• রবিবার, ৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪২৯
ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে করোনা

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে করোনা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৮ মার্চ ২০২১

করোনায় প্রতিদিনই মৃত্যু ও শনাক্ত  বেড়েই চলেছে। সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতিতে আক্রান্তদের জন্য হাসপাতালের বেড সংকট দেখা দিয়েছে। সংকট রয়েছে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ)। রাজধানীর করোনা ডেডিকেটেড অন্যতম পাঁচ হাসপাতালে আইসিইউ ফাঁকা নেই। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় ৩৯ জনের মৃত্যু এবং নতুন করে শনাক্ত হয় ৩৬৭৪ জন-যা চলতি বছর সর্বোচ্চ। সব মিলিয়ে হাসপাতালগুলো রোগী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। 

শীত মৌসুমে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা করা হলেও সে সময়ে সংক্রমণের হার ও মৃত্যুর সংখ্যা খুবই কম ছিল। গত ৩ ফেব্রুয়ারি দৈনিক শনাক্তের হার ছিল দুই দশমিক ৯২ শতাংশ এবং ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল দুই দশমিক ৩৩ শতাংশ। শীতের শেষে আবার বাড়তে শুরু করেছে করোনা রোগীর হার। চলতি মাসের শুরু থেকেই দৈনিক শনাক্তের হার বাড়তে শুরু করে। ১ মার্চ থেকে শনাক্তের হার চারের ওপরে চলে যায়। মার্চের প্রথম সপ্তাহে সেটা তিন থেকে চারের ভেতরে থাকলেও ৭ মার্চের পর  বাড়তে থাকে এবং সেটা বেড়েই চলেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষায় শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ৯০ শতাংশ। নতুন মৃতদের মধ্যে ২৮ জনই রাজধানীর বাসিন্দা।

চিকিৎসকরা বলছেন, গত বছরে যেটা মে-জুন-জুলাইয়ের দিকে হয়েছিল সেটা এ বছরে হয়ে যাচ্ছে মার্চে। প্রথমেই সব সরকারি আইসিইউ বেড পূর্ণ হয়ে গেল। সাধারণ বেডও প্রায় পূর্ণ। অথচ কারো মাঝে একটু সতর্কতাও চোখে পড়ে না। করোনার এই ঊর্ধ্বগতির সংক্রমণ কতটা ভয়াবহ হতে যাচ্ছে সেটা বোঝা যায় সরকারি হাসপাতালগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালের বেড সংকট দেখলেও। তবে এই সংকট রাজধানী ঢাকার হাসপাতালগুলোতে। সারা দেশে সাধারণ শয্যা ও আইসিইউ এখনো তুলনামূলকভাবে ফাঁকা রয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীতে করোনা সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। যার কারণে এখানে তালিকাভুক্ত হাসপাতালের সাধারণ বেড ও আইসিইউ সংকট চলছে। এমনকি তালিকাভুক্ত হাসপাতালের বাইরের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও বেড সংকট দেখা দিয়েছে। বেডের অভাবে রোগীদের ফেরত দিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।

রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালের সহকারী সার্জন ডা. সৈয়দ অলী মোহাম্মদ বলেন, এ হাসপাতালের প্রায় সব ওয়ার্ডই রোগীতে ভর্তি। নতুন রোগী ভর্তি করানোই বেশ টাফ হয়ে যাচ্ছে, সামনে আরো হবে। আইসিইউতে বেড পাওয়া এখন সোনার হরিণ। প্রতিদিন ওয়ার্ড থেকে গড়ে পাঁচ থেকে ১০ জন রোগী আইসিইউর অপেক্ষায় থাকে।

তিনি আরো বলেন, গত মাসের প্রথম দিকে আমাদের পরিকল্পনা ছিল নন-কোভিড ওয়ার্ড চালু করা। তা আর হয়নি, এরপর  আমরা ১১ তলা কেবিন চালু করি। এরপর অবস্থা বেগতিক দেখে ১২ তলা কেবিন আর ৭ তলা ওয়ার্ড খুলে দিয়েছি। এখন অধিকাংশ ওয়ার্ডই পরিপূর্ণ। কোনো বেড ফাঁকা নাই। হাসপাতাল এখন বেড বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে।

বিভিন্ন জেলার রোগীরা রাজধানী ঢাকায় চলে আসায় করোনা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে বলে জানান জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল। বলেন, কেউ বুঝতেই চাচ্ছে না-পরিস্থিতি কতোটা ভয়ঙ্কর হয়ে গেছে এবং ভবিষ্যতে আরো হতে যাচ্ছে। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও মহামারী বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, শুরু থেকেই রাজধানী ঢাকাতে করোনা আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যু বেশি ছিল।

ঢাকাতে কেন পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে জানতে চাইলে বলেন, ভারত ছাড়া অন্য সব দেশের সঙ্গে আমাদের প্রধান যোগাযোগ বিমানবন্দর দিয়ে। আর দেশের বাইরে থেকে যারা আসছেন তাদের একটা বড় অংশ ঢাকাতেই থাকেন। একইসঙ্গে ঢাকায় ঘনবসতি বেশি। নতুন স্ট্রেইনের সংক্রমণ ক্ষমতা অনেক বেশি। আর মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। কেউ মাস্ক পরছে না, সামাজিক দূরত্ব মানছে না। যার কারণে ঢাকার পরিস্থিতিরি অবনতি হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত সরকারি কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের ১৬টি বেড, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের ১০টি বেড, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০টি বেড, মুগদা জেনারেল হাসপাতালের ১৪টি বেড এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬টি বেডের সবগুলোতে রোগী রয়েছে।

কেবলমাত্র শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের ১৬টি বেডের মধ্যে চারটি, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের ৬টি বেডের মধ্যে একটি আর রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের ১৫টি বেডের মধ্যে দুইটি বেড ফাঁকা রয়েছে। তালিকাভুক্ত শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল আর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হলেও এখানে রোগীদের জন্য আইসিইউ বেড নেই।  অর্থ্যাৎ, করোনা আক্রান্তদের জন্য রাজধানী ঢাকার তালিকাভুক্ত ১০ সরকারি হাসপাতালের করোনা রোগীদের জন্য থাকা ১০৩টি আইসিইউর মধ্যে রোগী ভর্তি আছেন ৯৩ জন, ফাঁকা রয়েছে মাত্র ৭টি।

অপরদিকে, অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত ৯টি বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য আইসিইউ রয়েছে ১৬৪টি, তার মধ্যে রোগী ভর্তি আছেন ১২৬ জন, বেড ফাঁকা  রয়েছে মাত্র ৩৮টি। অর্থ্যাৎ, রাজধানী ঢাকার তালিকাভুক্ত সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের মোট ২৬৭টি আইসিইউ বেডের মধ্যে রোগী ভর্তি আছেন ২২২ জন আর বেড ফাঁকা রয়েছে ৪৫টি।

করোনা ডেডিকেটেড অন্যতম হাসপাতাল কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য বেড রয়েছে ২৭৫টি, সেখানে রোগী ভর্তি আছেন ৩৯৮ জন। বেডের অতিরিক্ত ১২৩ জন রোগী রয়েছেন সেখানে। রোগীদেরকে কেবিন শেয়ার করে থাকতে দিতে হচ্ছে।

এদিকে, করোনা রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে থাকায় সরকারি আরো পাঁচটি হাসপাতালকে পুনরায় প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এছাড়া শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটকে করোনা চিকিৎসায় ডেডিকেটেড করা হয়েছে। গত ২২ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই নির্দেশ দেয়। এতে বলা হয়, দেশে ক্রমাগত করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য রাজধানীর মিরপুরের লালকুঠি হাসপাতাল, ঢাকা মহানগর হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ডিএনসিসি করোনা আইসোলেশন সেন্টার ও সরকারি কর্মচারী হাসপাতালকে সার্বিকভাবে প্রস্তুত রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

গত বছর রোগী বাড়তে থাকায় এই হাসপাতালগুলোকে করোনা ডেডিকেটেড করা হয়। পরবর্তীতে রোগীর সংখ্যা কমে আসায়, অন্য রোগীদের জন্যও সেবা চালু করা হয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ঢাকার হাসপাতালগুলোতে রোগীতে ভরে গেছে। ইতোমধ্যে আমরা বেশকিছু হাসপাতালকে নতুন করে করোনা ডেডিকেটেড হিসেবে ঘোষণা দিয়েছি, যেগুলো আগে নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দিতো। কুর্মিটোলা, হলি ফ্যামিলি, রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় আরো বেড বাড়ানো হচ্ছে জানিয়ে বলেন, ঢাকার আশপাশের হাসপাতালগুলোতে করোনা ইউনিট করা হচ্ছে। গাজীপুর-টাঙ্গাইলেও আমরা একই ব্যবস্থা নিয়েছি। এগুলো করতে পারলে তিন হাজারের মতো বেড হবে। সিটি করপোরেশনের যেসব আইসোলেশন সেন্টার ছিল সেগুলোতে সেন্ট্রাল অক্সিজেন, ডাক্তার, নার্স এবং অন্যান্য সেবাসহ ওষুধের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে আরো ৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে মোট মৃত্যু হয়েছে আট হাজার ৮৬৯ জনের। নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন তিন হাজার ৬৭৪ জন। সব মিলিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ৯১ হাজার ৮০৬ জনে। গতকাল শনিবার বিকালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

এতে বলা হয়, ঢাকা সিটিসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ও বাড়িতে উপসর্গবিহীন রোগীসহ গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন এক হাজার ৯৭১ জন। এ পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছেন পাঁচ লাখ ৩৩ হাজার ৯২২ জন। সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ২২৪টি ল্যাবে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা হয়েছে। এর মধ্যে আরটি-পিসিআর ল্যাব ১২০টি, জিন-এক্সপার্ট ৩১টি, র্যাপিড অ্যান্টিজেন ৭৩টি। এসব ল্যাবে ২৪ ঘণ্টায় নমুনা সংগ্রহ হয়েছে ২৪ হাজার ৭২৬টি। মোট নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ২৪ হাজার ৬৬৪টি। এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৪৫ লাখ ৬৬ হাজার ৬৯৪টি।

গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষায় শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ৯০ শতাংশ। এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ১২ দশমিক ৯৬ শতাংশ এবং সুস্থতার হার ৯০ দশমিক ২২। শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুর হার এক দশমিক ৫০ শতাংশ। নতুন মৃত ৩৯ জনের মধ্যে ২৪ জন পুরুষ, ১৫ জন নারী। এদের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ২৮ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে পাঁচ জন। রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে দুই জন করে চার জন। এছাড়া সিলেট ও রংপুর বিভাগে এক জন করে দুই জন রয়েছেন। হাসপাতালে মারা গেছেন ৩৯ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় আইসোলেশনে এসেছেন ১৯৩ জন ও আইসোলেশন থেকে ছাড় পেয়েছেন ৬৪ জন। এ পর্যন্ত আইসোলেশনে এসেছেন এক লাখ তিন হাজার ৪৬২ জন, ছাড়পত্র নিয়েছেন ৯২ হাজার ৭৪৪ জন। বর্তমানে আইসোলেশনে আছেন ১০ হাজার ৭১৮ জন।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads