্ত করা যায়। যা করা হয় ইউরিন বা মূত্র পরীক্ষার মাধ্যমে, স্ট্রিপ টেস্ট পদ্ধতিতে। ডোপ টেস্টের জন্য বর্তমানে ৫টি পরীক্ষা করা হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে এমফিটামিন (ইয়াবা শনাক্তের জন্য), কেনাবিনোয়েড (গাজা, ভাং ও মারিজুয়ানা), বেনজোডাইজিফাইন (সিডেটিভ জাতিয় নেশা), ওপিএট (হেরোইন, ফেনসিডিল ও মরফিন) এবং এলকোহল টেস্ট (মদ)। এজন্য নেওয়া হচ্ছে ৯’শ টাকা।

কিন্তু সংশ্লিষ্টদের মতে, চাকরিপ্রার্থী ব্যক্তি যদি পরীক্ষার জন্য স্যাম্পল দেওয়ার ৩ দিন আগে মাদক গ্রহণ না করে কিংবা ওই মাদকাসক্ত ৩ দিনের মধ্যে মাদক গ্রহণ করেও যদি প্রচুর পরিমাণ পানি বা ডাব পান করে তাহলে কোয়ালিটিটিভ ডোপ টেস্টের ফলাফল নেগেটিভ আসবে। নাম না প্রকাশের শর্তে ডিএনসির কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারের একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ জানান, প্রকৃত মাদকাসক্ত চিহ্নিত করতে কোয়ানটিটিভ টেস্ট করা প্রয়োজন। যা মুখের লালা, চুল, রক্ত ও স্প্যাইনাল ফ্লুইড পরীক্ষার মাধ্যমে করা হয়। মুখের লালা পরীক্ষার মাধ্যমে শেষ ৭ দিন, রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে শেষ ২ মাস, চুল পরীক্ষার মাধ্যমে শেষ ১২ মাস বা এক বছর এবং স্প্যাইনাল ফ্লুইড পরীক্ষার মাধ্যমে গত ৫ বছরের মধ্যে কেউ মাদক গ্রহণ করলেও তা পরীক্ষায় ধরা পড়ে।

ডিএনসিতে বর্তমান কোয়ানটিটিভ টেস্টের কোনো ল্যাবরেটরি নেই। তবে এ জন্য সম্প্রতি ডিএনসির কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র থেকে ডোপ টেস্ট ল্যাবরেটরির জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি বরাদ্দের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়। এতে বলা হয়, মাদকাসক্ত শনাক্তের জন্য বর্তমানে শুধু স্টিপ টেস্টপদ্ধতিতে মূত্র পরীক্ষা করা হচ্ছে, যা কনফারমিটরি টেস্ট নয়। মাদকদ্রব্য আইন, ২০১৮ এর ধারা ২৪ (৪) বাস্তবায়নের জন্য জরুরিভিত্তিতে কমপক্ষে একটি অটোমেটিক ইউরিন এনালাইজার ক্রয় করা একান্ত প্রয়োজন। প্রায় আড়াই কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে এই মেশিনটির। অধিদপ্তরের যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি খাতের দুই কোটি ৭০ লাখ টাকা থেকে এই অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার জন্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে আবেদন জানানো হয়।

ডিএনসির কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারের সহকারী রাসায়নিক পরীক্ষক ও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ মো. শফিকুল ইসলাম সরকার বলেন, ডোপ টেস্ট পরীক্ষার পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতির অভাব আছে। তবে সরকারের সবোর্চ্চ মহল যেহেতু মাদকের বিষয়ে জিরো টলারেন্স তাই আশা করা যায়, এসব সমস্যারও দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে। এই ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, এখন শুধু সরকারি চাকুরি প্রত্যাশীদেরই নয় বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও কর্মী নিয়োগের পূর্বে ডোপ টেস্ট করাচ্ছে, যা খুবই ইতিবাচক।

জানা যায়, নতুন মাদকদ্রব্য আইন, ২০১৮ এর ডোপ টেস্ট বিধিমালায় বেশ কয়েকটি বিধান রাখা হয়েছে। এরমধ্যে সরকারি চাকুরিরতদের কাউকে মাদকাসক্ত বলে সন্দেহ হলে তাকেও দিতে হবে ডোপ টেস্ট। ফলাফল পজেটিভ হলে চিকিৎসা গ্রহণের সাথে সাথে পদাবনতি, ইনক্রিমেন্ট হ্রাস বা বন্ধসহ নানাবিধ বিভাগীয় শাস্তি পেতে হবে।

ডিএনসির চিফ কনসালটেন্ট অতিরিক্ত সচিব ইমামুল হোসেন বলেন, নতুন আইন বাস্তবায়িত হলে তা হবে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, এর ফলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে দেশের সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চাকরীজীবীদের মধ্যে আর কোনো মাদকাসক্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না।

ডিএনসি সূত্রে জানা যায়,গত বছর এখানে ৮৩৫ জনের ডোপ টেস ্বকরা হয়। এর মধ্যে মাত্র ৪ জনের ফলাফল পজেটিভ আসে। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে টেস্ট করা হয় ৮৫ জনের। যার মধ্যে করোই পজেটিভ ফলাফল পাওয়া যায়নি।

তবে পুলিশ বাহিনীতে ব্যাপক সংখ্য পুলিশ সদস্যদের ডোপ টেস্ট করা হয়েছে। এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে পুলিশ সদর দফর। পুলিশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত দুই বছরে  মাদক ব্যবসায় ও মাদক সেবনের অভিযোগে পুলিশের শতাধিক সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পুলিশ বাহিনীতে মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর প্রথম ছয় মাসেই ৬৮ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

রাজধানীর তেজগাঁও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে প্রায় প্রতিদিনই সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ চাকুরি প্রত্যাশীদের ডোপ টেস্টের তালিকা পাঠানো হচ্ছে বলে জানান এখানকার সিনিয়র মেডিকেল টেকনোলজিস্ট আব্দুর রাজ্জাক। তিনি জানান, সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ফায়ার সার্ভিস, পল্লী বিদ্যুৎ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, একটি গোয়েন্দা সংস্থা, ডেসকো, মিটফোর্ড হাসপাতাল ও একটি বেসরকারি ব্যাংকের নিয়োগে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের ডোপ টেস্টের তালিকা পাঠানো হয় ডিএনসিতে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads