• মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

ভারতীয় ধরন বৃদ্ধির শঙ্কা!

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ২৪ মে ২০২১

করোনা ভাইরাস মহামারীর ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে নানা উদ্যোগ নিয়েও জনসচেতনতা বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। লকডাউন ও কঠোর লকডাউন দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে মার্কেটসহ সব ধরনের গণপরিবহনও বন্ধ করা হয়। কিন্তু সব আতঙ্ক উড়িয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে চলেছে। ফলে একপর্যায়ে দেশে বেড়ে যায় করোনা সংক্রমণের হার।

এর মধ্যে টানা ৩৯ দিন লকডাউনের পরে আজ সোমবার থেকে দেশের আন্তঃজেলা গণপরিবহন, লঞ্চ ও ট্রেন চলাচল শুরু হচ্ছে। খুলে দেওয়া হলো হোটেল, রেস্তোরাঁ ও খাবারের দোকান। স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে জনগণের অবাধ চলাফেরায় নতুন করে ভারতীয় ধরনের (ভ্যারিয়েন্ট) করোনা ভাইরাস ও হোয়াইট ফাঙ্গাস সংক্রমণ তীব্র আকারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।

এদিকে তিন দিন পরপর এমপি-মন্ত্রীদের করোনা টেস্ট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। দেশে করোনার ভারতীয় ধরন শনাক্ত হওয়ায় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় সংসদ। যেসব এমপি-মন্ত্রীকে সংসদে যেতে হবে তাদের এই টেস্টের ফলাফল দেখিয়ে সংসদ ভবনে প্রবেশ করতে হবে। গতকাল রোববার সংসদ ভবনের শপথ কক্ষে একাদশ জাতীয় সংসদের ১৩তম এবং বাজেট অধিবেশন উপলক্ষে প্রস্তুতিমূলক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

গত বছরে ৮ মার্চ মাত্র ৩ জন রোগীর দেহে প্রথম করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়, যা গত এক বছরে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গতকাল রোববার পর্যন্ত ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৮০ জনের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এর মধ্যে মারা গেছেন ১২ হাজার ৩৭৬ জন। সুস্থ হয়েছেন ৭ লাখ ৩০ হাজার ৬৯৭ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতায় সারাদেশের বিভিন্ন করোনা টেস্ট কেন্দ্রে মোট ৫৮ লাখ ২০ হাজার ৬১২ জনের দেহে করোনা পরীক্ষা করে এ পরিমাণ সংক্রমণ শনাক্ত হয়।

এদিকে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে বিপুলসংখ্যক মানুষ যেভাবে চলাফেরা করছে তাতে দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছে খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ পর্যন্ত ৫ জনের দেহে ভারতীয় ধরনের করেনা ভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এরপরও বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে ঈদের আগে-পরে মানুষের অবাধ যাতায়াতের কারণে দেশে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি ভারত ও নেপালের মতো ভয়াবহ হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন বাংলাদেশে খুব বেশি ছড়ায়নি। ভারতীয় ধরনের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে ২৬ এপ্রিল থেকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের স্থলসীমান্ত বন্ধ রয়েছে। বর্ডার বন্ধ করে দিয়ে সরকার সঠিক সময়ে যে পদক্ষেপ নিয়েছে, সেটির মাধ্যমে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট থেকে আমাদের দেশকে কিছুটা হলেও আমরা নিরাপদে রাখতে পেরেছি। এ ছাড়া সীমান্তবর্তী এলাকার পরিবারের সব সদস্যের করোনা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এখন সীমান্ত এলাকার কোনো যানবাহন নিজ জেলার বাইরে যেন যেতে না পারে, সে ব্যাপারে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।

এদিকে দেশে এখন পর্যন্ত করোনার চারটি ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত করা হয়েছে, যা বড় ধরনের আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। ২০০ কোভিড-১৯ রোগীর নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিং করে চারটি ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পাওয়া যায়। ভ্যারিয়েন্টগুলোর মধ্যে রয়েছে- বি.১.১.৭ (ইউকে ভ্যারিয়েন্ট), বি.১.৩৫১ (সাউথ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্ট), বি.১.৫২৫ (নাইজেরিয়া ভ্যারিয়েন্ট) এবং বি.১.৬১৭.২ (ইন্ডিয়া ভ্যারিয়েন্ট)। সম্প্রতি আইইডিসিআর, আইসিডিডিআর,বি ও আইদেশি’র সঙ্গে যৌথভাবে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। আইইডিসিআরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সেই গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।

অন্যদিকে করোনার পর নতুন দুশ্চিন্তা হিসেবে দেখা দিয়েছে ‘হোয়াইট ফাঙ্গাস’। এতদিন শুধু ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের’ কথা বলা হলেও গত শুক্রবার থেকে আবির্ভাব ঘটেছে ‘হোয়াইট ফাঙ্গাসের’। করোনায় বিপর্যস্ত বিশ্বে নতুন ‘মহামারী’ ফাঙ্গাস জনমনে আতঙ্ক আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। করোনা সংক্রমিতরাই এ রোগে বেশি আক্রান্ত হওয়ায় তাদের মধ্যে আতঙ্কের মাত্রাও বেশি। এরই মধ্যে প্রতিবেশী ভারতের ২৯টি রাজ্যে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসকে মহামারী ঘোষণার সুপারিশ করেছে দেশটির স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ। ফাঙ্গাস তাই আতঙ্ক ছড়িয়েছে বাংলাদেশেও। শুধু তা-ই নয়, এই রোগে এরই মধ্যে দেশে এ ফাঙ্গাসে দু-একজন মারা গেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। তবে সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, বাংলাদেশে ফাঙ্গাসে আক্রান্ত কোনো রোগী এখনো শনাক্ত হয়নি। তবে সীমান্তের ওপারে কলকাতায় শুক্রবার পাঁচজনের শরীরে নতুন এই রোগটি ধরা পড়েছে। এছাড়া মহারাষ্ট্র, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশসহ বেশ কটি রাজ্যে ফাঙ্গাসের বিস্তার ঘটেছে। এরপরই দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বারানসীতে চিকিৎসকদের সঙ্গে ভার্চুয়াল আলোচনায় বলেছেন, ব্ল্যাক ফাঙ্গাসও মারাত্মক আকার নিচ্ছে। আমাদের কাছে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে এই ছত্রাক। আমাদের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে ফাঙ্গাসের আক্রমণ এখনো শুরু হয়নি। তবে অনেকেই বলেছেন, করোনার ভারতীয় ধরন যদি বাংলাদেশে চলে আসতে পারে এবং এর জন্য বাংলাদেশ সরকার বিধিনিষেধের নামে লকডাউনও জারি করেছে। এরকম পরিস্থিতিতে ভারতে ফাঙ্গাস রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে এবং সবাইকে চমকে দিয়ে কলকাতায় রোগটি এসে পড়েছে এবং পাঁচজনের শরীরে ছোবল দিয়েছে। করোনার ভারতীয় ধরন যদি বাংলাদেশে আসতে পারে তাহলে ফাঙ্গাসও অনায়াসে চলে আসতে পারে বলে অনেকেই মন্তব্য করেছেন। পাশাপাশি সীমান্ত এলাকায় বর্তমানে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। এর সঙ্গে ফাঙ্গাসও যোগ হতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন। কাজেই সরকারের উচিত, সীমান্ত এলাকায় গভীরভাবে নজর দেওয়া।

এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ভারতীয় ধরনের করোনাভাইরাস যেমন সংকট সৃষ্টি করতে পারে, তেমনি এ ফাঙ্গাসে আমাদের দেশে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। যদিও এখনো ফাঙ্গাসে কেউ আক্রান্তের খবর পাওয়া যায়নি। তবে অজ্ঞাত রোগে দুএকজন মারা গেছেন। আমার মনে হয় যারা মারা গেছেন তাদের ফাঙ্গাসই কেড়ে নিয়েছে।

তিনি বলেন, ভারতে রোগটির প্রকোপ বেশি থাকায় আমাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। কারণ ভারতের সঙ্গে আমাদের প্রায় সব বিষয়ে মিল রয়েছে। এর ফলে যে কোনো সময় ফাঙ্গাসের প্রকোপ শুরু হতে পারে আমাদের দেশে। ফাঙ্গাস থেকে রক্ষা পেতে হলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি করোনার রোগীদের স্টেরয়েডও কম ব্যবহার করতে হবে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. চিন্ময় দাস বলেছেন, বাংলাদেশে কয়েকজন ভারতীয় ধরনের করোনা ভাইরাসে সংক্রমণে আক্রান্ত হলেও এখন পর্যন্ত ফাঙ্গাস আক্রান্ত রোগী নেই। তবে একেবারেই যে এই রোগ আমাদের দেশে আসবে না, তার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দূরপাল্লার যানবাহন চালু হওয়ার পর আগামী সপ্তাহে করোনা সংক্রমণের ওপর নির্ভর করবে ফাঙ্গাসের প্রভাব। তার মতে, করোনার রোগীরা ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি। কারণ আইসিইউতে করোনা রোগীদের স্টেরয়েড নিতে হচ্ছে। কাজেই যত কম স্টেরয়েড নেওয়া যায় তত মঙ্গল।

এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেছেন, ব্ল্যাক ফাঙ্গাসকে ইতোমধ্যেই ভারতের জরুরি স্বাস্থ্য অবস্থা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এখন নতুন করে হোয়াইট ফাঙ্গাসের কথা আসছে। পর্যাপ্ত গবেষণা হলে পার্থক্যটা বোঝা যাবে। তবে যে কোনো ফাঙ্গাস ইনফেকশন হয় অতিরিক্ত স্টেরয়েড ব্যবহারের কারণে। করোনা রোগীদের বিশেষ করে আইসিইউতে থাকা রোগীদের চিকিৎসার প্রয়োজনে স্টেরয়েড দিতে হয়। করোনা থেকে সেরে ওঠার পর অনেকের দেখা যাচ্ছে ফাঙ্গাল ইনফেকশন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সেটারই এখন নানা ধরন নানাভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। স্টেরয়েডের ব্যবহার থেকে এই সংক্রমণ শুরু হতে পারে। কোভিড-১৯ এ গুরুতরভাবে আক্রান্তদের চিকিৎসায় তাদের জীবন বাঁচাতে এখন স্টেরয়েড দিয়ে চিকিৎসা করা হচ্ছে। করোনা ভাইরাসের জীবাণুর সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যখন অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়ে ওঠে, তখন এর ফলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে যেসব ক্ষতি হয় সেই ক্ষতি থামানোর জন্যও ডাক্তাররা কোভিডের চিকিৎসায় স্টেরয়েড ব্যবহার করেন। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে শরীরে থাকা ফাঙ্গাল ইনফেকশন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে বলে জানান তিনি।

এখন ভারতীয় চিকিৎসা সূত্র জানায়, হোয়াইট ফাঙ্গাস বা সাদা ছত্রাকের প্রভাবে ফুসফুসজনিত সমস্যা তৈরি হতে পারে। পেট, যকৃত, মস্তিষ্ক, নখ, ত্বক এবং গোপনাঙ্গও ক্ষতি করতে পারে হোয়াইট ফাঙ্গাস। তবে হোয়াইট ফাঙ্গাস সম্পর্কে এখনো বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না। এখন পর্যন্ত যে কজন রোগী পাওয়া গেছে, তাদের লক্ষণ দেখে চিকিৎসকরা ধারণা করছেন হোয়াইট ফাঙ্গাস আরো বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের রয়েছে দীর্ঘ সীমান্ত। এসব সীমান্তে স্থলবন্দর আছে অনেকগুলো। এসব বন্দর দিয়ে আসা মানুষ এবং পণ্যবাহী যানবাহনের চালকদের মাধ্যমে দেশে ভারতীয় ধরন ঢুকে পড়ার আশঙ্কা সব সময় ছিল। গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কমিটির সভায় সীমান্ত এলাকায় নমুনা পরীক্ষা, আইসোলেশন, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং ও কোয়ারেন্টাইন বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ও ফাঙ্গাসের সংক্রমণ ঠেকাতে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানার পরামর্শ দেন তিনি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads