• শনিবার, ৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

জুলাইয়েও খুলছে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

শিক্ষায় উদ্বেগ বাড়াচ্ছে দীর্ঘ ছুটি

  • মোহসিন কবির
  • প্রকাশিত ২১ জুন ২০২১

রাজধানীর বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা নাজমুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। একমাত্র সন্তান এবার উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষার্থী। দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এতদিন সন্তানের লেখাপড়ার ক্ষতি নিয়েই বেশি চিন্তিত ছিলেন। সম্প্রতি তার সেই ভাবনায় ছেদ পড়েছে। এখন আর তিনি সন্তানের লেখাপড়া নিয়ে ততটা চিন্তিত নন, যতটা তার বখে যাওয়া নিয়ে।

তিনি জানালেন, প্রথমদিকে বেশিরভাগ সময় তার ঘরে বসে টিভি দেখে কিংবা ভিডিও গেমসে সময় কাটত। কিন্তু দীর্ঘদিন একনাগাড়ে কলেজ বন্ধ থাকায় তাকে আর বেশিদিন আটকে রাখা যায়নি। বাইরে আড্ডা দিতে গিয়ে এলাকার বখাটে কিছু ছেলেদের সঙ্গে ওঠাবসায় গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়েছে তার ছেলে। তুচ্ছ ঘটনায় প্রায়ই দলবল বেঁধে মারামারি করার খবর তার উদ্বিগ্নতার মূল কারণ। একরাশ হতাশা নিয়ে তিনি বলেন, ‘সুযোগ থাকলে বিদেশে পাঠিয়ে দিতাম পড়াশোনার জন্য। কিন্তু সেজন্য দরকার বিপুল অর্থ। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার অপেক্ষা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।’

নাজমুল ইসলামের মতো আরো অসংখ্য অভিভাবক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সন্তানের লেখাপড়ার চেয়ে এখন বখে যাওয়া এবং মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েই সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন।

সম্প্রতি পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশান রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভর্ন্যান্স অ্যান্ডডেভলপমেন্ট (বিআইজিডি) প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ওপর পরিচালিত যৌথ জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪৮ শতাংশ অভিভাবক সন্তানদের শিক্ষার ঘাটতি নিয়ে এবং ৫৯ শতাংশ অভিভাবক তাদের পড়ালেখায় অনাগ্রহ নিয়ে চিন্তিত। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ৮৬ শতাংশ অভিভাবক করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে চিন্তিত নন, এবং বাকি  ১৪ শতাংশ কম চিন্তিত। এছাড়া, অটোপাস পাস হলে ভবিষ্যতের কর্মসংস্থান সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন ৩১ শতাংশ অভিভাবক।

এদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চলমান ছুটি আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে করোনা সংক্রমণের হার না কমলে ছুটি ফের বাড়তে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন। সরকারি বিধিনিষেধ ও ঈদুল আজহার সঙ্গে মিলে রেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি আরো এক মাস বাড়তে পারে। সে হিসেবে আগামী জুলাইয়েও খুলছে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

৩০ জুনের পর ছুটি কতদিন বাড়তে পারে-এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব মো. মাহবুব হোসেন জানান, চলতি সপ্তাহ করোনা মোকাবিলায় সরকারের গঠিত পরামর্শক কমিটির সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এ সপ্তাহে সিদ্ধান্ত আসতে পারে।   

আর এসব খবর শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আরো ভাবিয়ে তুলেছে। কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় একদিকে শিক্ষার্থীদের মাঝে একাকিত্ব, স্মার্টফোন, ভিডিও গেমস এবং ইন্টারনেটের প্রতি আসক্তি বাড়ছে। এতে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা। কারণ এর ফলে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে গত বছরের ১৮ মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান  বন্ধ হওয়ার পর কেটে গেছে প্রায় ১৬ মাস। ফলে অনাগত ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত শিক্ষাজীবন, নানাবিধ পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যায় জর্জরিত শিক্ষার্থীদের ঘিরে ধরেছে হতাশা ও বিষণ্নতা। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি ও হতাশায় ভুগছেন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা।

তারা কেউ কেউ জানান, বন্ধের প্রথম অবস্থায় গ্রামের বাড়িতে গিয়ে নিশ্চিন্তে থাকলেও এখন সবকিছু খুলে দিলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খোলায় চরমভাবে হতাশ। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, যাদের সিংহভাগই টিউশনি অথবা খণ্ডকালীন চাকরির সামান্য টাকায় নিজের চলাফেরা ও পড়াশোনার খরচ নির্বাহ করতে হয়। কিন্তু এই দীর্ঘ ছুটিতে একদিকে হারিয়েছেন আয়ের উৎস অন্যদিকে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে শিক্ষাজীবন।

এদিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে ২০২১ সালেও হচ্ছে না প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা। তবে গতবছরের মতো অটোপ্রমোশন না দিয়ে এবার হোমওয়ার্কের মাধ্যমে মূল্যায়ন করে পরবর্তী শ্রেণিতে প্রমোশন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

কোন পদ্ধতিতে তাদের পরবর্তী ক্লাসে প্রমোশন দেওয়া হবে তার সারসংক্ষেপ তৈরির কাজ শুরু করেছে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। পদ্ধতি নির্ধারণ করে খুব শিগগিরই প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে অনুমোদনের জন্য। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পাওয়া গেলে জুলাই মাসের মধ্যেই এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হবে। অন্যদিকে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি আগেই ইঙ্গিত দিয়েছেন, এবারের জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষাও হবে না। একই রকম সিদ্ধান্ত হতে পারে জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষার ব্যাপারেও। এ দুটিই অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা।

গতবছর করোনা পরিস্থিতির কারণে পিএসসি, জেএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া যায়নি। পিএসসি ও জেএসসি শিক্ষার্থীদের অটো প্রমোশন দেওয়া হয়। আর এসএসসি ও জেএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে এইচএসসি শিক্ষার্থীদের ফলাফল দেওয়া হয়।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পরীক্ষা না নেওয়া হলেও ছাত্রছাত্রীদের শিখন ঘাটতি পূরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আগে থেকেই টেলিভিশন ও বেতারে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পরে গুগলমিটের মাধ্যমে শিক্ষকদের ক্লাস নিতে বলা হয়েছে। ঘাটতি পূরণের পদক্ষেপে সর্বশেষ যুক্ত করা হয় ‘বাড়ির কাজ’। এ লক্ষ্যে তৈরি করা হয়েছে ‘অন্তর্বতীকালীন পাঠপরিকল্পনা’। তাতে বিষয়ভিত্তিক বাড়ির কাজ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে।

এদিকে, জেএসসি পরীক্ষার ব্যাপারে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের একজন কর্মকর্তা বলেন, জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা নভেম্বরে নেওয়া হয়। অন্য বছর এই সময়ে রেজিস্ট্রেশন, ফর্ম পূরণসহ আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করা হয়। শুরু হয় প্রশ্নপত্র তৈরি ও মুদ্রণকাজ। এ বছর এসব নিয়ে মন্ত্রণালয়ের কোনো নির্দেশনা এখনো পাওয়া যায়নি। এতে বলা যায়, পরীক্ষাটি এবার নাও হতে পারে। এ নিয়ে আমাদের প্রস্তুতি বলতে কেবল রেজিস্ট্রেশন করে রাখা হয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads