• বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জৈষ্ঠ ১৪২৯
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস শনাক্তে উদ্বেগ

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

ব্ল্যাক ফাঙ্গাস শনাক্তে উদ্বেগ

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৬ মে ২০২১

ভারতে সম্প্রতি আতঙ্ক ছড়ানো ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা কালো ছত্রাকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে বাংলাদেশের এক ব্যক্তির শরীরে। তিনি বেশ কিছুদিন আগে কোভিড-১৯ থেকে সেরে উঠেন। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার বারডেম হাসপাতালের মহাপরিচালক অধ্যাপক এম কে আই কাইয়ুম চৌধুরী বিষয়টি নিশ্চিত করেন। বলেন, এ মাসে হাসপাতালের ল্যাবে পরীক্ষায় ওই ব্যক্তির শরীরে মিউকরমাইকোসিস শনাক্ত হয়। ওই রোগী সাতক্ষীরা থেকে এসেছিলেন। বেশ আগে খুলনায় তার করোনা শনাক্ত হয়েছিল। আক্রান্ত ব্যক্তিকে বারডেমে রেখেই চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

এছাড়া রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে তিন দিন আগে ৬৫ বয়সী এক রোগী মারা যান। ওই রোগীর অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ও কিডনিতে সমস্যা ছিল। তিনি করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়েছিলেন। ওই রোগীর অন্যান্য রোগের পাশাপাশি ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত ছিলেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। গতকাল বারডেম হাসপাতালের যুগ্ম -পরিচালক নাজিমুল ইসলাম এ তথ্য জানান। বলেন, মৃত ব্যক্তি করোনায় মারা গেছেন। তবে কনফার্ম ডায়োগনসিস না হলে বলা যাবে না তিনি ব্ল্যাক ফাঙ্গাসেই মারা গেছেন। নিশ্চিত করতে হলে আরো ৩ থেকে ৫ দিন লাগবে। মারা যাওয়া রোগীর কালচার না পাঠালে নিশ্চিত ব্ল্যাক ফাঙ্গাস কিনা তা বলা মুশকিল।

পাশের দেশ ভারত ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা কালো ছত্রাককে মহামারী ঘোষণা করেছে। নিকটতম প্রতিবেশী হওয়াতে বাংলাদেশেও ব্ল্যাক ফাঙ্গাস নিয়ে করোনার মধ্যে নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইতোমধ্যে জানিয়েছে, ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের চিকিৎসা এবং ব্যবস্থাপনা কেমন হবে সে নিয়ে নির্দিষ্ট গাইডলাইন দেওয়া হবে। বিষয়টি নিয়ে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি সতর্ক আছে। তাছাড়া এ সংক্রান্ত চিকিৎসা সম্পর্কে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে জেলাগুলোতে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের চিকিৎসা কেমন হবে, ব্যবস্থাপনা কেমন হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট গাইড লাইন অধিদপ্তর দেবে।

ভারতে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ছড়িয়েছে ব্যাপকভাবে। সেখানে এখন পর্যন্ত আট হাজার ৮০০ জনের বেশি মানুষ ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে সংক্রমিত হয়েছেন এবং এতে সংক্রমিত প্রায় ৫০ শতাংশই মারা যাচ্ছে। আর যারা বেঁচে যাচ্ছেন তাদের মধ্যে একটি অংশের চোখ অপসারণ করতে হচ্ছে। ভারতের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার ১২ থেকে ১৮ দিনের মধ্যে এর সংক্রমণ দেখা দেয়।

ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চ (আইসিএমআর) ডায়াবেটিসে আক্রান্ত কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ শনাক্তে প্রাথমিক লক্ষণগুলোর প্রতি সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে। কালো ছত্রাকের সংক্রমণকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় মিউকরমাইকোসিস। এসব ছত্রাক পরিবেশে বিশেষ করে মাটি, পচে যাওয়া জৈব পদার্থ যেমন : পচা ফলমূল, পাতা বা পশুর বিষ্ঠায় ছড়িয়ে থাকে। এসব ছত্রাককে ল্যাবরেটরির কৃত্রিম মিডিয়াতে যখন বৃদ্ধি করা হয়, এদের রং হয় গাঢ় বাদামি বা কালো। তাই এদের ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা কালো ছত্রাক বলা হয়।

ব্ল্যাক ফাঙ্গাস যে কেবল করোনার কারণেই হবে সেটা নয়। ব্ল্যাক ফাঙ্গাস হসপিটাল অ্যাকোয়ার্ড ইনফেকশন হতে পারে। এটা সহজে মানুষকে সংক্রমণ করে না, তবে ঝুঁকিপূর্ণ রোগী হলে তখন এটা ডেডলি হয়। তাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় রোগীদের পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে এবং দরকার না হলে স্টেরয়েড না দেওয়ার মতো কাজগুলো করতে হবে। তবে আশার কথা হলো, ব্ল্যাক ফাঙ্গাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না।

ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের লক্ষণ সম্পর্কে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, নাক বন্ধ হয়ে যায়, নাকে ঘা হয়ে রক্তক্ষরণ, অস্পস্টতা বা ঝাপসা দেখা এবং সেখান থেকে চোখের ভেতর থেকে রক্তক্ষরণ, ফুসফুসের সংক্রমণ ভালো হলেও অক্সিজেন ধরে রাখার সক্ষমতা কমে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, মুখের একদিকে ফুলে যাওয়া, নাক অথবা দাঁতের মাড়ি কালো হয়ে যাওয়া, কফের সঙ্গে রক্ত যাওয়া, রক্ত বমি, নতুন করে নিউমোনিয়ার সংক্রমণ, মাথাব্যথা, দাঁতে ব্যথা, ঘাড়ে ব্যথা, স্কিনে কালো দাগ দেখা দেয়। ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণের সঙ্গে ডায়াবেটিসের সম্পর্ক রয়েছে। করোনা চিকিৎসায় ব্যবহার হওয়া ডেক্সামেথাসনের মতো স্টেরয়েড ডায়াবেটিসও বাড়িয়ে দেয়। তাই করোনায় আক্রান্ত ডায়াবেটিস রোগীদের চিকিৎসার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা খুব জরুরি।

স্টেরয়েড করোনা আক্রান্ত রোগীদের জীবন বাঁচাতে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এর খারাপ দিক বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে এটা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে ফেলে। আগে থেকেই রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম, এমন মানুষদের যদি এ ওষুধ দেওয়া হয় তাহলে তার রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা আরো কমে যায়। আর এটা হলেই সেসব মানুষের ক্ষেত্রে সেকেন্ডারি ইনফেকশন হচ্ছে।

এবিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন ও ইনফেকশাস বিভাগের ডা. ফরহাদ উদ্দিন হাছান চৌধুরী মারুফ বলেন, সব করোনা আক্রান্ত রোগীর কিন্তু ব্ল্যাক ফাঙ্গাস হচ্ছে না। যাদের আগে থেকেই রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং দীর্ঘমেয়াদি স্টেরয়েড দেওয়া হয়েছে, তাদের ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বেশি হচ্ছে। ভারতে অক্সিজেনের স্বল্পতার কারণে রোগীদের বাঁচানোর জন্য স্টেরয়েডের ব্যবহার বেশি হয়েছে। এ কারণে সেখানে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের এ রকম প্রার্দুভাব দেখা গেছে। কিন্তু বাংলাদেশে পর্যাপ্ত অক্সিজেন রয়েছে, রোগীদের স্টেরয়েড দেওয়া হচ্ছে কম। যেহেতু ভারতে এটা কোথাও কোথাও মহামারী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে তাই এ দেশেও বিষয়টি নিয়ে আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে। ভারতে যেভাবে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে, সেরকম পৃথিবীর অন্য কোথাও হওয়ার সম্ভাবনা কম।

চিকিৎসাধীন থাকার সময়েই রোগীর লক্ষণগুলো নিয়ে মনোযোগী হতে হবে চিকিৎসকদের। কোনো লক্ষণ দেখা দিচ্ছে কিনা সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। চিকিৎসকরা এর লক্ষণ জানবে এবং কখন ব্ল্যাক ফাঙ্গাস হিসেবে সাসপেক্ট করবে সেটা জানতে হবে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, অর্গান ট্রান্সপ্ল্যান্ট করেছেন, করোনা থেকে সুস্থ হওয়া রোগী যারা স্টেরয়েড নিয়েছেন কিংবা অক্সিজেন নিতে হয়েছে, আইসিইউতে ছিলেন অথবা ভেন্টিলেটরে যেতে হয়েছিল, তারা ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হতে পারেন। ব্ল্যাক ফাঙ্গাস কেন হয় তা জানার জন্য অনেক গবেষণা দরকার। তবে লক্ষণ দেখা মাত্র সেই অনুযায়ী রোগীর চিকিৎসা দিতে হবে। দ্রুত শনাক্ত করা গেলে রোগীর জীবন বাঁচবে।

ব্ল্যাক ফাঙ্গাস থেকে বাঁচতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা গুরুত্বপূর্ণ। যদি নোংরা পরিবেশে যেতে হয় তাহলে জুতো পরে যেতে হবে। ফুল স্লিভ পোশাক এবং বাগানে কাজ করার সময় গ্লাভস পরতে হবে। প্রতিদিনের ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা ব্ল্যাক ফাঙ্গাস প্রতিরোধে ভূমিকা রাখবে। অনেকেই ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের কথা শুনে অ্যান্টি ফাঙ্গাল ওষুধ খাচ্ছেন। এই ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। সুতরাং চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কেউ কোনো ওষুধ খাবেন না।

কাতারের ক্লিনিকাল মাইক্রোবায়োলোজিস্ট ও ওয়েল কর্নেল মেডিকেল কলেজের ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ রুবায়েত হাসান বলেন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব, হাসপাতালে ব্যবহার্য সামগ্রী যেমন- ব্যান্ডেজ, মাস্ক অপরিষ্কার, এসি বা এয়ার ফিল্ট্রেশন সিস্টেম, কনস্ট্রাকশনের প্রক্রিয়া থেকে মূলত কালো ছত্রাক ছড়ায়। তবে এটা নিরাময়যোগ্য। যত দ্রুত রোগ শনাক্ত করা যায় ততই মঙ্গল।

আমাদের দেশে এ নিয়ে এখন পর্যন্ত বড় কোনো সমস্যা হয়নি জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, পৃথিবীজুড়ে করোনা হলেও ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ভারত ছাড়া অন্য কোথায় হয়নি। এর কারণ ভারতে অক্সিজেনের সমস্যা ছিল। তাই সেখানে স্টেরয়েড আনইউজ্যুয়াল করা হয়েছে। সেখানে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীও বেশি। একে প্রতিরোধ করার অন্যতম উপায় অনেক বেশি স্টেরয়েড ব্যবহার না করা। ঠিকমতো অক্সিজেন ব্যবহার করা। সাধারণ মানুষের জন্য ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ এবং চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া স্টেরয়েড না খাওয়া। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads