• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জৈষ্ঠ ১৪২৯

জাতীয়

৭ দিনের কঠোর লকডাউন

অর্থনৈতিক ক্ষতি বহুমাত্রিক

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১২ এপ্রিল ২০২১

লকডাউন মানেই সবকিছু বন্ধ। চলে না কলকারখানার চাকা। বন্ধ হয়ে যায় উৎপাদন। এতে মূল ধাক্কাটা পড়ে অর্থনীতির ওপর। গত বছর লকডাউনের ফলে অর্থনীতির ওপর যে ধাক্কাটা পড়েছিল তা এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি; যদিও সরকার গত বছর অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বিভিন্ন খাতে বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণা করেছিল। কিন্তু এ নিয়েও আছে নানান ভুলত্রুটি ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ। সংক্রমণ ও মৃত্যু কমিয়ে আনতে হলে কঠোর লকডাউনের বিকল্প নেই বলে জনস্বাস্থ্যবিদদের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেন অর্থনীতিবিদরাও। তবে তারা বলছেন, কঠোর লকডাউনের ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতি বহুমাত্রিক। লকডাউনের সুফল যেমন রয়েছে, তেমনি দেশব্যাপী এই অচলাবস্থার কারণে কোটি কোটি টাকার ক্ষতিও হচ্ছে।

দেশে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকায় সরকার গত ৫ এপ্রিল থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত লকডাউন ঘোষণা করে। কিন্তু কোনো বিকল্প ব্যবস্থা না করে দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করায় মধ্য ও নিম্ন মধ্যবিত্তরা জীবন-জীবিকার পথ রুদ্ধ হওয়ার আশংকায় পথে নেমে আন্দোলন শুরু করে। এ অবস্থায় সংক্রমণ হু হু করে বাড়তে থাকলেও ব্যবসায়ীদের আন্দোলনের মুখে সরকার আবার দোকানপাটসহ সবকিছু খুলে দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু করোনার লাগাম টেনে ধরতে হলে কঠোর লকডাউনের বিকল্প নেই বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এরই ধারাবাহিকতায় সরকার আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের জন্য কঠোর লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, লকডাউন দেওয়া হলে অর্থনীতির সব খাতই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। লকডাউনের ফলে কোনো কোনো খাত সরাসরি ক্ষতির মুখে পড়ে, আবার কোনো কোনো খাত লকডাউন তুলে নেওয়ার পর ক্ষতির মুখে পড়ে। লকডাউনে ছোট উদ্যোক্তারা সরাসরি এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েন। ছোট ব্যবসায়ীরা বিপদে পড়লে তাদের পরিবারও বিপদে পড়ে। বড় উদ্যোক্তারা সরকারের সুবিধা নিয়ে টিকে থাকলেও ছন্দপতন দেখা যায়। অনেক কর্মচারী চাকরি হারান। অর্থনীতিতে এর দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির হিসাব অনুযায়ী সারা দেশে গত বছরের লকডাউনে ৫৩ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের দৈনিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় এক হাজার ৭৪ কোটি টাকা। এ বছরও ক্ষতির পরিমাণ প্রায় সমান বলে জানান বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন। বলেন, গত বছর লকডাউনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র ব্যবসা খাত। বাংলাদেশে অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সংখ্যা ৫৩ লাখের বেশি। এদের পুঁজির পরিমাণ ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। গত বছরের লকডাউনে তারা সব পুঁজি নষ্ট করেছেন। ক্ষুদ্র ব্যবসা খাতের উদ্যোক্তারা কোনো প্রণোদনা পাননি। নিজেরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। এমতাবস্থায় ফের লকডাউনে দেওয়ায় তা তুলে নিতে তারা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করছেন।

এদিকে লকডাউন দীর্ঘায়িত না করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দোকান ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আরিফুর রহমান টিপুর সই করা এক চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘আজকে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী ঠিকমতো বাজার করে তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে দুবেলা দুমুঠো ভাত খেতে পারছেন না। তাদের কাছে নগদ টাকার বড়ই অভাব। লকডাউনের সময়সীমা বৃদ্ধি পেলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের পথে বসার উপক্রম হবে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের গবেষক ড. জায়েদ বখত মনে করেন, গত বছরের মতোই এবারো লকডাউনে সেবা খাত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অবশ্য সরকারের প্রচেষ্টায় গত বছর করোনা মোকাবিলায় ভালো রেজাল্ট এসেছিল। সার্বিকভাবে করোনা বেড়ে যাওয়ায় লকডাউন দীর্ঘায়িত হলে নতুন করে ভাবতে হবে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে স্বাস্থ্য খাতের ওপর। স্বাস্থ্য খাত ভালো থাকলে অন্যান্য খাতও ভালো থাকবে। আর স্বাস্থ্য খাত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে সব খাতেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

যদিও করোনা মহামারী মোকাবিলায় লকডাউনে কোন খাতে কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, তার কোনো হিসাব সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে এখন পর্যন্ত করা হয়নি। তবে গত বছর প্রথম এক মাসের লকডাউনে বাংলাদেশ কী পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, তার একটি ধারণা দিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য-অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের গবেষক দল। ‘অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব’ শীর্ষক এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালের লকডাউনের প্রথম এক মাসে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।

গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ ওই সময় জানিয়েছিলেন, কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে গড়ে প্রতিদিন ক্ষতির পরিমাণ অন্তত ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। লকডাউনের ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতি সবচেয়ে প্রকট আকার ধারণ করে সেবা খাতে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী বেচা-কেনা এবং জরুরি সেবা ছাড়া এই খাত মূলত অবরুদ্ধ। সব ধরনের যোগাযোগ (সড়ক, রেল, নৌ ও আকাশপথ), পর্যটন, হোটেল ও রেস্টুরেন্ট, রিয়েল এস্টেটসহ সব ধরনের সেবা বন্ধ ছিল। সব মিলিয়ে সেবা খাতে প্রতিদিনের অনুমিত চলতি ক্ষতির পরিমাণ অন্তত দুই হাজার কোটি টাকা।

তাদের হিসাবে শিল্প খাতে প্রতিদিন ক্ষতি হচ্ছে এক হাজার ১৩১ কোটি টাকা। উৎপাদন ও নির্মাণ খাতে প্রতিদিনের অনুমিত ক্ষতির পরিমাণ প্রায় এক হাজার ১৩১ কোটি টাকা। লকডাউনের কারণে ২০২০ সালে প্রতিদিন কৃষিতে ক্ষতি হয়েছে ২০০ কোটি টাকা। কৃষির প্রধান উপখাতগুলো হলো- শস্য উৎপাদন, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্যসম্পদ। স্বল্প মেয়াদে এসব উপ-খাতে উৎপাদন না কমলেও দেশি-বিদেশি অর্থনীতি অবরুদ্ধ থাকায় এসব উপ-খাতের উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্যের ওপর নিম্নমুখী প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ফলে প্রতিদিন প্রায় ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

তবে এবার সরকার চেষ্টা করছে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে আরো সমৃদ্ধ ও সম্প্রসারণ করতে। এ লক্ষ্য সামনে রেখে তৈরি হচ্ছে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত বৃহস্পতিবার বলেছেন, করোনা পরিস্থিতি মাথায় রেখেই আমরা বাজেট তৈরি করছি। লক্ষ্য আমাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে আরো সমৃদ্ধ ও সম্প্রসারিত করা। আমরা এই কাজগুলো করতে পারলে সবার হা-হুতাশ কমে যাবে, সবার কাছে টাকা পয়সা থাকবে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে রেভিনিউ জেনারেট করা, রেভিনিউ জেনারেট করতে গিয়ে যেন অন্য কোনো বিষয় মুখোমুখি চলে না আসে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হচ্ছে। ডোমেস্টিক ইন্ডাস্ট্রিকে আরো সমৃদ্ধ করতে চাই। এটি বিকশিত হলে আমাদের রেভিনিউ জেনারেশন সহজলভ্য হবে। তাদের হাত ধরেই একদিকে রেভিনিউ কালেক্ট করব অন্যদিকে কর্মসংস্থান নিশ্চিত হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads