• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯
ভেজাল-নকল বিটুমিনে সড়কে বাড়ছে ঝুঁকি

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

ভেজাল-নকল বিটুমিনে সড়কে বাড়ছে ঝুঁকি

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৯ মে ২০২১

সড়কপথ তৈরিতে বিশ্বমানের বিটুমিন উৎপাদন করছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড বা ইআরএল। এর বদলে সারা দেশের সড়কে আমদানি হওয়া নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার করছে অসাধু ঠিকাদাররা। নকল বিটুমিনে তৈরি সড়ক মুহূর্তেই ভাঙছে। সেই ভাঙা সড়কে ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন। বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। এতে প্রতি বছর সড়কে হাজারো তাজ প্রাণ ঝরে হচ্ছে লাশ। তথ্য সংশ্লিষ্ট সূত্রের। এ প্রসঙ্গে নিরাপদ সড়ক চাই’র (নিসচা) চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে যেমন সড়ক দুর্ঘটনা হয়, তেমনি ত্রুটিপূর্ণ রাস্তার কারণেও দুর্ঘটনা হচ্ছে। ভাঙা সড়কও দুর্ঘটনার কারণ। বিশ্বে রাস্তা নির্মাণে সবচেয়ে বেশি খরচ হয় বাংলাদেশে। কিন্তু এত টাকা দিয়ে রাস্তা তৈরি হওয়ার পরও ভালো থাকে না, এটা জনগণের জন্য বড় কষ্টের বিষয়।

সরেজমিন দেখা যায়, দেশের প্রায় ৪৫টি জেলায় শত শত সড়কের বিভিন্ন জায়গা দেবে গেছে কিংবা খানাখন্দ তৈরি হয়েছে। এসব রাস্তা তৈরির কাজও চলছে। খোলা ড্রামে, পুরনো আমলের প্রযুক্তি ব্যবহার করে, আগুনে পুড়িয়ে গলানো হচ্ছে বিটুমিন। যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে, বিটুমিনকে গরম করার আদর্শ তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ১৫০ থেকে ১৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু এখানে আদর্শ তো দূরে থাক, তাপমাত্রা মাপারই ব্যবস্থা নেই। আর  বিটুমিনের ড্রামে ড্রামে চোখ রাখলে দেখা যায় সবই বেসরকারিভাবে আমদানি করা নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের বিটুমিন। তবে কিছু অসাধু ঠিকাদার একটি কৌশল ব্যবহার করে। তারা দেশে তৈরি ইস্টার্ন রিফাইনারির কয়েকটি ড্রাম প্রকাশ্যে রাখেন। আড়ালে রাখেন কম দামে আমদানি করা নিম্নমানের বিটুমিন। এসব ভেজাল বিটুমিন দিয়ে তৈরি রাস্তাগুলোর আয়ু বড়জোর এক বছর বা তারও কম। ফলে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ে ছাড়া কমে না। সড়কে সড়কে শত শত দুর্ঘটনায় তরতাজা প্রাণ হয় লাশ।

এ নিয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য হলো, বেসরকারিভাবে আমদানি হওয়া নকল আর নিম্নমানের বিটুমিনের কারণেই বাংলাদেশের ৬০ থেকে ৭০ ভাগ সড়ক নির্মাণের ৬ মাস থেকে ১ বছরের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নিম্নমানের আমদানিনির্ভর বিটুমিন ব্যবহারে রাষ্ট্রের ত্রিমুখী ক্ষতি হচ্ছে। এক. বৈদেশিক মুদ্রার অপচয়। দুই. টেকসই উন্নয়ন হচ্ছে না। আর তিন. কিছু অসাধু ঠিকাদার আর অসৎ ব্যবসায়ীদের  সিন্ডিকেট ভাঙা যাচ্ছে না। কিছু অসাধু ব্যবসায়ীদের সাথে অসৎ আমদানিকারকরা মিলে একটি বিটুমিন সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। যার ফলে দেশের বিপুল অর্থের লোকসান হচ্ছে। পাশাপাশি সড়কগুলোও টেকসই হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে টেকসই সড়ক উন্নয়নের স্বার্থে দেশীয় ভালোমানের বিটুমিন ব্যবহারের পাশাপাশি নির্মাণকাজে নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের দাবি, সড়কে শৃঙ্খলা আনতে প্রয়োজন টেকসই নির্মাণকাজ নিশ্চিত করা।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, বিটুমিন আগুনে গলানোর সময় তাপমাত্রা কত থাকবে, আবার ট্রাকে তোলার সময় তাপমাত্রা কত হবে, এরপর ট্রাক থেকে নামিয়ে নির্মাণাধীন রাস্তায় যখন ছড়িয়ে দেওয়া হবে, তখন কত মাত্রার তাপ থাকবে, সেটা দেখা হয় না। ঠিকাদাররা তাদের বাণিজ্যিক মনোভাবের কারণে এই বিষয়গুলো মেনে চলেন না। এই কারণে আমরা বিটুমিনের সড়ক টেকসই করতে পারি না।

ইসলামিক ইউনির্ভাসিটি অব টেকনোলজি-আইইউটির সহকারী অধ্যাপক আইইউটি এবং বিটুমিন বিশেষজ্ঞ ড. নাজমুস সাকিব বলেন, সড়ক নির্মাণে নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার করায় পাথর থেকে বিটুমিন আলাদা হয়ে যাচ্ছে। এভাবে সড়ক নষ্ট হয়ে যাওয়ার পেছনে খারাপ বিটুমিনই দায়ী। আমদানি হওয়া বিটুমিন প্রথমত অনেক দিন শিপ বা জাহাজে থাকে। এই বিটুমিন উৎপাদনের উৎস আমরা কেউ বলতে পারি না। ফলে এই বিটুমিনের মান সব সময়ই আকাশ-পাতাল ফারাক হয়। কিন্তু স্থানীয়ভাবে বিটুমিন উৎপাদন হলে আমদানি নির্ভরতা কমানো সম্ভব হবে। বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। ভালোমানের বিটুমিন পাবে বাংলাদেশ। সহজেই সড়ক ভাঙবে না। দুর্ঘটনাও কমতে পারে। প্রাণহানির হারও কমে আসবে, এই প্রত্যাশাও করছি।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিয়মিত অডিট চাই। সড়কের মান উন্নতি করতে হবে। যদিও এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সড়ক নির্মাণে বাংলাদেশে সবচেয়ে অর্থ খরচ বেশি হয়। প্রতি বছর সারা দেশের সড়ক নির্মাণে ১০ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়। এই লুটপাটের নেপথ্যে রয়েছে সড়ক নির্মাণে নিম্নমানের বিটুমিন ও পাথরসহ ভেজাল উপকরণ ব্যবহার। এই ভেজাল বন্ধ করতে পারলেই লুটপাট বন্ধ হবে। এটা সরকারকেই করতে হবে।

সর্বশেষ ২০২০ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৬৮৬ জন নিহত হওয়ার তথ্য দিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সংগঠনটি দেশের জাতীয়, আঞ্চলিক ও অনলাইন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি প্রতিবেদনে বলেছে, ২০২০ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের সঙ্গে আহত হয়েছেন ৮ হাজার ৬০০ জন। দুর্ঘটনার তথ্য পর্যালোচনা করে সংগঠনটি বলছে, গত বছর যত সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে, এর মধ্যে ৫২ দশমিক ৯৬ শতাংশ গাড়িচাপা দেওয়ার ঘটনা। এ ছাড়া ২২ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ১৭ শতাংশ যানবাহন খাদে পড়ে দুর্ঘটনাকবলিত। দেশে সড়ক দুর্ঘটনার প্রায় ২৯ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৪৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে সংগঠিত হয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে,  বিটুমিন মূলত রাস্তাঘাট নির্মাণে ব্যবহূত হয়। বাংলাদেশে বছরে বিটুমিনের চাহিদা প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টন। এর প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। এর মধ্যে বিপিসির নিয়ন্ত্রণাধীন ইস্টার্ন রিফাইনারি ৭০ হাজার টন উৎপাদন করে। বাকি বিটুমিন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। তবে প্রায়ই বিদেশ থেকে নিম্নমানের বিটুমিন আমদানি করে সড়কে ব্যবহারের কারণে সড়ক টেকসই হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি মাসে বিটুমিনের চাহিদা প্রায় ৪২ হাজার টন। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্প্রসারিত হওয়ায় প্রতি বছর এর চাহিদা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। সাধারণ পেনেট্র্যাশন গ্রেড (৬০-৭০/৮০-১০০) ও উন্নত গ্রেডের বিটুমিন চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন ও সরবরাহ করা সম্ভব হবে।

খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের অধীনে ২২ হাজার কিলোমিটার সড়ক ও মহাসড়ক রয়েছে, এর বড় অংশই সম্প্রসারিত হচ্ছে। সরকার দেশের প্রতিটি জাতীয় মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। এ ছাড়া জেলা পর্যায়েও সড়ক সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। সারা দেশে স্থানীয় সরকারের অধীনে ৩ লাখ ৫৪ হাজার কিলোমিটার রাস্তা হয়েছে, এর মধ্যে ১ লাখ পাঁচ হাজার কিলোমিটার পিচঢালা পাকা রাস্তা। ভবিষ্যতে স্থানীয় সরকারের পুরো রাস্তাই পাকা করার পরিকল্পনা আছে সরকারের। ফলে দিন দিন বাংলাদেশে বিটুমিনের চাহিদা বাড়বে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads