• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

গতি নেই মানি লন্ডারিং তদন্তে

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১

বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অবৈধভাবে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকারের আইন যতই কঠোর হোক না কেন, বাস্তবে থেমে নেই মানি লন্ডারিং (অর্থ পাচার)। পাচারকারীরা নিত্যনতুন কৌশলও খুঁজে বের করছেন। অর্থপাচার ঠেকাতে সরকারি পাঁচটি সংস্থায় দক্ষ কর্মকর্তার সংখ্যা কম হওয়ায় আশানুরূপ গতি পাচ্ছে না মানি লন্ডারিং অনুসন্ধান ও মামলার তদন্ত কার্যক্রম।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচারের যেসব ঘটনা আদালতে আসছে, সেগুলো সিন্ধুতে বিন্দুর মতো। দুর্নীতি দমন কমিশন এবং ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, পাচার করা টাকা দিয়ে বিদেশে হয়তো বাড়ি ও সম্পদ কেনা বা ব্যবসায় বিনিয়োগ করা হচ্ছে। যার বেশিরভাগ ঘটনা কেউ জানেই না। ফলে এ খাতে অনুসন্ধান ও তদন্ত প্রক্রিয়া দ্রুত করা অনেকটাই জটিল। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার হয় বিভিন্নভাবে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ‘বাণিজ্য কারসাজি’। আরেকটি উপায় ‘হুন্ডি’। বাণিজ্য কারসাজির মাধ্যমে যখন কোনো পণ্য আমদানি করা হয়, তখন কম দামের পণ্যকে বেশি দাম দেখানো হয়, ফলে অতিরিক্ত অর্থ দেশের বাইরে চলে যায়। একইভাবে রপ্তানির ক্ষেত্রে বেশি দামের পণ্যকে কম দাম দেখিয়ে অতিরিক্ত অর্থ দেশে আনা হয় না। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানা গেছে, ২০১৯ সালে সেখানে ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ ৫ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। করোনার কারণে ২০২০ সালে ব্যাংকটি এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। তবে সেসব ব্যাংকে কারা টাকা রেখেছেন সে সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট তথ্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে নেই। 

গত বছরের শুরুর দিকে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি বলছে, ২০১৫ সালে বাণিজ্য কারসাজির মাধ্যমে প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ বিদেশে পাচার হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু সুইজারল্যান্ডেই নয়- সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার হয়। বিদেশে অর্থ পাচার হলে দেশের অর্থনীতির ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই অর্থ পাচার রোধ করতে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের সক্ষতা বাড়ানোর পরামর্শ তাদের। ২০১৫ সালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন সংশোধন করে গেজেট প্রকাশের পর থেকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-সহ ৫টি সংস্থা মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায়। অন্য ৪টি সংস্থা হলো- পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তার আগে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের মামলা তদন্তের দায়িত্ব শুধু দুদকের ছিল।

সূত্র জানায়, এনবিআর মানি লন্ডারিং মামলা তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর আলোচিত অনেক মামলা হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আপন জুয়েলার্সের ৫টি শোরুম থেকে ১৫ মণ ১৩ কেজি স্বর্ণ, ৭ হাজার ৩৬৯ পিস ডায়মন্ডখচিত অলংকার, ৬৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা এবং ১০০ মার্কিন ডলার জব্দের ঘটনা। ওসব ঘটনায় ৫টি মামলা হয়। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইনে মামলাগুলো করে।

এছাড়া ৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকার এলসি (ঋণপত্র) খুলে ১ হাজার ৪০ কোটি টাকার অবৈধ পণ্য আমদানির অপরাধে মেসার্স হেনান আনহুই অ্যাগ্রো এলসি ও অ্যাগেও বিডি অ্যান্ড জেপি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। শুল্ক গোয়েন্দা তদন্ত অধিদপ্তর ওই ঘটনাটিকে জালিয়াতির মাধ্যমে সবচেয়ে বড় শুল্ক ও মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তাছাড়া ৯১৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা বিদেশে পাচারের দায়ে ক্রিসেন্ট লেদার প্রোডাক্টস ও ক্রিসেন্ট ট্যানারিজ এবং রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরই ওই ৩টি মামলা করে।

সূত্র জানায়, মানি লন্ডারিং অপরাধে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৯০টি মামলা করা হয়েছে। তার মধ্যে ৫৭টি মামলার তদন্ত চলমান। এর বাইরে ৫টি মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হয়েছে। আরো ৫টি মামলার চার্জশিট দাখিলের কার্যক্রম চলছে। তাছাড়া অর্থ পাচার সংক্রান্ত একটি মামলা যৌথভাবে তদন্ত করছে সিআইডি, কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। আরো একটির তদন্ত কার্যক্রম যৌথভাবে চালাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সিআইডি, কাস্টমস গোয়েন্দা ও অধিদপ্তর। পাশাপাশি সিআইডি ও দুদকের হাতে ২১টি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে।

ইতোমধ্যে মানি লন্ডারিং অনুসন্ধান শেষে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৩টি পৃথক মামলা করার অনুমতি চাওয়া হয়েছে। আর বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগের ১৭টি ঘটনা মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধান চলছে। নতুন করে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কাছে আরো ৩টি পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য পাঠানো হয়েছে। তবে এ-সংক্রান্ত মামলার বিষয়ে হাইকোর্ট থেকে চলতি মাসের মধ্যে চার্জশিট দাখিলের জন্য সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, শুধু হিসাব-নিকাশের গরমিল পেলেই এনবিআর মুদ্রা পাচার বা মানি লন্ডারিং মামলা ঠুকে দিচ্ছে। কিন্তু ওই মামলা পরে মানি লন্ডারিং হিসাবে প্রমাণ করা যায় না। এমন পরিস্থিতিতে মানি লন্ডারিং মামলা করার সময় প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করাসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ের দিকে নজর দেয়ার জন্য এনবিআরের শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ।

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বলেন, টাকা পাচারের পুরো বিষয়টা যেহেতু কৌশলে অবৈধ পন্থায় হয়ে থাকে, সেজন্য সঠিক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া মুশকিল। প্রচলিত হচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো। আমদানির ক্ষেত্রে যেটা করা হয়, কোনো একটি পণ্যের দাম যত হওয়ার কথা তার চেয়ে বেশি দাম দেখিয়ে টাকা পাচার করে দেওয়া হয়। অর্থ পাচারের বিষয়গুলোর ওপর নজরদারির জন্য সরকারি সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আর যারা এ কাজে জড়িত তাদের কঠোর আইনের আওতায় আনতে হবে। নইলে কোনোভাবেই মানি লন্ডারিং নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

অর্থ পাচারের বিষয়গুলোর ওপর নজরদারির জন্য বাংলাদেশ সরকার ‘ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’ গঠন করেছে অনেক আগেই। এই ইউনিটের প্রধান আবু হেনা মো. রাজী হাসান জানান, আইন অনুযায়ী বিদেশে টাকা পাঠানো এতো সহজ নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রীতিমতো অসম্ভব। বাংলাদেশের বাইরে ভ্রমণের সময় একজন ব্যক্তি প্রতি বছর ১২ হাজার ডলার পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেন। এছাড়া এডুকেশন এবং ট্রিটমেন্টের জন্য শর্তসাপেক্ষে অর্থ নেওয়া যায়। তবে বিদেশে সম্পদ কেনার জন্য অর্থ নেওয়া নিষিদ্ধ। এরপরও যে মাধ্যমে মানি লন্ডারিং হচ্ছে সে মাধ্যমগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।  

অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুুুুুনিম জানান, মানি লন্ডারিং বিষয়ে অসংখ্য মামলা দীর্ঘদিন তদন্তাধীন আছে। ওসব মামলার চার্জশিট দ্রুত দেওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তাদের অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। তাছাড়া দক্ষতার অভাবে তদন্ত কর্মকর্তারা আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। সেজন্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের এ বিষয়ে আরো দক্ষ করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। বিশেষ করে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। 

দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে শুধু সন্ত্রাসে অর্থায়ন হয় না, বরং দেশের ক্যাপিটাল ফ্লাইংও হচ্ছে, যা দেশের অর্থনৈতিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। বিদ্যমান আইন অনুসারে মানি লন্ডারিং মামলা পরিচালনার একক দায়িত্ব দুদকের নেই। বর্তমানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), পুলিশের সিআইডি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ একাধিক সংস্থা মানি লন্ডারিং মামলা পরিচালনা করছে। দুদক কেবল ঘুষ ও দুর্নীতিসম্পৃক্ত মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধ তদন্তের ক্ষমতাপ্রাপ্ত। বাকি ২৬টি সম্পৃক্ত অপরাধ সংশ্লিষ্ট মানি লন্ডারিংয়ের তদন্ত অন্যান্য সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। যদিও এখন পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানের মঞ্জুরি কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করা হয়নি। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads