• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯

জাতীয়

‘গণমাধ্যম-সরকার মুখোমুখি হলে দায় সরকারের’

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২০ মে ২০২১

প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে হেনস্তা, গ্রেপ্তার ও কারাগারে পাঠানোর ঘটনায় দেশব্যাপী গণমাধ্যমকর্মীদের বিক্ষোভ-সমাবেশ অব্যাহত রয়েছে। তারা হেনস্তাকারীদের উপযুক্ত শাস্তি দাবি করে রোজিনা ইসলামের নিঃশর্ত মুক্তি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। সরকার-সাংবাদিক যদি মুখোমুখি অবস্থান নেয় তাহলে এই দায় সরকারকে নিতে হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি মোল্লা জালাল। এ ছাড়া রোজিনা মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ না ছাড়ার ঘোষণা দেন সাংবাদিকরা।

গতকাল বুধবার জাতীয় প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে রোজিনা ইসলামের মুক্তির দাবিতে আয়োজিত মানববন্ধনে  মোল্লা জালাল বলেন, তার ওপর যে অন্যায় হয়েছে, আমি মনে করি সংবাদমাধ্যমের ওপর এ এক বর্বরোচিত হামলা। আমি এর নিন্দা জানাই। আজ সেই কারণে সমগ্র বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজ ফুঁসে উঠেছে।

আজকের এই সমাবেশ থেকে আমাদের সুনির্দিষ্ট দাবি জানিয়েছি। আগামীকাল (আজ) নিঃশর্ত মুক্তির মাধ্যমে রোজিনাকে আমাদের মধ্যে ফেরত চাই। আপনাদের প্রতি আগাম পরামর্শ তার মুক্তির পর আমরা তাকে বরণ করে নেব, আমাদের সাফল্যের অংশ হিসেবে।

রোজিনার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। রোজিনার ওপর অমানবিক নির্যাতন হয়েছে। এ ঘটনার তদন্তের জন্য উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করতে হবে। সেই কমিটিতে সাংবাদিকদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এসব দাবি মেনে নেওয়া না হলে সাংবাদিকদের সব সংগঠনসহ আমরা সম্মিলিতভাবে কঠোর কর্মসূচিতে যাব। আর তখন যদি সরকার গণমাধ্যম মুখোমুখি অবস্থান নেয়, তাহলে তার দায় সরকারকে নিতে হবে।

বিএফইউজের সহসভাপতি সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, রোজিনার ওপর যে হাত পড়েছে সেটা দুর্নীতিবাজ আমলাতন্ত্রের কালো হাত। তার গলায় নয়, এদেশের জনগণের গলায় তারা হাত দিয়েছে। তাকে সচিবালয়ে ৬ ঘণ্টা আটকে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা আজকে নির্যাতন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। আমি তার ওপর হামলা দেখি আমলাতান্ত্রিক নিপীড়ন হিসেবে। সুতরাং যারা এই কাজ করেছে তাদের বিচার করতে হবে।

মানববন্ধনে নেতারা আরো বলেন, সাংবাদিকরা কোনো তথ্যের জন্য ফাইল ধরে টানাটানি করে না। সরকারের লোকেরাই সাংবাদিকদের তথ্য সরবরাহ করে থাকে। রোজিনার বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আনা অভিযোগ হাস্যকর, অবান্তর ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরাসহ তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করা সরকারি কর্মচারীদের দায়িত্ব। তা না করে রোজিনার প্রতি দুর্নীতির নানাবিধ অভিযোগে অভিযুক্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে যে আচরণ করেছে, তার দায় সরকার কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। আগামীকালের (আজ) মধ্যে রোজিনাকে জামিনে মুক্তি দিতে হবে এবং সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে উচ্চ পর্যায়ের নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে এই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

তা না করা হলে, দেশের সকল গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের সকল সংগঠন, সাংবাদিক ইউনিয়ন ও প্রেস ক্লাবসহ সাংবাদিকদের অপরাপর সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে সারাদেশের সাংবাদিক, শ্রমিক-কর্মচারীদের নিয়ে বিএফইউজে কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবে। সাংবাদিক রোজিনাকে হেনস্তা করার ঘটনাকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনায় নিয়ে ঘোলা জলে মাছ শিকারের অপচেষ্টা থেকে বিরত থাকার সব মহলের প্রতি আহবান জানানো হচ্ছে।

এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন প্রেস ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক মাইনুল আলম, ডিআরইউ সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলাম, ডিউজে সাবেক সভাপতি আবু জাফর সূর্য, প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক, ডিইউজের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরী প্রমুখ।

অন্যদিকে সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) প্রাঙ্গণে ডিআরইউ আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে সাংবাদিকরা রোজিনাকে হেনস্তাকারীদের উপযুক্ত শাস্তি দাবি করে তার নিঃশর্ত মুক্তি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ না ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা। বলেন, দুর্নীতির খবর প্রকাশ করায় সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে স্বাস্থ্য সচিবের পিএসের রুমে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে, যা আইনের চরম লঙ্ঘন। এটা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথে বড় বাধা।

সমাবেশে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক এবং কিশোর আলোর সম্পাদক আনিসুল হক বলেন, সারাদেশের সাংবাদিকরা এক হয়েছেন। তারা এই মামলা প্রত্যাহার চান। যারা রোজিনাকে হেনস্তা করেছে তাদের শাস্তি চান। এই মামলার মেরিট নেই। আমরা আজকে এই মামলার প্রত্যাহার চাই।

প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান বলেন, প্রশাসনের দুর্নীতির খবর প্রকাশ করে সাংবাদিকরা চক্ষুশূল হয়েছেন। ফলে রোজিনার ওপর হামলা। রোজিনার মামলা যদি প্রত্যাহার না করা হয় তাহলে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। প্রয়োজনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত যাব আমরা।

ডিআরইউ সভাপতি মোরসালিন নোমানি বলেন, রোজিনাকাণ্ডে স্বাস্থ্যমন্ত্রী অরুচিকর বক্তব্য দিয়েছেন। আমরা এই বক্তব্য প্রত্যাহার চাই। আমরা আরো দেখেছি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি করেছে। এটা হাস্যকর। যারা রোজিনার ওপর হামলা করেছে তারাই আবার তদন্ত করবে, আমরা এটা মানি না। এই তদন্ত কমিটি আমরা প্রত্যাখ্যান করছি। সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের হত্যাচেষ্টায় তার পরিবার, তার কর্মস্থল না করলেও ডিআরইউ হত্যাচেষ্টা মামলা করবে।

তিনি আরো বলেন, রোজিনা ইসলাম ছাড়াও যেসব সাংবাদিক জেলে আছেন তাদেরও মুক্তির দাবি জানাচ্ছি। কাল যদি রোজিনাকে মুক্তি না দেওয়া হয় আমরা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে একত্রিত হয়ে আদালত অভিমুখে যাত্রা করব। আমরা রোজিনাকে মুক্ত করেই ঘরে ফিরব।

ডিআরইউর সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান বলেন, আমরা পেশাদার সাংবাদিক। আমরা রাস্তায় আন্দোলন করতে চাই না। দ্রুত রোজিনা ইসলামের মুক্তি চাই। এ সময় সাংবাদিকরা আমার বোন নির্যাতিত কেন, প্রশাসন জবাব দে, প্রশাসনের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও, রোজিনা ইসলামের মুক্তি চাই স্লোগান দেন।

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু বলেন, রোজিনা ইসলামের নিঃশর্ত মুক্তি চাই। তার মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত আমরা ঘরে ফিরব না। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছে, নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা হয়েছে। আলোচনা করে আমরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত দেব।

ডিআরইউর সাবেক সভাপতি রফিকুল ইসলাম আজাদ বলেন, রোজিনার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। তিনি কারাগারে আছেন। আমরা তার নিঃশর্ত মুক্তি চাই। যারা অন্যায়ভাবে তাকে হেনস্তা করেছে আমরা তাদের শাস্তির দাবি জানাই। সমাবেশে সংহতি প্রকাশ করে বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম, ল রিপোর্টার্স ফোরাম, ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনসহ সাংবাদিকদের একাধিক সংগঠন। 

মামলা ডিবিতে : রোজিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার তদন্তভার মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। গতকাল বুধবার মামলাটি শাহবাগ থানা পুলিশের কাছ থেকে ডিবি রমনা বিভাগের কাছে হস্তান্তর করে। ডিবি রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) এইচ এম আজিমুল হক বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এর ফলে মামলাটি এখন থেকে তদন্ত করবে ডিবি রমনা বিভাগ। গত সোমবার রাতে রোজিনার বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। মামলার নম্বর ১৬। দণ্ডবিধি ৩৯৭ এবং ৪১১ অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্ট ১৯২৩ এর ৩/৫ এর ধারায় এ মামলা করেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব শিব্বির আহমেদ ওসমানী। এ মামলার একমাত্র আসামি করা হয়েছে রোজিনা ইসলামকে। পরদিন মঙ্গলবার সকাল ৮টার দিকে তাকে আদালতে নেওয়া হয়। সিএমএম আদালতের হাজতখানায় তাকে রাখা হয়। শুনানির জন্য তাকে সকাল ১১টার দিকে এজলাসে তোলা হয়।

এর আগে রোজিনা ইসলামকে জিজ্ঞাসবাদের জন্য ৫ দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে সরকারি নথি চুরির অভিযোগে হওয়া মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আরিফুর রহমান সরদার রিমান্ডের এ আবেদন করেন। আদালত তার রিমান্ড আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠিয়েছেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads