• বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জৈষ্ঠ ১৪২৯

জাতীয়

জীবন-জীবিকা রক্ষার বাজেট

  • মোহসিন কবির
  • প্রকাশিত ০৪ জুন ২০২১

মহামারী করোনা সংকটের মধ্যে আরো একবার জাতীয় বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। গতকাল বৃহস্পতিবার একাদশ জাতীয় সংসদের ত্রয়োদশ অধিবেশনে নতুন অর্থবছরের (২০২১-২০২২) জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার ঘোষিত এই বাজেটে মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কারণ গত বছর করোনা মহামারী শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশ নতুন করে দারিদ্র্যে নিপতিত এবং কর্মহীন হয়ে পড়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের টানা তৃতীয় মেয়াদের সরকারে তৃতীয়বারের মতো অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের বাজেট উপস্থাপনের আগে মন্ত্রিসভার বৈঠকে তা অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বাজেটের অনুমোদন দেন। এর আগে দুপুর ১২টায় জাতীয় সংসদ ভবনের পশ্চিম ব্লকের দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত মন্ত্রিসভা কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বাজেট অধিবেশনে মন্ত্রীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ প্রমুখ।

‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামের এই বাজেট অধিবেশন করোনার কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কমসংখ্যক সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয় সংক্ষিপ্তভাবে। দেশের ইতিহাসে ৫০তম বাজেটে সঙ্গত কারণেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে। পাশাপাশি কোভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজসমূহের বাস্তবায়ন, সামাজিক নিরাপত্তা, কৃষি খাত, খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনাকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

বাজেট উপস্থাপনের শুরুতে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, কোভিড-১৯-এর দীর্ঘতর প্রভাব এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতি ব্যাপক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। কোভিড-১৯-এর প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে সৃষ্ট ক্ষতি হতে পুনরুদ্ধারের কৌশল বিবেচনায় নিয়ে এবং বিশেষভাবে স্বাস্থ্য খাতে উদ্ভূত প্রয়োজন মেটানো এবং ভ্যাকসিন প্রয়োগের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তুত করা হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত এই ব্যয় বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি। আর মূল বাজেটের চেয়ে ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ বেশি।

মহামারী করোনার ধাক্কা সামলাতে এবারের বাজেটে আয়ের দিকে বেশি নজর দিচ্ছে সরকার। সেজন্য বাজেটে মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৯২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৩৬ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা বেশি।

চলতি অর্থবছরে এ আয়ের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৩ লাখ ৫৫ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা, যদিও বাজেটে মূল লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৮২ হাজার ১৩ কোটি টাকা। আয়ের মধ্যে রাজস্ব খাত থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা এবং বৈদেশিক অনুদান নেওয়া হবে ৩ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।

অন্যদিকে এবারের ৫০তম এই বাজেট দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘাটতির বাজেট। আলোচিত এই বাজেটে অনুদানসহ ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ২ লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬ দশমিক ১ শতাংশ। অনুদান বাদ দিলে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা।

২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারের দশটি বিভাগ ও মন্ত্রণালয় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ৯৩.৩৯ শতাংশ বরাদ্দ পাচ্ছে, যা টাকার পরিমাণে প্রায় ১ লাখ ৭১ হাজার ১০৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পাচ্ছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এ বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ২১৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। গত অর্থবছরে এ বিভাগের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ১০৩ কোটি টাকা। সে হিসেবে এবার বরাদ্দ বাড়ছে ৩ হাজার ১১৬ কোটি টাকা।

 এ ছাড়া বাকি নয়টি বিভাগের মধ্যে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ পাচ্ছে প্রায় ২৮ হাজার ৪২ কোটি টাকা; বিদ্যুৎ বিভাগ প্রায় ২৫ হাজার ৩৪৯ কোটি; বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় প্রায় ২০ হাজার ৬৩৪ কোটি; রেলপথ মন্ত্রণালয় প্রায় ১৩ হাজার ৫৫৮ কোটি; স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ প্রায় ১৩ হাজার কোটি; মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ প্রায় ১১ হাজার ৯২০ কোটি; সেতু বিভাগ ৯ হাজার ৮১৩ কোটি; প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রায় ৮ হাজার ২২ কোটি এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় বরাদ্দ পেয়েছে প্রায় ৬ হাজার ৮৭১  কোটি টাকা। সার্বিক বিচারে নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ১২ শতাংশ  বেড়েছে, আর শিক্ষায় বেড়েছে ৮.৫ শতাংশ।

এদিকে বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে অগ্রাধিকার দেওয়া হলেও জিডিপি অনুপাতে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের বরাদ্দ বাড়েনি। স্বাস্থ্য খাতে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে মোট ৩২,৭৩১ কোটি টাকা, বা জিডিপি’র মাত্র ০.৯৫ শতাংশ, যা গেল বছরের সংশোধিত বাজেটের ১.০২ শতাংশের চেয়েও কম। আগামী অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের ৫.৪২ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে যার পরিমাণ ছিল ৫.৮৪ শতাংশ। 

একইভাবে জিডিপির তুলনায় প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ কমেছে। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে জিডিপির মাত্র ২.০৯ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দের জন্য নির্ধারিত করা হয়, কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২.০৮ শতাংশে। সংশোধিত বাজেটে মূল বাজেটের ১২.২৮ শতাংশ বরাদ্দ পায় শিক্ষা খাত, প্রস্তাবিত বাজেটে যা নেমে এসেছে ১১.৯২ শতাংশে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার (ইউনেস্কো) সুপারিশ অনুযায়ী,   কোনো দেশের জিডিপির ৪-৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখতে হয়।

২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার এবারের বাজেট মোট জিডিপির ১৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। অর্থমন্ত্রী বলেন, গত এক দশকে বাংলাদেশের ক্রমাগত উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করোনার প্রভাবে সাময়িক বাধাগ্রস্ত হয়েছে। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেকর্ড ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে করোনার কারণে তা কমে ৫ দশমিক ২ শতাংশে দাঁড়ায়। তবে ২০২০-২১ অর্থবছরে করোনার প্রভাব থেকে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার হবে ধরে নিয়ে চলতি অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮ দশমিক ২০ শতাংশ।

অর্থমন্ত্রী আরো বলেন, এ মহামারির প্রভাব দীর্ঘতর হওয়া এবং বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ ও পুনরায় লকডাউন ঘোষণার কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শ্লথ অবস্থা বিরাজমান এবং রপ্তানি ও আমদানির ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত গতি ফিরে পায়নি। তবে প্রবাসী আয়ে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জিত হওয়া এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সরকার ঘোষিত বৃহৎ প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে চলতি অর্থবছরের জিডিপির প্রাক্কলন সংশোধন করে ৬ দশমিক ১ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।

এবারের বাজেটে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র’ নির্মাণ প্রকল্পে। এই প্রকল্প বরাদ্দ পাচ্ছে ১৮ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা।

নতুন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বিভিন্ন ভাতাভোগীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এতে সব মিলিয়ে আরো প্রায় ১৪ লাখ গরিব মানুষ সরকারের সহায়তা পাবে। কোভিড-১৯ সংকটের মধ্যে নতুন অর্থবছরের বাজেটে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা খরচের যে পরিকল্পনা অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাজিয়েছেন, তার মধ্যে ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪  কোটি বরাদ্দ রেখেছেন সামাজিক নিরাপত্তা খাতে।

এই অঙ্ক মোট বাজেটের প্রায় ১৮ শতাংশ। আর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ দশমিক ১১ শতাংশ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads