• বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জৈষ্ঠ ১৪২৯
অগ্নিঝুঁকিতে দিন কাটছে পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

অগ্নিঝুঁকিতে দিন কাটছে পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০৭ মে ২০২১

দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতা ও যথাযথ তদারকির অভাবে পুরান ঢাকায় কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। ঘটছে অগ্নিকাণ্ড, মারা যাচ্ছে মানুষ, নিঃস্ব হচ্ছে একেকটি পরিবার। কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের স্থানান্তরের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হলেও বিভিন্ন সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতায় সেই কাজ এগোচ্ছে না। মুন্সীগঞ্জে ৩০০ একর জমির ওপর হচ্ছে কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জমিটিতে মাটি ভরাটের কাজ চলছে। ২০২২ সালের জুনে শেষ হবে প্রকল্পের কাজ।

স্থানান্তরের আগপর্যন্ত কীভাবে চলবে কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের কার্যক্রম, কী ধরনের নজরদারি বা সতর্কতা নেওয়া হবে, কারা করবেন তদারকি তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ যতদিন কেমিক্যাল ব্যবসা স্থানান্তর না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের আতঙ্কে থাকতে হবে। অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি নিয়ে দিন পার করতে হবে।

২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীর আগুনে মারা যান ১২৪ জন। চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি আগুনে প্রাণ যায় ৭১ জনের। এ বছর আরমানিটোলার হাজী মুসা ম্যানশনের আগুনের ঘটনায় মারা যান ৬ জন। সব ঘটনার স্থান একই-পুরান ঢাকা। আর আগুন লাগার পর প্রতিবারই আলোচনায় আসে অবৈধ কেমিক্যাল গোডাউনের কথা। এক সংস্থা আরেক সংস্থার ওপর দায় চাপিয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। শুরু হয় লোক দেখানো অভিযান-বলছিলেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব।

তিনি বলেন, মনিটরিংয়ের অভাব, নানা সিদ্ধান্ত কার্যকর না করা এবং সর্বোপরি এসব মৃতুকে আমলে না নেওয়ার কারণেই অগ্নিকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। পুরান ঢাকার অগ্নিকাণ্ডগুলোকে নিছক দুর্ঘটনা না বলে অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করা হোক। বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে কাদের কারণে কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়েছে বা কার্যকর হয়নি তা বের করা হোক। মৃত্যুর দায় কে, কীভাবে বহন করবে, ক্ষতিপূরণ কী করে দেওয়া হবে-এসব বিষয়কে প্রাধান্য দিলে এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধ হতে পারে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান ড. সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া বলেন, কেমিক্যাল আমদানি থেকে মজুত কোনো ব্যক্তির পছন্দের ওপর নির্ভর করবে না। এতে ঝুঁকি বেড়ে যাবে। সরকারকে এখন প্রায়োরিটির ভিত্তিতে কেমিক্যালের বিষয়ে নজর দিতে হবে। রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা ও দেখভালে বেশ কয়েকটি সংস্থা জড়িত। একটি ঘটনা ঘটলে শোনা যায় গোডাউনের ট্রেড লাইসেন্স নেই। লাইসেন্স নেই বলে কি ওরা পার পেয়ে যাচ্ছে? লাইসেন্স ছাড়া ওরা অবৈধ কেমিক্যাল ব্যবসা চালাচ্ছে কী করে?’

পুরান ঢাকায় বৈধ-অবৈধ কী পরিমাণ কেমিক্যাল গোডাউন এবং ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে, সেটার তালিকা করতে হবে। লাইসেন্স ছাড়া তো আমদানি সম্ভব নয়। আমদানিকারক ও মজুতকারী কারা এ বিষয়ে নজর দিলেও ঝুঁকি কমানো সম্ভব। স্থানান্তর প্রক্রিয়া কেমন হবে, কীভাবে হবে, ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল কী করে সরানো হবে সে বিষয়গুলোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। ব্যবসায়ীদের অসচেতনতাও বড় দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। জনসচেতনতাও বড় একটি বিষয়। কোন রাসায়নিকের ক্ষেত্রে কেমন সতর্কতা রাখতে হবে, বিস্ফোরকের ব্যাপকতা কেমন সে সম্পর্কে যদি জনসাধারণ অবহিত থাকে তবে তারাও কেমিক্যাল আছে এমন বাসাবাড়িতে থাকার বিষয়ে সতর্ক হবে।

মুসা ম্যানশনের ভাড়াটিয়ারা শিক্ষিত। তারপরও তারা এটা জানতেন না যে কী ধরনের কেমিক্যাল তাদের বাসার নিচে মজুত রয়েছে। এগুলোতে সামান্য আগুন লাগলে কত বড় আকারে তা ছড়াতে পারে, কী ধরনের বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হতে পারে এসব ভাড়াটিয়ারা জানলে এলাকা ছেড়েই চলে যাবে। এতেও প্রাণহানির ঘটনা কমবে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় রাসায়নিক সমন্বয় কমিটি গঠনের কথাও বলেন তিনি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, পুরান ঢাকার কর অঞ্চল ৩, ৪ ও ৫ এলাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে ১৯২৪টি কেমিক্যাল গোডাউনের সন্ধান পাওয়া গেছে। কেমিক্যালের ধরন ও ঝুঁকির মাত্রা বিবেচনায় মাঝারি আকারের ঝুঁকিতে থাকা গোডাউনের সংখ্যা ৯৮ শতাংশ। অতি ঝুঁকিপূর্ণ ০.৫ শতাংশ, নিম্ন ঝুঁকিপূর্ণ ১.৫ শতাংশ। এসব তথ্য জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে সম্প্রতি একটি চিঠি দিয়েছে ডিএসসিসি। তালিকা তৈরিতে সহায়তা করেছে ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, শিল্প মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরা। ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, সিটি করপোরেশন থেকে কোনো অনুমতি ছাড়াই কীভাবে এসব দ্রব্য আমদানি হয়, কীভাবে গুদামজাত হয় ও কীভাবে ব্যবসা চলে আসছে? দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ যতোক্ষণ কাজ না করবে ততক্ষণ সমস্যা রয়ে যাবে।

বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান বিস্ফোরক কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, কেমিক্যালের লাইসেন্স দেওয়ার সংখ্যা অনেক কম। প্রোজ্জ্বলনীয় দাহ্য পদার্থ নিয়ে যে আইন রয়েছে, পেট্রোলিয়াম বিধিমালা অনুসারে আমরা কিছু এনওসি এবং মজুত করার লাইসেন্স দেওয়া হয়। এ ছাড়া অন্যান্য কেমিক্যালের লাইসেন্স আমরা দিই না। বেশিরভাগই দেওয়া হয় সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে। লাইসেন্স দেওয়ার পর মনিটরিংয়ের সুযোগ কম। কোনো ব্যবসায়ী যখন আবেদন করেন, সেই সময় আমরা কাগজপত্র ও অবকাঠামো যাচাই করে লাইসেন্স দিই। চুড়িহাট্টার ঘটনার পর থেকে পুরান ঢাকায় আমরা আর কোনো লাইসেন্স দেয়নি। 

শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক মুন্সীগঞ্জের প্রকল্প পরিচালক সাইফুল আলম বলেন, প্রকল্পের মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়েছে। এটা শেষ হলেই রাস্তা, ড্রেন-কালভার্ট করে প্লট করা হবে। এরপরই বরাদ্দ দেওয়া যাবে। কাজ শেষ হতে ২০২২ সালের জুন লেগে যাবে। শিল্পনগরী সম্পন্ন হওয়ার পর একটি নীতিমালা হবে। স্থানান্তরের আগ পর্যন্ত শিল্পমন্ত্রণালয় কী ধরনের নজরদারি রাখবে জানতে চাইলে বলেন, কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের সিটি করপোরেশন ট্রেড লাইসেন্স দেয়। আমরা অবকাঠামোর দিকগুলো নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশন-  তারাই এসব নজরদারি করে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আমি শুধু ব্যবসায়ীদের বলতে পারি নিরাপত্তা জোরদার করতে। আবাসিক এলাকায় যেন গোডাউন বা দোকান না বানায় সে বিষয়ে ব্যবসায়ীদের নির্দেশনা দিয়েছি। অফিশিয়ালি এসব দেখভালের দায়িত্ব বিসিকের নয়।

বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নুরুল মোস্তফা বলেন, ‘২০২২ সালে স্থানান্তরের আগপর্যন্ত আমাদের ব্যবসা পরিচালনা প্রক্রিয়া কেমন হবে তা নিয়ে এখনো নির্দেশনা পাইনি। আমরা নিজেরাও শঙ্কিত। বিভিন্ন সময় অগ্নিকাণ্ডের পরই কেমিক্যাল গোডাউনগুলোতে অভিযান শুরু হয়। সরিয়ে ফেলতে বলা হয় গুদাম। কিন্তু কোথায় সরানো হবে তা কেউ বলে না। এখন শুনতে পাচ্ছি সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে আবারো অভিযান হবে। বিস্ফোরক জাতীয় রাসায়নিক দ্রব্যাদির লাইসেন্স মিটফোর্ড এলাকায় দেওয়া হয় না। এসবের জন্য নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জে কিছু কিছু গোডাউন আছে। আমরা ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকে কমিটি করে দিয়েছি। যারা অবৈধ উপায়ে ব্যবসা চালাচ্ছে তাদের ওপর নজরদারি হচ্ছে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads