• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

মামুনুলকাণ্ডে হেফাজতে অসন্তোষ

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ০৯ এপ্রিল ২০২১

হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম-মহাসিচব মামুনুল হকের কর্মকাণ্ডে সংগঠনটির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। পরিস্থিতি বুঝে সংগঠনটির পদ থেকে মামুনুলকে সরিয়ে দেওয়ারও চিন্তাভাবনা চলছে শীর্ষ পর্যায়ে।

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও রয়্যাল রিসোর্টে নারীসঙ্গীসহ অবরুদ্ধ হওয়ার ঘটনায় এ অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। কৌশলগত কারণে মামুনুল হককে সমর্থন জানালেও ভেতরে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা কোনো অবস্থাতেই মামুনুল হকের কর্মকাণ্ড মেনে নিতে পারছেন না। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে হেফাজতের ‘বিতর্কিত’ এই নেতাকে। সংগঠনটির কয়েকজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া তাদের কথপোকথন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

এদিকে বুধবার রাতে মামুনুল হককে গ্রেপ্তারের গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এরপরের দিন বিকেলে তিনি নিজেই ফেসবুক লাইভে আসেন। লাইভে এসে তিনি সরকারকে আবারো হুমকি দেন। তিনি বলেন, আগুন নিয়ে খেলবেন না। এমনকী তার দ্বিতীয় স্ত্রীর ছেলের ভিডিওটি জোর করে নেওয়া বলে দাবি করেন।

জানা যায়, গত ৩ এপ্রিল সোনারগাঁও রয়্যাল রিসোর্টে নারীসঙ্গীসহ অবরুদ্ধ হন মামুনুল হক। পরে তিনি সেখানে দাবি করেন সঙ্গে থাকা নারীকে স্ত্রী হিসেবে দাবি করেন। তিনি তার স্ত্রীর নাম বলেন আমিনা তাইয়্যেবা। সঙ্গে থাকা নারী তার নাম বলেন জান্নাত আরা ঝর্ণা। এতে করে সন্দেহ তৈরি হয়। হেফাজতের কর্মীরা খবর পাওয়ার পর তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যান। এর কিছুক্ষণ পর তিনি তার স্ত্রীকে ফোন করে বলেন, ওই নারী তার স্ত্রী নয়, শহিদুল নামের একজনের স্ত্রী। এ বিষয়ে কয়েকটি ফোনালাপ ফাঁস হয়।

হেফাজত ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী নেতা হওয়া সত্ত্বেও তার এমন কাণ্ডে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে হেফাজতের অন্য নেতারা। এমন অবস্থায় গত ৫ এপ্রিল মোহাম্মদপুর জামিয়া রহমানিয়া মাদরাসায় জরুরি বৈঠকে বসেন হেফাজতের শীর্ষ নেতারা। সেখানে উপস্থিত ছিলেন হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা নুরুল ইসলাম, উপদেষ্টা মাওলানা আবুল কালাম, নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুল আউয়াল, মাওলানা মাহফুজুল হক, অধ্যাপক ড. আহমদ আব্দুল কাদের, মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী, যুগ্ম -মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব, মাওলানা ফজলুল করিম কাসেমী, মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবী, সহকারী মহাসচিব মাওলানা খুরশিদ আলম কাসেমী, মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী, মাওলানা হাসান জামিল, মাওলানা জসিমউদ্দীন, মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন রাজী, মাওলানা মুসা বিন ইজহার, অর্থ-সম্পাদক মাওলানা মুনির হোসাইন কাসেমী, ঢাকা মহানগর সহ-সভাপতি মাওলানা আহমদ আলী কাসেমী, কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আতাউল্লাহ আমিন, সহ-প্রচার সম্পাদক ফয়সাল আহমদ, সহ-অর্থ সম্পাদক মাওলানা জাকির হোসাইন কাসেমী, সহকারী সমাজকল্যাণ সম্পাদক মাওলানা গাজী ইয়াকুব, ঢাকা মহানগর সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুর রহমান হেলাল, মাওলানা ফজলুর রহমান প্রমুখ।

দলীয় সূত্রমতে, নিজের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য কয়েকজন অনুসারী নিয়ে ওই বৈঠকে উপস্থিত হন হেফাজতের বিতর্কিত নেতা মাওলানা মামুনুল হক।

জানা গেছে, ওই বৈঠকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শীর্ষ নেতারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, সস্তা জনপ্রিয়তা পেয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করছিলেন মামুনুল হক। তিনি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিলেন। নিজেকে সর্বে-সর্বা মনে করছিলেন। সংগঠনের চেইন অব কমান্ড মানছিলেন না। অনেকটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তার কারণে হেফাজতের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা এবং বিশ্বাস উঠে যাচ্ছিল। অনাহুত ঝামেলা পাঁকিয়ে সরকারকে ক্ষেপিয়ে তুলছিলেন তিনি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বৈঠকের এক পর্যায়ে হেফাজতের নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুল আউয়াল ও মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী মামুনুল হকের কথিত দ্বিতীয় স্ত্রী জান্নাত আরা ঝর্ণার পার্লারে কাজ করার বিষয়টি তুলে ধরেন এবং এ ব্যাপারে মামুনুল হকের কাছে প্রকৃত সত্য জানতে চান। তখন মামুনুল হক তাদের জানান, জীবন এবং জীবিকার প্রয়োজনে তিনি নিজেই জান্নাত আরা ঝর্ণাকে ঢাকার একটি বিউটি পার্লারে কাজ জোগাড় করে দিয়েছেন।

সূত্র মতে, মামুনুলের এই স্বীকারোক্তির পর হেফাজতের কয়েকজন শীর্ষ নেতা তাকে বলেন, পার্লারে কাজ করা দোষের কিছু না। কিন্তু আপনি (মামুনুল হক) কোন পরিবারের সন্তান সেটা আপনার মাথায় রাখা উচিত ছিল। তাছাড়া ভরণ-পোষণ দেওয়ার ক্ষমতা না থাকলে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করা উচিত না।

এদিকে ওইদিনের বৈঠকে উপস্থিত থাকার জন্য হেফাজতের যুগ্ম-মহাসচিব ফজলুল করিম কাসেমী সংগঠনটির নায়েবে আমির ড. আহমেদ আব্দুল কাদেরকে ফোন দিলে মামুনুলের কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘মানুষ তো সুযোগ পেয়ে গেল। সত্য কী মিথ্যা, সেটা পরের কথা। মানুষ তো এখন বলবে-যান, আপনারা মাওলানারা কেমন, তা বোঝা হয়ে গেছে। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনারা তাকে (মামুনুল হক) এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন, যেন তিনি রাজপুত্র। ’

ফজলুল করিম কাসেমী ও ড. আহমেদ আব্দুল কাদেরের এই ফোনালাপ এখন নেট দুনিয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। এছাড়া হেফাজতের আরো দুই নেতার ফোন আলাপ থেকে জানা যায়, সংগঠনের স্বার্থে আপাতত তারা মামুনুলকে সহযোগিতা করবে। পরিস্থিতি শান্ত হলে হেফাজতের নেতৃত্ব থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হবে।

অবশ্য এসব ব্যাপারে মিডিয়াতে সরাসরি কোনো বক্তব্য দিতে চান না হেফাজতের নেতারা। আপাতত তারা দেখতে চান মামুনুল হকের ব্যাপারে সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়।

সেদিনের বৈঠক সম্পর্কে জানতে চাইলে হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতা খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী বলেন, ‘বৈঠক শুরুর দিকে আমি ছিলাম না। বেশ কিছুক্ষণ পরে আমি সেখানে উপস্থিত হয়েছিলাম। ফলে সব আলোচনা আমি শুনিনি।’

‘অবশ্য মামুনুল হকের দ্বিতীয় স্ত্রী জান্নাত আরা ঝর্ণা যে বিউটি পার্লারে কাজ করেন, সে বিষয়টি ওখানে গিয়ে আমি শুনেছি। আর উনি (মামুনুল হক) যে তাকে বিয়ে করেছেন, সে ব্যাপারে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য দুজন লোককে তিনি (মামুনুল হক) বৈঠকে নিয়ে এসেছিলেন’ বলেন মুজিবুর রহমান হামিদী।

গ্রেফতারের গুজব : গত বুধবার সন্ধ্যা থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে মামুনুল হক আটক হয়েছেন। এমন খবরের ভিত্তিতে প্রথমে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা মহানগরীর নেতা ফজলুল করিম কাসেমীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এ রকম খবর শোনেননি। তাকে (মামুনুল) কেউ আটক বা গ্রেপ্তার করেনি। মামুনুল কোথায় আছেন জানতে চাইলে কাসেমী বলেন, তার কাছে নেই। তবে এক জায়গায় আছে, বলা যাবে না।

এরপর রাত যত বেড়েছে গ্রেপ্তার সম্পর্কিত গুঞ্জনের ডালপালা ততই ছড়িয়েছে। এক পর্যায়ে জানা যায়, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি দল মোহাম্মদপুর বছিলা এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করেছে। এই খবরের সত্যতা জানতে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার, যুগ্ম-কমিশনারসহ বেশ কয়েকজন ডিসি, এডিসি এবং সিনিয়র এসির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, না, মামুনুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়নি।

মোহাম্মদপুর এলাকার কর্মরত গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, মামুনুল হক এখনো আটক বা গ্রেপ্তার হননি। বেশ কয়েক জায়গায় অভিযান চালানো হয়েছে।

অপর একটি সূত্র জানায়, মোহাম্মদপুর বছিলা ব্রিজসংলগ্ন জামিয়া আরাবিয়া মাদরাসার সামনে সন্ধ্যা থেকে পুলিশ মোতায়েন ছিল। ওই মাদরাসা পরিচালনার দায়িত্বে আছেন মামুনুল হক। রাত ১১ টার দিকে পুলিশ সেখান থেকে চলে যায়। এরপর রাত ১২ টার দিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে মামুনুল হককে গ্রেপ্তার করেছে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ।

এবিষয়ে জানতে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার হারুন অর রশীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, মামুনুলকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। যারা বলেছে তারা রং মেসেজ দিয়েছে।

অন্যদিকে, মামুনুল হককে গ্রেপ্তারের ব্যাপারে পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেন, তারা অভিযান অব্যাহত রেখেছেন। যে কোনো সময় তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে।

লাইভে এসে যা বললেন মামুনুল : গ্রেপ্তারের গুঞ্জনের মধ্যেই গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে লাইভে আসেন হেফাজত নেতা মামুনুল হক। লাইভে এসে  ৩ এপ্রিল রয়্যাল রিসোর্টে ঘটনার অনেক কিছুই খোলাসা করেন।

মাওলানা রফিকুল ইসলাম মাদানীকে গ্রেপ্তার প্রসংগে তিনি বলেন, একইভাবে তার চরিত্রের ওপরও কালিমালেপনের চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, চরিত্র হননের যে অশুভ খেলা শুরু হয়েছে, সেটা যদি চলতে থাকে তাহলে কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটা কী চিন্তা করেছেন? ইতোমধ্যেই কী দেখছেন না কতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কতো ব্যক্তিগত বিষয় জনসমক্ষে এসে পড়েছে। এটা দেশের শান্তিশৃঙ্খলা, স্থিতিশীল পরিবেশকে, সভ্য সমাজের ভদ্রতাকে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করবে।

লাইভে মাওলানা মামুনুল হক দাবি করেন, র‍য়্যাল রিসোর্টে তার সংগে থাকা নারীর ছেলে আব্দুর রহমানকে জোর করে ভিডিওবার্তা দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। লিখে দেওয়া স্ক্রিপ্ট তাকে ক্যামেরার সামনে বসে পড়তে বলা হয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads